করোনার সংবাদে মানসিক চাপ এবং ভরসা

  • বাশার খান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে-বিদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিনই। বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্ত হলেই যে সবাই মারা যাচ্ছে বা যাবেন বিষয়টি এমন নয়। মৃতের সংখ্যার তুলনায় সুস্থ হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। তারপরও এই মহামারিকে নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আছে চাপা এবং প্রকাশ্য আতঙ্ক। এই বুঝি আক্রান্ত হলেন এই ভয়ে অনেকেই মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন। তারপর যখন টিভি চালু করে বা সংবাদপত্রের পাতায় মৃত্যুর খবর দেখেন, তখন কম-বেশি বিচলিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন

করোনার সংবাদে মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই টেলিভিশনে খবর দেখা কমিয়ে দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে হার্টের রোগ এবং বিষণ্নতাজনিত রোগীরা। আবার সুস্থ-সবল কেউ কেউ জানান, ‘খবর দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। তাই অন্য অনুষ্ঠান দেখি, খবর কম দেখি।’ বোঝাই যাচ্ছে করোনার সংবাদে মানুষের মানসিক অবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। পাশাপাশি লকডাউনে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার কারণেও তৈরি হচ্ছে একাকিত্ব, বাড়ছে উদ্বেগ।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের একদল গবেষক জানান, ‘...মস্তিষ্কের বিকাশ এবং বোধশক্তি তৈরির জন্য সামনা-সামনি মেলামেশার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লকডাউনের কারণে পরস্পরের মুখোমুখি যোগাযোগ কমে যাওয়ায় তরুণদের পরবর্তী জীবনে মানসিক স্বাস্থ্য, আচরণগত সমস্যা এবং বুদ্ধির বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে’ (সূত্র : ইত্তেফাক, ১৬ জুন ২০২০)। করোনাভাইরাসের কারণে ঘরে থেকে তরুণদের ওপরই যদি এই প্রভাব পড়ে তাহলে বয়স্ক এবং আগে থেকেই অসুস্থ ব্যক্তির ওপর প্রভাবটা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

বিজ্ঞাপন

গত ১৫ এপ্রিল ২০২০, বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের শিরোনামই ছিল ‘Urgent studies needed' into mental health impact of corona virus. প্রতিবেদনে দেখানো হয়, করোনাভাইরাস এবং লকডাউনের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং এটা দীর্ঘ মেয়াদি হতে পারে। এ নিয়ে গবেষণা ও পরিত্রাণের উদ্যোগ প্রয়োজন।

বিবিসির একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা যায়। ‘সংবাদ মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নানা খবর দেখে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু লোকের জন্য তা তাদের বিদ্যমান মানসিক সমস্যাকে আরও গুরুতর রূপ দিতে পারে। সেকারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা... করোনাভাইরাস সংকটের সময় মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার ব্যাপারে পরামর্শ প্রকাশ করে’ (করোনাভাইরাস: এ নিয়ে দুশ্চিন্তা-উদ্বেগের মধ্যে কীভাবে আপনার মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করবেন?)

সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাসায় করোনা ঢুকতে পারে বা মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির খবরে মানসিক চাপ বাড়তে পারে এ আশঙ্কায় অনেকে বাসায় পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছে। অপরদিকে, কোন কোন পত্রিকার খবরের শিরোনাম ও পরিবেশনের ধরনটি এমন যে, এতে শুধু মানসিক চাপই নয়, কেউ কেউ বিচলিত হয়ে পড়তে পারেন। যেমন, ‘বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে বারান্দায়ই মারা গেল করোনা উপসর্গের রোগী'। এ ধরনে শিরোনাম।

২. মৃত্যু অবধারিত। সৃষ্টির ব্যাপারে মহান সৃষ্টিকর্তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল, ‘জন্ম নিলে মরতে হবে।’ মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্যই একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে, যখন তাদের সে সময় আসবে তখন একমুহূর্ত পিছু হটতে পারবে না, সামনেও যেতে পারবে না।’ (সূরা আ’রাফ, আয়াত ৩৪)। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যু নির্ধারিত সময়েই হবে। কারো মৃত্যু, বেধে দেওয়া সময়ের আগেও হবে না, পরেও হবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনামূলক একটি বক্তব্য এখানে প্রাসঙ্গিক। বক্তব্যটি দেশের মানুষের মানসিক চাপ কমাতেও সহায়ক। তিনি বলেন, ‘... মৃত্যু তো হবেই, মৃত্যু যেকোনো সময় যেকোনো কারণে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য ভীত হয়ে হার মানতে হবে? এটাতো হতে পারে না। সেজন্য আমাদেরও সেভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ...স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যা যা নির্দেশনা আছে, সেগুলো মেনে চলে নিজের জীবনকে চালাতে হবে। কারণ, নিজেকে সুরক্ষিত রাখা মানেই অপরকেও সুরক্ষিত রাখা’ (আস্থা রাখুন, বাংলাদেশ হার মানবে না : প্রধানমন্ত্রী)

৩. করোনার প্রাদুর্ভাব ও প্রাণহানির ঘটার শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার সামাজিক দূরত্ব বাড়ান এবং লকডাউনের কথা বলে আসছে। করোনা মোকাবেলায় সামাজিক দূরত্ব বাড়ানোর সঙ্গে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে মানবিক ও মানসিক দূরত্বও বেড়ে গেছে। অথচ বলা হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। যাতে আক্রান্ত একজনের হাঁচি-কাশিতে অন্যরা সংক্রমিত না হন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি বক্তব্য এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। গত ২৯ মার্চ ২০২০, জাতির উদ্দেশে দেওয়া রেডিও ভাষণে তিনি বলেন, ‘সামাজিক দূরত্বের অর্থ এই নয় যে, সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া। এর মানে আপনার সম্পর্কগুলিকে নতুন জীবন দান করা। সামাজিক দূরত্ব বাড়ান, কিন্তু মানবিক তথা মানসিক দূরত্ব কমান।’

বেশ কিছুদিন ধরে সংবাদপত্র হাতে নিলে বা টিভি চালু করলে দুই ধরনের দৃশ্যই দেখা যায়। করোনায় আক্রান্তকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে স্বজনরা এবং মৃতের লাশ দাফনে স্বজনদের অনীহা। এগুলো মানবিক দূরত্ব বাড়ার চরম নিষ্ঠুরতম উদাহরণ। আবার করোনা আক্রান্তদের জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে দেওয়া, ঝুঁকি নিয়ে করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন এমন মানবিক সংবাদও দেখা যায়। অর্থাৎ গণমাধ্যমে আশা জাগানিয়া এবং হতাশা করা মত দুই ধরনের সংবাদই পাওয়া যায়।

৪. করোনার সংবাদে আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব কী হতে তা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ নিয়ে সুস্থ-সবল মানুষও কম/বেশি উদ্বিগ্ন।

গত ১৬ জুন ২০২০, অফিসে আমার রুমে বসে কাজ করছি। বেলা পৌনে ৩টায় আমার এক সহকর্মী দৌড়ে বললেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫৩ জন মারা গেছে। আক্রান্ত ৩৮৬৩ জন। পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে। চলেন বাসায় চলে যাই।’ অনলাইনে খবরটি দেখে তিনি কতটুকু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তা বোঝা যায় তার বক্তব্যের মধ্যেই।

প্রশ্ন দাঁড়ায়, যেহেতু করোনার সংবাদে মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, তাহলে খবর পরিবেশন ও প্রকাশ কী সীমিত থাকবে। অথবা মানুষ কী করোনা ভাইরাসের খবর দেখবে না, পড়বে না?

টিভি অন করলে বা সংবাদপত্রের পাতা উল্টালে এমন খবরও থাকে যা মানুষকে ভরসা দেয়। কমে মানসিক চাপও। উদাহরস্বরূপ বলা যায়, গত ১৮ এপ্রিল ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মা জাহানারা খান ৮৫ বছর বয়সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে, এই বয়সে জাহানারা খানকে বাঁচানো কঠিন হবে। কিন্তু এই আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তিনি করোনা জয় করেন। এ নিয়ে প্রায় সব সংবাদপত্রেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘৮৫ তে করোনা জয় মুনতাসীর মামুনের মায়ের।’ আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘করোনাকে জয় করলেন ৮৫ বছর বয়সী জাহানারা খান।’ করোনাকালে খবরের এমন শিরোনাম বয়স্ক ব্যক্তিদের মনোবল বৃদ্ধিতে নিশ্চই ভূমিকা রাখবে।

আবার অপর একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম করা হয়, ‘মুনতাসীর মামুনের মায়ের করোনা জয়।’ প্রথম দুটি শিরোনামে যেভাবে মানুষের মনোজগতে ভরসা জাগায়, পরের শিরোনামটি সেভাবে ভরসা জাগানোর কথা না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, খবর একই, শুধু শিরোনাম ও পরিবেশনের ধরনের মধ্যেও পাঠক বা শ্রোতার মানসিক সম্পর্ক রয়েছে।

কোন শিরোনাম ও খবরে পাঠক-শ্রোতা বেশি ভরসা পান, আবার কোনটিতে কম। আবার এমন শিরোনামও করতে দেখা যায়, শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ঘাবড়ে যেতে পারেন। সুতরাং করোনার সংবাদ পরিবেশনে মানুষের মনোজগতে কী প্রভার পড়তে পারে, সে দিক বিবেচনায় নিয়ে শিরোনাম ও খবর পরিবেশন করাই যুক্তিযুক্ত। মর্মান্তিক খবরটিও এমনভাবে পরিবেশন করা যায় যাতে কারো হার্টফেল না হয়ে যায়। করোনার সংবাদ পরিবেশন বা প্রকাশে দায়িত্বশীল হলে নিশ্চই পাঠক ও শ্রোতার মানসিক চাপ কমানোর সম্ভব। ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে গুরুত্ব দিলে এটি করা কঠিন কিছু নয়।

বাশার খান: জ্যেষ্ঠ গবেষক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি), তথ্য মন্ত্রণালয়।