করোনাকালে টিভি সাংবাদিকতা
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। প্রায় ২১৫টি দেশ করোনার ছোবলে নীল হয়ে গেছে। কোথাও বেশি, কোথায় কম। তবে আতঙ্কতো সারা পৃথিবী জুড়েই। কোনো কোনো দেশ লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বা নিয়েছে। এ অবস্থায় সচেতনার কোনো বিকল্প নেই। কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দি। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই বিশ্ববাসীর।
বাংলাদেশের অবস্থার কথা বলতে গেলে প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল। এ সময়ে সংবাদকর্মীরা রাত দিন ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন। একদিকে জীবিকার তাগিদ, অন্যদিকে দেশের মানুষকে সঠিক তথ্য জানানোর তাগিদ। কারণ সঠিক তথ্য পেলে মানুষ আর গুজবে কান দেবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন করে মানুষকে অবাধে সবার সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছে, তেমনি করে আবার কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। যাই হোক এ করোনার সময়ে সাংবাদিকতার কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরাই আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সেই থেকে সরকারিভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানান পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে যাতে করে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না ঘটে। কিন্তু সাধারণ মানুষ শুরুতে যেমন সাড়া দিয়েছিল, পরে সচেতনতা দিন দিন কমতে থাকে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর কয়েকদিন মানুষ নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখে। রাস্তাঘাটে মানুষ কমে যায়।কিছু দিন যাওয়ার পর মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে রাস্তা-ঘাটে। এ সময়ে সাংবাদিকতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে টিভি সাংবাদিকতা। ভালো নিউজ করতে গেলে ভালো ছবির কোনো বিকল্প নেই। তাই ছবি নিতে বাইরে বের হতেই হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সামাজিক দূরত্বের কথা আইইডিসিআর শুরু থেকেই বলে আসছে। কিন্তু তিন ফুট দূরত্ব মানে কি? এটাই মানুষকে বোঝানো যায়নি। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। কোথাও সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে, আবার কোথাও তা মানাই হচ্ছে না। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষের ভিড়ে আতকে ওঠার মতো অবস্থা। কারণ ত্রাণের আশায় রাস্তায় কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন নিয়ম করে। সরকারিভাবেও যেমন ত্রাণ বা খাদ্য সামগ্রী দেয়া হয়েছে, তেমনি করে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যাগেও ত্রাণ দিয়ে নিম্ন আয়ের জনগণকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে।
রাস্তায় গাড়িতে করে অনেকে কয়েকজনকে ত্রাণ দিয়ে চলে যাওয়ার পর, তা নিয়ে টানাটানিসহ অনেক সমস্যাই তৈরি হয়েছে। সরকার প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশনায় অনেকেই সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে ত্রাণের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি হাজার গুণ বেড়েছে সংবাদকর্মীদের। মার্চে মানুষ যখন কিছুটা সর্তক ছিল, তখন সংবাদ সংগ্রহ করা সহজ ছিল, কারণ রাস্তা থাকত ফাঁকা। ভিড়ও ছিল না কোথাও।
কিন্তু মানুষ যখনই বাসা থেকে বাইরে বের হওয়া শুরু করল, তখন সামাজিক দূরত্ব আর মানা হচ্ছিল না। সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল তখন থেকেই বাড়তে লাগল। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক গণমাধ্যমকর্মী আক্রান্ত হতে শুরু করে। ত্রাণ প্রত্যাশীরা এতোটাই ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল যে টিভি ক্যামেরা দেখলেই ভিড় করত। লাইভ দেয়ার সময় নিজেকে সর্তক অবস্থানে রাখার চেষ্টা করা হলেও জনগণ ঘিরে থাকত। এমন পরিস্থিতিতে কাজ করাও অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। বক্তব্য নিতে গেলে বলে, আল্লাহ বাঁচাবে, যার মরণ যেভাবে আছে, সেভাবে হবে। কিন্তু নিজেদের যে সচেতন হতে হবে, সে কথা কেউ বলে না।
রাস্তায় বের হলে সাধারণ মানুষ যে সচেতন না, এমন খবরই সংগ্রহ করতে হয়েছে বেশি। কারণ করোনা সংক্রামক ব্যাধি। কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক না থাকায় এ ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা নিজেকে বাসায় বা ঘরে আবদ্ধ রাখতে বলেছে বিশেষজ্ঞরা। বাইরে বের হলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিয়ে বের হতে হবে। যেমন মাস্কসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। কিছু মানুষ একটু সচেতন হলেও অনেকের মধ্যেই দেখা গেছে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতার অনেক অভাব। এমন হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে। তবে করোনার মতো মহামারি পৃথিবীতে ১০০ বছর পর পর আঘাত আনে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ সচেতন হবে এমনটাই আশা সবার।
করোনার সময় সরকার সাধারণ ছুটি কয়েক দফা বাড়ায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ অনেক দিন বাসায় বা বাড়িতে থেকে রাজধানীর অবস্থা দেখতে বাইরে বের হয়েছে। সংবাদ সংগ্রহ করতে অনেকবার এমন উৎসুক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাদের বক্তব্য এমন, অনেক দিনতো বাসায় ছিলাম, এখন ঢাকার কি অবস্থা দেখতে বের হয়েছি। বাসায় এতো দিন থাকতে থাকতে হাত-পা ব্যথা করছে। তাই বাইরে বের হয়েছি হাওয়া খেতে।
অবশ্য কিছু কিছু মানুষ বের হয়েছে জীবিকার তাগিদে। রাজধানীতে এমন অনেক মানুষ দেখেছি, যাদের ঘরে খাবার নেই। রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুরসহ শ্রমজীবী অনেক মানুষ। এদের দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। সবাই যে অপ্রয়োজনে বের হয়েছে, তাও বলা যাবে না। সরকারের সাধারণ ছুটি টানা ৬৬ দিন শেষ হওয়ার পর অফিস আদালত সীমিত আকারে খোলা হয়। তবে এর আগেই কিছু মন্ত্রণালয় খোলা হয়েছিল। এরপর মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে রাস্তায়, ট্রেন, গণপরিবহনও সীমিত আকারে খুলে দেয়া হয়।
এরপর থেকেই করোনার ছোবল মানে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। অদৃশ্য এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবাইকে নানাভাবে সচেতন করার চেষ্টা করছে। কারণ করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে এখনও ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারেনি বিশ্ব। কবে এ ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হবে, তা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা।
সংবাদকর্মীরা করোনা যোদ্ধা ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ সবার কাছে যেতে হচ্ছে। গণমাধ্যমের কাজ বন্ধ হয়নি বা কোনো দিনই বন্ধ হবে না। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার এ পেশায় নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সংবাদকর্মীরা। দেশের উন্নয়ন, দুর্নীতি, ভালো ও খারাপ সব কিছুতেই থাকে গণমাধ্যমকর্মীদের বিচরণ। সবাই নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলে। আর গণমাধ্যম তা প্রচার করে। কিন্তু গণমাধ্যমে কর্মরতদের নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস কতোটুকু আছে? বা তারা কতোটুকু বলে?
যাই হোক করোনার এ ভয়াবহতা একদিন চলে যাবে। সুন্দর হবে পৃথিবী ও আগামীর ভবিষ্যৎ।
এফ এম মুশফিকুর রহমান: সিনিয়র রিপোর্টার, মোহনা টেলিভিশন লিমিটেড।