পাপুলের ‘টাকার গরম’ এবং বাংলাদেশের লজ্জা
শহিদ ইসলাম পাপুল। আমাদের মহান জাতীয় সংসদের একজন সদস্য। আইন প্রণেতা। তিনি এখন কুয়েতের কারগারে বন্দি জীবন যাপন করছেন। না, তিনি যে সেখানে ‘শখ’ করে কারাজীবন বেছে নিয়েছেন- এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। মানব পাচার এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েত সরকার তাকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছে। সেখানে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মানব পাচারের মতো ভয়াবহ কাণ্ডে বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের এভাবে ভিন্ন দেশে আটক হওয়া এবং কারাবাসের ঘটনায় পাপুল লজ্জা না পেলেও আমরা, এদেশের নাগরিকরা ভীষণভাবে লজ্জিত। অপমানিতবোধ করছি। কারণ এক পাপুল কাণ্ডেই বর্হিবিশ্বে আমাদের দেশ, জাতি-রাষ্ট্রের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। কুয়েত তো বটে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের প্রবাসী ভাইবোনেরা, যারা মর্যাদার সঙ্গে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, কঠিন পরিশ্রম করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন পাপুল কাণ্ডে তারাও বিব্রত। তবে আমাদের সরকার পাপুলের ঘটনায় এখন পর্যন্ত খুব একটা বিব্রত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও বা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার অর্থের অনুসন্ধানে নেমেছে বলে জানা গেছে।
রাজনীতির মাঠে শহিদ ইসলাম পাপুলের নাম কেউ কোনদিন শুনেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ করে অংশ নিয়েই লক্ষীপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। পত্র পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তার সংসদ সদস্য হওয়ার নেপথ্যে ‘টাকার গরম।’ রাজনৈতিক দলের প্রার্থী না হয়েও তিনি টাকার জোরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ টাকা এবং টাকা-ই হচ্ছে তার রাজনৈতিক দল এবং দর্শন। শুধু যে নিজে নির্বাচিত হয়েছেন তা নয়, টাকার গরমে নিজের স্ত্রীকেও সংরক্ষিত আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে সংসদে নিয়ে আসেন। এতেই কিছুটা টের পাওয়া যায় তার ক্ষমতার উৎস!
আমাদের দেশের প্রতিটি নির্বাচনে টাকা উড়ে— সেটা প্রায় ওপেন-সিক্রেট বিষয়। ইউনিয়ন নির্বাচন থেকে শুরু করে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় নির্বাচন— সর্বত্রই কালো টাকার দৌরাত্ম্য থাকে। প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি টাকা এবং ক্ষমতার প্রভাব বড় ভূমিকা রাখে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে। শুধু যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে কালো টাকার উপস্থিতি দেখা যায় তা না, স্কুল-কলেজ পরিচালনা পর্যদের নির্বাচনেও টাকা উপস্থিতি ব্যাপকভাবে দেখা যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে মানুষ টাকা দিয়ে ক্ষমতা কিনতে চায়, ক্ষমতাবান হচ্ছে চায়। ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে চায়। না হলে পাপুল কেন এতো বিনিয়োগ করে আইনসভার সদস্য হতে গেলেন। আমার ধারণা, তার কাছে মনে হয়েছে আইনসভার সদস্য হতে পারলে তার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যাবে। তিনি আর দোর্দণ্ড দাপুটে নিজের অন্যায় অপকর্মগুলো চালাতে পারবেন। সব কিছু তার হাতের মুঠোয় বা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর অবস্থা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। না হলে, আইন সভার একজন সদস্য মানব পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগে বিদেশের মাটিতে গ্রেফতার হয়ে দেশের ভাবমুর্তী ক্ষুণ্ন করার পরও পাপুলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আমাদের সরকারের তরফে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না কেন?
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে গিয়েছিলেন পাপুল। তারপর ভিসা বাণিজ্য আর মানব পাচার করে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান। কুয়েতিয়া মারাফিয়া কোম্পানির নামে কুয়েতে গড়ে তোলেন বিশাল সাম্রাজ্য। কুয়েতে তার এমন সাম্রাাজ্য গড়ে তোলার পিছনে সেখানকার একাধিক সংসদ সদস্য এবং সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা, সহজ বাংলায় যাকে বলে ঘুষ নিয়ে পাপুলকে সহযোগিতা করেন। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর কুয়েতি গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বের হয়ে এসেছে। যা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে।
এই যে বাংলাদেশের একজন আইনপ্রণেতা মানব পাচার, অর্থ পাচার ও ভিসা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে বিদেশে গ্রেপ্তার হলেন তাতে দেশের ভাবমূর্তি কী খুব উজ্জল হয়েছে? কুয়েতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুয়েতে বসরবাসরত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে যতদূর জানতে পারলাম, পাপুলকে বেশ কিছু দিন ধরে কুয়েতের স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফলো করছিল। শেষ পর্যন্ত তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে আটক করে। আগামী মাসের প্রথম দিকেই তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হতে পারে। পাপুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে তাতে তারা সাজা হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সাজা হোক বা না হোক, গুরুতর একটা অভিযোগের প্রেক্ষিতে কুয়েত সরকার তাকে আটক করার পর বাংলাদেশের ভাবমূর্তী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় কুয়েতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা তো বটে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদেরকেও এখন নানান তির্যক মন্তব্য শুনতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও শুনতে হবে। কুয়েতের সংসদে তো স্থানীয় একাধিক সদস্য বাংলাদেশ সম্পর্কে কটুক্তি করেছেন। এটা আমাদের জন্য লজ্জার, অপমানের।
অথচ টাকার গরমে সংসদ সদস্য হওয়া পাপুল দেশকে বর্হিবিশ্বের কাছে ছোট করলেও তার এবং তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি আমাদের জাতীয় সংসদ এবং সরকার। জাতীয় সংসদের মর্যাদাহানির জন্য সংবিধানের ৭৮ ধারা অনুযায়ী (সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার) পাপুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা নেয়া হয়নি।
অবশ্য জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন গণমাধ্যমকে বলেছেন, পাপুলের গ্রেপ্তারে জাতীয় সংসদের মর্যাদাহানি হয়েছে কি-না সেটা এখনই বলা যাবে না! কারণ এখন পর্যন্ত বিষয়টি পাপুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তদন্ত চলছে, রিপোর্ট আসলে পর দেখা যাবে। বাহ্ কি চমৎকার যুক্তি। আইনসভার একজন সদস্য মানবপাচারের অভিযোগে বিদেশের মাটিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাগারে আটক আছেন, অথচ সংসদের মর্যাদাহানির জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগে উত্থাপিত অভিযোগের প্রমাণ লাগবে!
একটি উন্নত বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের পূর্বসূরীরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। জীবন বাজি রেখেছিলেন। স্বাধীন, সার্বভৌম ও উন্নত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকিস্তানীদের বন্দুকের মুখে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন এদেশের সূর্য সন্তানরা। ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। ইজ্জত হারিয়েছিলেন দুই লাখ মা-বোন। রক্ত আর ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সোনার বাংলার বুকে আজ ‘লজ্জা’ ও ‘অপমান’র তীর বিদ্ধ করেছেন আমাদের আইন সভারই একজন সদস্য। যিনি মানবপাচার, অর্থপাচারসহ সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করার কথা সেই তিনিই জড়িয়ে আছেন এসব অপরাধে। বাংলাদেশের দুঃখটা এখানেই।