অপরিকল্পিত কারখানা মারছে নদী
হবিগঞ্জে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্যে মরছে নদী-খাল-বিল ও জলাশয়। নদীতে বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর লাখো মানুষের জীবনযাত্রাও হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে নদীপাড়ের মানুষ। তারা আক্রান্ত হচ্ছেন শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগে। মারা যাচ্ছে গৃহপালিত গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী। মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ছে নদী-খাল-বিল জলাশয়।
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার সুতাং নদী এক সময় এলাকার ঐতিহ্য বহন করত। কিন্তু গেলো কয়েক বছরে ওলিপুরে গড়ে উঠেছে অন্তত অর্ধশতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত বর্জ্য প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে কালো হয়ে গেছে নদীর পানি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কল কারখানার দুষিত বর্জ্যে নদীটি দুষিত হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে তীরবর্তী বুল্লা, করাব, লুকড়া, নুরপুর, রাজিউড়াসহ বেশ কটি ইউনিয়নে বাসিন্দাদের জীবনে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। মরে যাচ্ছে নদীর সকল মাছ। ফলে আয়ের উৎস হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে।
শুধু তাই নয়, নদী দূষণের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার ফসলি জমি। এ নদীর পানি এখন কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তারপরও যারা ব্যবহার করছেন, তাদের জমির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে। নদীর পানি পান করে মারা যাচ্ছে গরু-ছাগল, হাঁস-মোরগসহ গৃহপালিত পশুপাখি। আশপাশের গ্রামগুলোতে হাঁস-মুরগি পালনও বন্ধ হয়ে গেছে।
একই অবস্থা জেলার বাহুবল উপজেলার করাঙ্গী নদীরও। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী করাঙ্গী নদীতে। এ নদীটির অবস্থাও এখন সুতাং নদীর মতোই করুণ।
শুধু সুতাং ও করাঙ্গী নদীই নয়। এই দুটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাদ যায়নি জেলার অন্যসব নদীগুলোও। জেলার বাকি নদীগুলোর অবস্থাও একই রকম।
সুতাং নদীর বিষয়ে তীরবর্তী বাসিন্দা উচাইল গ্রামের আব্দুস সালাম বলেন, সুতাং নদীর পানির দুর্গন্ধের জন্য আমরা বাড়িঘরে থাকতে পারছি না। এক সময় সুতাং নদীর মাছের জন্য দূর থেকে মানুষ আসতো। এখন মাছ একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না।
মো. আলাই মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, কোম্পানি আসার পর থেকেই নদীর পানির এই অবস্থা। সুতাং নদী আমাদের অনেক উপকার করত, মানুষ গোসল করতো, মাছ আহরণ করত। এখন আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। এই এলাকায় কেউ বিয়ে দিতেও চায় না।
নদী দূষণের বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, অপরিকল্পিত শিল্পায়নে দেশের উন্নয়ন নয় বরং ধ্বংস ডেকে আনছে। সুতাং নদী এবং আশপাশের খাল-বিলের চিত্র দেখলেই বিষয়টি বুঝা যাবে। শুধু সুতাং নদী নয়, জেলার প্রতিটি নদীর একই অবস্থা। পাশাপাশি খাল, বিল, জলাশয়েও এসব নদীর মাধ্যমে শিল্পবর্জ্য নিক্ষেপ হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সকল ধরনের শিল্পবর্জ্য ‘উৎসে পরিশোধন’ বাধ্যতামূলক হলেও এই অঞ্চলে তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। কল কারখানাগুলো শুরু থেকেই বেপরোয়াভাবে দূষণ চালিয়ে আসছে যা সংশ্লিষ্ট গ্রামসমূহের বাসিন্দাদের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত।
লাখাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম আলম বলেন, সুতাং নদীটি এলাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নদীর পানি ব্যবহার করে অনেক কৃষক উপকৃত হতো। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে শিল্পকারখানা হবার পর থেকেই নানা সমস্যা হচ্ছে। মানুষ পানি ব্যবহার করলে চর্মরোগসহ নানান ধরনের অসুখ হয়।
তিনি বলেন, নদী এবং আমাদের বিলগুলোর মাছ বিনষ্ট হচ্ছে। পানিতে যত ধরনের প্রাণী আছে, এদের প্রায়ই দেখা যায় মরে ভেসে উঠতে। ময়লা পানির কারণে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদন হবার কথা তা হচ্ছে না। দূষণের কারণেই প্রাণী এবং মাছ ধ্বংস হচ্ছে। লাখাই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম নদীর পাড়ে। এই গ্রামগুলোর মানুষ নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছে না।
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, হবিগঞ্জে সুশাসন না থাকাতে, পরিবেশগত মনিটরিং না থাকাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততায় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের অনাচারে এই এলাকার পরিবেশ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। হবিগঞ্জের ৫টি নদী সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন হয়ে গেছে শুধুমাত্র হবিগঞ্জের শিল্পায়নের জন্য। এই শিল্পায়ন এবং প্রবৃদ্ধি কার জন্য?
তিনি বলেন- এখন যদি মানুষই না থাকে, তাহলে ভোগ করবে কে? নদীর পানি কালো আলকাতরার মতো প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা দেখেছি ব্যাঙ মরে ভেসে রয়েছে। এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, এই পানি যদি পশুপাখি খায় তাহলে প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছে। এই পানি ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজকর্ম চলত, চাষাবাদ হচ্ছে না. প্রতিবছর এইখানে পুণ্যস্নান হত কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ এলাকার জনপ্রতিনিধিদের দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তা না হলে কিছুদিন পর এখানে চরম মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।