পুঁজিবাজারেও শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন
অস্থিতিশীল পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে ক্যাসিনোর মতো পুঁজিবাজারেও শুদ্ধি অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অনিয়ম ও লোপাট এবং কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বর্তমান কমিশন গত আট বছরে দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে সিএনএ টেক্সটাইল, ফ্যামিলি টেক্সটাইল, তুংহাই টেক্সটাইল, কাট্টালি টেক্সটাইল, অ্যাপোলো ইস্পাত, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এবং এমারেল্ড ওয়েলসহ ৮৯টি কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে। আইপিওর পাশাপাশি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজসহ বেশ কিছু কোম্পানিকে রাইট শেয়ার ইস্যু করে হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলনেরও অনুমোদন দিয়েছে। আর এ কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন। সঙ্গে রয়েছেন কমিশনার অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী ও স্বপন কুমার বালাসহ কয়েকজন।
তবে মূল দুর্নীতি ও অনিয়মের হোতা হচ্ছেন কয়েকটি ইস্যু ম্যানেজার ও অডিটর (মাহফেল হুদা অ্যান্ড আখতার, আহমেদ জাকির অ্যান্ড কোম্পানি, সিরাজ খান বাসেক অ্যান্ড কোম্পানি)। এ চক্রের হাত ধরে বিগত দুই-তিন বছর এসব কোম্পানির আইপিও বাজারে এসেছে। এসব কোম্পানির প্রসপেক্টাস ছিল ফেইক। মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন। যা খালি চোখেই ধরা পড়ে। গণমাধমেও এসব কোম্পানির মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি কমিশন।
এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ডিএসই ও সিএসইর বর্তমান ও সাবেক পরিচালক। রয়েছেন কিছু বিনিয়োগকারীও। তারা প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করছেন। তাই এসব ব্যক্তিকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগকারীদের নেতা মিজানুর রশিদ বার্তাটোয়েন্টফোর.কমকে বলেন, গত নয় বছরে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হয়নি। তার মূল কারণ দুর্নীতি ও অনিয়ম। এ অনিয়মের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএসইসি। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা প্লেসমেন্ট শেয়ার ও ঘুষের বিনিময়ে সিএনএ টেক্সটাইল ও কপারটেকের মতো প্রায় একশ’ কোম্পানিকে আইপিও এবং রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে লিস্টেড হয়ে প্রথম তিন বছর বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে। তারপর উদ্যোক্তা-প্লেসমেন্টধারীরা শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এখন এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কমিশন।
তিনি অভিযোগ করেন, এ প্রক্রিয়ায় বিএসইসির সঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), আইসিবি, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং বিভিন্ন ইস্যু ম্যানেজার জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অপসারণ করে সৎ, মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে মিজানুর রশিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) পুঁজিবাজারেও শুদ্ধি অভিযান চালান। কারণ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব যাদের হাতে দিয়েছেন, তারাই দুর্নীতি ও অনিয়ম করছেন। তারাই পুঁজিবাজারকে বিপর্যস্ত করেছেন, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, পুঁজিবাজার এখন চোরদের দখলে। যতদিন তাদের হাতে থাকবে, ততদিন বাজার ভালো হবে না। দ্রুত বিএসইসি পুনরায় গঠন করা দরকার। সেই সঙ্গে শুদ্ধি অভিযান জরুরি।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, মার্কেটে শোনা যাচ্ছে, ডিএসইর বর্তমান ও সাবেক কয়েক পরিচালক অনৈতিক প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অপরাধ থাকলে আমাকেও শাস্তি দেওয়া হোক। তারপরও পুঁজিবাজারে একটি শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি বর্তমান ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন। পুঁজিবাজারে কারসাজি, আইপিও এবং রাইট শেয়ার ইস্যুতে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবে মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে সূচক ওঠা-নামা কিংবা শেয়ারের দাম বাড়া-কমার কোনো সম্পর্ক নেই।
উল্লেখ্য, গত আট-নয় বছরে দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। পুঁজিবাজারে শতাধিক কোম্পানি এসেছে। কিন্তু পুঁজিবাজার উল্টো আচরণ করছে। যেখানে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসার কথা, সেখানে গত নয় বছরে আট লাখ বিনিয়োগকারী কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী।
অন্যদিকে প্রতিনিয়তই কমছে শেয়ারের দাম। আর তাতে বিনিয়োগকারীরা অন্তত ৬৫ হাজার কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছেন। বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হচ্ছেন। ব্রোকারেজ হাউজগুলো ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছে। বন্ধ হচ্ছে শাখা। ছাঁটাই হচ্ছে কর্মী।