শতবর্ষ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বিচারের দুই নিরিখে

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

শতবর্ষ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস সংগ্রামের, অগ্রগামিতার ও গৌরবের। কিন্তু কোনো ইতিহাসই সরল রেখায় এগোয় না, ছেদ-বিচ্ছেদ ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, এমনও ঘটনা ঘটেছে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি টিকতে পারবে কি না, তা নিয়েই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

আধুনিককালে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই হয়ত এতটা প্রতিবন্ধক হটিয়ে সামনে এগুতে হয়নি। আবার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে দায়িত্ব পালন করেছে, তাও অসামান্য! বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও গৌরবকে স্মরণ করার সময় ওইসব বাধা-বিঘ্ন ও দায়-দায়িত্বকে বিস্মৃত হলে চলবে না। সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইতিহাসের ভেতর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তার অগ্রগমন অব্যাহত রাখতে হয়েছে। প্রতিবন্ধকতা ভেতর থেকে তেমন আসেনি, যেমনটা এসেছে বাইরে থেকে। রাষ্ট্র বিরূপ ছিল, সমাজও যে অনুকূল ছিল তা নয়।

বিজ্ঞাপন

আপাত বিবেচনায় সমাজের পক্ষে বিরূপ হওয়ার কথা নয়। অবহেলিত, প্রান্তিক, অনগ্রসর বাংলা প্রদেশে দ্বিতীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তো সুখবরই হওয়ার কথা; কিন্তু সমাজের সকল মহল ঘটনাটিকে সেভাবে নেয় নি। এর কারণ সাম্প্রদায়িকতা। অগ্রসর হিন্দু সমাজের একাংশ মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিল। বস্তুত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনটি শুরুতে যেমন অভিন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ধারণ করেছে, পরবর্তীতে তেমনটা পারেনি; সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যে ‘বন্দে মাতরম’ রণধ্বনি হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণদেরকে উজ্জীবিত করেছিল, সেটাই বিভাজনের একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ধ্বনির অন্তর্গত হিন্দু মাতৃমূর্তির ধারণাটিকে মুসলিম সম্প্রদায় গ্রহণে অসম্মত হয়েছে এবং পরে, ১৯১১-র শেষে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হলো, তখনও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় হতাশ হয়েছে। কারণ, নতুন প্রদেশে তাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটবে, এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল বৈকি!

ওদিকে, ১৯০৬ সালে ঢাকাতেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়ে গেছে এবং ইংরেজ সরকার পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েম করে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর স্বার্থগত স্বপ্নের বিভাজনকে নতুন গভীরতায় নিয়ে গেছে। এরই পাশাপাশি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকারীদের শাস্তি দেওয়ার অভিলাষে ভারতবর্ষের রাজধানীকে কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়কে মোটেই সন্তুষ্ট করেনি।

বিজ্ঞাপন

এভাবে সব দিক থেকেই জাতীয়তাবাদী স্বদেশি আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গান্ধীজি এসে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন এবং যাতে তিনি খেলাফতপন্থীদেরকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন, সে-আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার দরুন বড় রকমের হতাশা দেখা দেয় এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়বার প্রচেষ্টাটি ভেঙে যাওয়ার ফলস্বরূপ হতাশার ও ব্যর্থতাবোধের ভেতর থেকে উল্টো সাম্প্রদায়িকতাই নতুন শক্তি অর্জন করতে পেরেছিল। বলাই বাহুল্য, ইংরেজরা এই বিরোধের বিকাশে সমানে উৎসাহ যোগাচ্ছিল।

এই রকমের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা এবং সেটা ঘটেছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের দাবির মুখে। তারা চাইছিলেন, বঙ্গভঙ্গ রদ করার ক্ষতিপূরণ (কমপেনসেশন) হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। ইংরেজরা তাতে সায় দিচ্ছে দেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের খুশি হওয়ার কথা নয়; সেটা তাঁরা হনওনি। তাদের মনে হয়েছিল, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিভাজন বৃদ্ধিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার নতুন এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক অভ্যন্তরীণ বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা চলবে।

রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিককার অধ্যাপকদের একজন এবং পরবর্তীতে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব পান। তিনি স্মরণ করেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজের একাংশের পক্ষ থেকে বেশ জোরালো আপত্তি উঠেছিল। তিনি লক্ষ করেছেন যে, “তাদের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল যে, এর ফলে রাজনৈতিক ভাগের পরিবর্তে বাংলাদেশকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে দুই ভাগ করা হবে।”১

একই কারণে কলকাতার হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের কয়েকজন খ্যাতিবান প্রতিনিধি বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাতিল করার দাবি জানিয়েছিলেন। আপত্তি উঠে ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকেও। পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ওই বিশ্ববিদ্যালয় চায়নি তার একক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য খণ্ডিত হোক। এই আপত্তির ভেতরও সাম্প্রদায়িকতার উপাদান যে ছিল না, তা নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল হিন্দু মধ্যবিত্তের অনেকটা একচ্ছত্র আধিপত্য। তাদের আপত্তিটাকে তাই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার সুযোগ ছিল বৈকি!

নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে ইংরেজদের যে আগ্রহ ছিল, তা মোটেই নয়। বাংলায় উচ্চশিক্ষার বিস্তারে তারা উদ্বিগ্নই ছিল। কারণ, তারা টের পাচ্ছিল যে, এর দরুন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে আর সেই সঙ্গে জেগে উঠছে তাদের অসন্তোষ। নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে ওই অসন্তোষকে আরও উৎসাহ দেবে, এমন অভিপ্রায় তাদের ছিল না।

তবে অসন্তুষ্ট মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবির মুখে ওই সম্প্রদায়কে কিছুটা ছাড় দেওয়ার ইচ্ছাতেই তারা সম্মত হয়েছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে। ছাড় (কনসেশন) শব্দটা তারা ব্যবহারও করেছে। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় যে মধ্যবিত্তের ভেতর হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে এগিয়ে নেবে, এমন আশাও তাদের ছিল বৈকি! বস্তুত, ওই আশাটি ছিল ইংরেজ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই অংশ।

জনসংখ্যার হিসাববিবরণী প্রস্তুতের (সেনসাসের) শুরুতেই তারা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে আলাদা করে দেখিয়েছে। ভারতের ইতিহাসকেও হিন্দু যুগ ও মুসলমান যুগ হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছে।

প্রথমদিকে, তাদের বিশেষ রকমের বিদ্বেষ ছিল মুসলমানদের প্রতি। কারণ, মুসলমান শাসকদের কাছ থেকেই তারা রাজ্যশাসন ছিনিয়ে নিয়েছিল। পরে ১৮৫৭-তে যে সিপাহী অভ্যুত্থান ঘটে, তাতে হিন্দু-মুসলিমের মারমুখী ঐক্য লক্ষ করে তারা একদিকে যেমন প্রমাদ গুণেছিল, অপরদিকে তেমনি তাতে নবগঠিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনুপস্থিতি দেখে কিছুটা সন্তুষ্টও হয়েছিল। তাদের শঙ্কা ছিল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে পরবর্তী অভ্যুত্থানটি হয়ত ফরাসী বিপ্লবের মতোই ভয়ঙ্কর ঘটনায় পরিণত হবে। মধ্যবিত্তকে তাই আলাদা করা চাই; মধ্যবিত্তের ক্ষোভ-বিক্ষোভের জন্য একটা প্রকাশমুখ খোলাও দরকার। এই বোধ থেকেই তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গঠনকে উৎসাহিত করে এবং পরবর্তীতে যখন দেখে যে, খুব একটা কাজ হচ্ছে না।

কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন নীতিতে মধ্যবিত্তের বিক্ষুব্ধ অংশ সন্তুষ্ট নয়, তখন তারা বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দান, পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভেদাত্মক চতুর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বঙ্গভূমিই যেহেতু ইংরেজবিরোধী তৎপরতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, বাংলাকে তাই ভাগ করা এবং পরে ভাগ যখন রদ করতে হলো, তখন শাস্তিস্বরূপ তো বটেই, আন্দোলনকে দুর্বল করবার অভিলাষেও রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে। আসাম ও বিহারকে বিচ্ছিন্ন করা হলো বাংলা প্রদেশ থেকে।

হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকে ওইসব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা হিসেবেই গণ্য করেছিলেন। তারা নিজেদের সম্প্রদায়গত স্বার্থকেই বড় করে দেখেছেন, সমগ্র বঙ্গের সামাজিক অগ্রগতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য ভূমিকাকে বিবেচনার ভেতর না নিয়ে।

রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপত্তির যে কারণটির কথা বলেছেন, সেটিকেই আরও পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সাবেক ছাত্রের লেখাতে।

রমেশ মজুমদারের লেখাটি আছে, আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি সংকলন গ্রন্থে। অপর লেখাটিও রয়েছে একই সংকলন। লেখক অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ বলছেন যে, ১৯১১-তে এসে বঙ্গভঙ্গকামী শাসকগোষ্ঠী পথ পরিবর্তন করেছে মাত্র, মত পরিবর্তন করেনি। “হিন্দু মুসলমান মিলন তাদের রাত্রির নিদ্রা হরণ করল। তাই তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কর্মসূচী তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। মন্দির ও মসজিদে পূজায় ও নামাজ আচরণে ও প্রকরণে এই দুই জাতি যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ইহা সঙ্কীর্ণতাবাদী, ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা আচ্ছন্নবুদ্ধি লোকদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রচারিত হতে লাগল।”২

এই লেখকের মতে, ওই কর্মসূচিরই একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। নিজের অজান্তেই হবে। অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ বলছেন যে, বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান এক জাতি নয়, দুটি পৃথক জাতি। শাসক ইংরেজেরও কিন্তু বড় একটা ভরসা ছিল সম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে চিহ্নিত করার ওপরই।

তবে বিভাজন বৃদ্ধির সন্দেহটা যে নীরব ছিল, তা নয়। কলকাতায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেভাবে বড়লাটের কাছে সশরীরে গিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ‘অন্যায়’ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন, অকুস্থল ঢাকাতে তা আরও সংগঠিত রূপ নিয়েছিল।

অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ জানাচ্ছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রতিবাদে ঢাকায় জনসভা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। সদরঘাটের করোনেশন পার্কের এক জনসভায় ঢাকা শহরের লব্ধপ্রতিষ্ঠত একজন আইনজীবী বলেন, “প্রারম্ভে এর আড়ম্বর ও জাঁকজমক দেখে মনে হলো এটা একটা Pucca University, কিছুদিনের মধ্যে মনে হলো এটা একটা Mecca University, তারপর বর্তমান উপলব্ধি এটা একটা ফাক্কা University”৩।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিহাস করে 'Mecca of the East' বলা হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিজের সাধনায় ও যোগ্যতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য প্রমাণ করেছে যে, এটি 'মক্কা' নয়, 'ফাক্কা'ও নয়, পাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে উঠেছিল।

তবে রাষ্ট্রের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির অনুপ্রেরণার উপলদ্ধিটিও যে মিথ্যা ছিল না, তার প্রমাণ শাসক আমলাদের উক্তিতেই পাওয়া যায়। কনসেশন বা কমপেনসেশন যাই বলা হোক না কেন, তাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত করা হচ্ছে এমন ভঙ্গিটা চাপা থাকেনি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়, ১৯২৩ সালে। ওই সমাবর্তনে বাংলার তখনকার গভর্নর লর্ড লিটন যে ভাষণ দেন, তাতে দুটি উক্তি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুটোই ছিল আশাবাদী। প্রথমটিতে তাঁর বক্তব্য:

I have already stated in public that in my opinion this University, is Dacca’s greatest possession. And will do more than anything else to increase and spread the fame of Dacca beyond the limit of Bengal or of India itself.৪ 

এটি তাঁর প্রথম আশাবাদ। তাঁর দ্বিতীয় আশাবাদটিতে কিন্তু কিছুটা প্ররোচনাও ছিল। এতে তিনি বললেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যা হতে পেরেছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তা হওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, আবাসিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেটা কিছুতেই হতে পারবে না। কিন্তু ঢাকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একটি সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যের কথাও তিনি বললেন-

Situated as it is in Eastern Bengal, Dacca will naturally become the centre of Mohammedan learning and devote special attention to higher Islamic studies.৫ -যেন কথিত সেই মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় হলেই তারা খুশি হতেন। লর্ড লিটনরা বাঙালিপ্রীতির জন্য খ্যাত ছিলেন না; বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়াতে এরা মোটে খুশি হননি, এবং সাম্প্রদায়িকতাকেই উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন।

লর্ড লিটনের প্রথম প্রত্যাশাটা অর্থাৎ ঢাকার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহত্তম সম্পত্তি হওয়া এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঢাকার খ্যাতি বৃদ্ধি করা ও সেই খ্যাতিকে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়াটা অনেকাংশেই পূরণ হয়েছিল; কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম শিক্ষার কেন্দ্র হবে, এই প্রত্যাশাটি মোটেই পূরণ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 'মক্কা' বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে একটি পাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়েছে। এখানে জ্ঞানের অনিয়ন্ত্রিত ও অব্যাহত চর্চা সম্ভব হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতা তো নয়ই বরং ধর্মনিরপেক্ষতারই একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গড়ে উঠেছে, যেটি বাইরেও যে প্রসারিত হয়নি এমন নয়। এর সব অনুশীলনেই দৃষ্টিটা ছিল 'ইহজাগতিক' এবং অঙ্গীকার ছিল 'ধর্মকে ব্যক্তিগত আচরণ ও বিশ্বাসের ব্যাপার' হিসেবে রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনাকে ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার।

এর কারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যিনি উপাচার্য হিসেবে এসেছিলেন তিনি পি জে হার্টগ ছিলেন একজন যথার্থ শিক্ষাব্রতী। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী বিভেদ নীতি প্রয়োগ করার ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি চেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি জ্ঞানচর্চার একটি আধুনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক। সে জন্য তিনি ভালো বেতন ও আবাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেছে বেছে মেধাবী শিক্ষকদেরকে সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি পরিষ্কারভাবে জানতেন যে, শিক্ষার মান নির্ভর করে উপযুক্ত শিক্ষকদের ওপরে। তাই, একেবারে প্রথম দিকেই এলেন সত্যেন বসু ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও হরিদাস ভট্টাচার্যের মতো পণ্ডিত, গবেষক ও আদ্যোপান্ত শিক্ষকেরা।

এই উপচার্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যোগ্য শিক্ষক সংগ্রহের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এসেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের কারোই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল না; কিন্তু তাঁরা উচ্চমানের শিক্ষক ও গবেষক ছিলেন। বিবেচনায় ডিগ্রিটা ছিল না, ছিল যোগ্যতাই। অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের কিন্তু তাঁরা মনে-প্রাণে শিক্ষকই ছিলেন, স্বীয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন না। এমনকী যে মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববঙ্গের মানুষদের ভাষা ব্যবহার নিয়ে কৌতুক করতেন বলে শোনা যায়, তিনিও ভাষার ওই ব্যাপারটাকে আঞ্চলিকতার টান হিসেবেই দেখেছেন, সাম্প্রদায়িক পশ্চাৎপদতা হিসেবে নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজে তখন সাম্প্রদায়িক বিরোধ ক্রমশ সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছিল। তার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনাতে যে অনুপ্রবেশ করেনি তা নয়। ১৯৪৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে নাজির আহমদ নামে একজন ছাত্র নিহত হয়েছেন ঘাতকদের ছুরিকাঘাতে; তিনি দাঙ্গা করতে যাননি, গিয়েছিলেন দাঙ্গা থামাতে। তবে মর্মান্তিক ও কলঙ্কজনক সেই হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং সেটি ঘটেছিল সেই সময়ে ভারতবর্ষের যখন সাম্প্রদায়িকতার অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবার দশা, রাজনীতি যখন অনিবার্যভাবে দেশভাগের দিকে এগুচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি-সচেতন ছিল কিন্তু সে-রাজনীতির মূল ধারাটি ছিল ব্রিটিশ বিরোধিতার। বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে মোট ৮শ ৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। তাদের মধ্যে মাত্র ১শ ৭৮ জন ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। হিন্দু সমাজের অগ্রসর ছাত্রদের রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল ব্রিটিশকে তাড়ানোর অঙ্গীকার। মুসলমান সম্প্রদায়ের সহপাঠীদেরকে শত্রু ভাববে এমনটা তাদের পক্ষে সম্ভবই ছিল না। তাদের শত্রু ছিল ইংরেজ। মুসলমান ছাত্রদের অধিকাংশই এসেছে গ্রাম থেকে, যাদের নির্ভরতা কৃষি উৎপাদনের ওপর। এই ছাত্ররা ব্রিটিশ বিরোধিতা অবশ্যই সমর্থন করেছে কিন্তু তাদের মূল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার এবং ছাত্রত্ব শেষ করে উপার্জনশীল হওয়ার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনুৎসাহী শাসকদের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বৃদ্ধির দুষ্ট বুদ্ধিটা যে অনুপস্থিত ছিল না, সেটা তো জানাই গেছে।

কিন্তু সেই অভিসন্ধি অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। মুসলমানদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, এই রকমের ঘোষণা সত্ত্বেও প্রথমদিকে মুসলমান শিক্ষার্থী কিন্তু প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যায়নি, আর্থ-সামাজিক কারণে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই এসেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। ১৯২১ সালে এই শ্রেণির মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধিতা বেশ সরব হয়ে উঠেছিল। একাংশ তো তখন রীতিমতো বিপ্লবী তৎপরতায় যুক্ত হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কম হয়নি, তবে এমনকী দাঙ্গারকালেও শহরের তরুণেরা গোপন অনুশীলন দলের অনুপ্রেরণায় ও শিক্ষায় সশস্ত্র পথে ইংরেজ উচ্ছেদের কাজে যোগ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিপ্লবীদের যোগ ছিল এবং শিক্ষার্থীদেরও কেউ কেউ যে ওই কর্মধারায় যুক্ত হয়ে পড়েনি, এমনও কিন্তু নয়!

অপরদিকে, মুসলমানদের ভেতরেও সমাজসচেতনতা দেখা দিয়েছিল। তার প্রমাণ মুসলিম হলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন। এই দলের লড়াইটা মূলত ছিল, নিজেদের সমাজের পশ্চাৎপদতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। হিন্দু সমাজকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলেও ভাবতে পারে কিন্তু মোটেই শত্রু ভাবেনি। যেটা উল্লেখ করেছি, শিক্ষকদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের কিন্তু শিক্ষার্থীদেরকে এঁরা শিক্ষার্থী হিসেবেই দেখতেন। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন যাঁরা, যেমন দর্শন বিভাগের হরিদাস ভট্টাচার্য এবং বাংলা বিভাগের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁরা বরঞ্চ অধিক পরিচিত ছিলেন নিজেদের অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য ভূমিকাটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর সমাজকে এগিয়ে যেতে সাহায্য প্রদান করা। শিক্ষা সব সময়েই সংস্কৃতি ও সামাজিকতার সঙ্গে যুক্ত; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলাতে দায়িত্বটা ছিল বিশেষ ধরনের। একে তো পূর্ববঙ্গের সমাজ ছিল পিছিয়ে-পড়া; তদুপরি উচ্চশিক্ষার জন্য এই অঞ্চলে এটিই ছিল প্রথম বড় ও একক প্রতিষ্ঠান। পূর্ববঙ্গের অগ্রগতি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য মাত্রাতে ঘটতো যদি হিন্দু ও মুসলিম সমাজ এক সঙ্গে চলতে পারতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপারগতার কারণে নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। দু’পা সমান তালে চলেনি; আর্থ-সামাজিক পার্থক্য অবশ্যই ছিল, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সে পার্থক্য যেভাবে বিরোধ ও সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। তাতে অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে বৈকি!

প্রথমে সমাবর্তনের ওই অনুষ্ঠানে রক্ষণশীল গভর্নর লর্ড লিটন আরও একটি সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “Let the University take a lead [...] and try to evolve the Dacca man-a type that shall be conspicuous both in learning and in politics”.৬

তাঁর এই আশাটা যে পূর্ণ হয়নি তা বলা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্বতার প্রমাণ দিতে পেরেছে বৈকি! শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন তেমনি রাজনীতিতেও। কিন্তু শিক্ষার্থীদের রাজনীতিটা লর্ড লিটন যে ধারায় এগুবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন, সেই রাস্তা ধরে এগোয়নি। তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পারদর্শিতা প্রদান করেনি; তদুপরি, ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুষ্ট করেছে। ওদিকে লিটন যে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তা নয়, পুলিশ বাহিনীর বার্ষিক অধিবেশনে তিনি ভারতীয় নারীদের সম্পর্কে একটি অসম্মানজনক মন্তব্য করেছিলেন; যার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা হলের ছাত্ররা বার্ষিক সমাবর্তনে তাঁর হাত থেকে ডিগ্রির সনদ নিতে অসম্মতি জানায় এবং সমাবর্তন বর্জন করে।৭

সম্মিলিত Dacca Man তৈরির সম্ভাবনা বরং সেদিনের ওই প্রতিবাদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল! যেমন দেখা দিয়েছিল হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে বরণ করে নিয়েছিল, সে-ঘটনার মধ্যেও। নজরুল এসেছিলেন মুসলিম হলে অনুষ্ঠেয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলের বসবাসকারীদের সকলেই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। সেই হলেও তাঁর ডাক পড়েছিল। উদ্যোগটা নিয়েছিল ঢাকা হলের ছাত্রসংসদ। উৎসাহ জুগিয়েছিলেন হলের প্রভোস্ট বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। পরিকল্পনাটি ছিল হলের মিলনায়তনে একটি গানের আসর বসবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ধীরেন্দ্রলাল দাশ। তাঁর বিবরণে ওই অনুষ্ঠানে সেদিন যা ঘটেছিল তা এই রকমের-

Lytton হলে আসর বসল, তিল ধারণের ঠাঁই নাই। বাংলা গজল গানের পর শুরু হলো অগ্নিস্রাবী দেশাত্মবোধক গানের পালা, মুখবন্ধ অবশ্যই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি। একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছেন, তাঁর উচ্চারিত আবেগে সমগ্র সভা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ‘শেকল পরা ছল মোদের শেকল পরা ছল’, এই গানটা ক্ষণিকের জন্য এমন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল, মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তেই সব ছেড়ে ছুড়ে বেরিয়ে পড়ি। অত্যাচারী শাসকদের শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেই।৮

অসাম্প্রদায়িকতার ওই বোধের প্রকাশের ভিন্নতর ও পরিপূরক ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত কর্মকর্তা সুবোধ রায় জানাচ্ছেন-

একবার ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে কার্জন হলে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। আমরা একদল ছাত্রছাত্রী প্রত্যক্ষভাবে তার বিরোধিতা করি। বিরোধিতার কারণ জানিয়ে আমরা অনুষ্ঠানে ছাপানো ইস্তেহার প্রচার করি।৯

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তখন হিন্দু মহাসভার সভাপতি। কিন্তু তার সম্বর্ধনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে নয়, ঢাকা হল থেকেই যে এসেছিল সেটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ধারাটা সামনে এগুতে পারছে না, হিন্দু মহাসভা এসে প্রতিবন্ধক তৈরী করছে, এটি বাংলা ও বাঙালীর জন্য ছিল এক অভিশাপ, যার পরিণতি ঘটেছে ১৯৪৭-এর মর্মান্তিক দেশভাগে। হিন্দু মুসলিমদের ঐক্য গড়ায় সচেষ্ট সুভাষ বসু কিন্তু তখন অত্যন্ত জনপ্রিয়, তাঁর সমর্থকরা ঢাকা শহরে ছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও।

দেশভাগ যে কতটা ক্ষতিকর হয়েছিল, তার আলোচনা আমরা অন্যত্র পাই, পাই উপরোল্লিখিত আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্কলনটিতেও। ১৯৪৭-এ প্রথম দিককার শিক্ষকদের কারো কারো অবসর গ্রহণের সময় ঘনিয়ে এসেছিল; কেউ কেউ আগেই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশভাগ বাংলাকে ভিন্ন ভিন্ন দু’টি রাষ্ট্রের অংশ করে দিল। সীমান্তে পাহারা বসলো, এলো পাসপোর্ট ও ভিসা; দুই রাষ্ট্রের ভেতর যাতায়াতই যে শুধু কঠিন হয়ে পড়ল তাই নয়, পারস্পরিক বৈরিতাও দেখা গেল। শিক্ষকরা চলে যেতে শুরু করলেন। ছাত্রছাত্রীদেরও বড় একটা অংশ দেশত্যাগ করলো। বিশ্ববিদ্যালয় আর আগের মতো রইলো না। ঢাকা ছেড়ে যাঁরা চলে গিয়েছিলেন তাঁদের সকলের স্মৃতিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত জীবন্ত; কিন্তু সে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের জন্য ক্রমশ স্মৃতির বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। দু’য়েকজন এমন কথাও বলেছেন যে সাতচল্লিশে তাঁদের প্রিয় ও চেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু ঘটেছে; পরের বিশ্ববিদ্যালয় অন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আগেরটি নয়।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে এগুচ্ছিল সেভাবে এগুতে পারেনি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ছেদ ঘটেছে, ঐতিহ্যের সঠিক সম্প্রসারণ ঘটেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা পেশায় এবং বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন; গৌরব অর্জন করেছেন। নিজেদের জন্য তো অবশ্যই, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এবং দেশের জন্যও। শিক্ষক, আইনজীবী, বিজ্ঞানী, রাজনীতিক, গবেষক হিসেবে তাঁরা পূর্ববঙ্গে তো অবশ্যই। পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের নানা প্রদেশে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদী মহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করতে না-পারার মনোভাবটা রয়েই গেছে। দৃষ্টান্ত দেয়া যাক।

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে কে না চেনেন এবং অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ ছিলেন অমিয় দাশগুপ্তও। প্রফেসর দাশগুপ্ত এক সময়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান। শেষ জীবনটা তাঁর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তাঁকে চিনতে চায়নি। উপেক্ষাই করেছে। অমিয় দাশগুপ্তের প্রতিভাবান ছাত্রদের একজন ছিলেন অশোক মিত্র, একসময়ে যিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শাসনামলে দীর্ঘকাল অত্যন্ত সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন-

একজন দু’জন পণ্ডিতপ্রবর এমনও দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজই বাংলা, বাংলাই প্রেসিডেন্সি কলেজ। ইত্যকার দাবী আসলে একধরনের কূপমণ্ডুকতা, পৃথিবীকে জানবার চেনবার বোঝবার জন্মগত অক্ষমতা। মাত্র ক’দিন আগে এক বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় বিভাগে ‘মানুষ গড়বার কারিগর’ শিরোনামে এক মস্ত প্রবন্ধ ফাঁদা হয়েছিল। [...] শিক্ষকদের তালিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় অনুল্লেখিত, অনুচ্চারিত অমিয় দাশগুপ্ত মশাইয়ের নামও। সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন; তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্ফূরণ ও বিকিরণ ঢাকাতেই। ১৯৪৫ সালের পরে অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বছর পাঁচ-ছয়ের জন্য, তারপর শান্তিনিকেতনে, জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে বৃত হওয়া, রাজ্যসভার সদস্য হওয়া। কিন্তু হলে কী হয়, সেই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একবার জাত খুঁইয়েছিলেন, তা আর পুনর্জয় করতে পারলেন না। কলকাতার বিজ্ঞজনের কাছে তাঁর স্থান মেঘনাদ সাহার অনেকটাই নীচে।

অশোক মিত্র আরও লক্ষ্য করেছেন যে, “অমিয় দাশগুপ্তের ললাটলিখন [...] শোকাবহ। পশ্চিম বাংলায় ক্বচিৎ-কদাচিৎ একজন দু’জন পণ্ডিত মানুষ ব্যতিরেকে বিশেষ কেউই তাঁর নাম উচ্চারণ করেন না। এমনকি শান্তিনিকেতনে, যেখানে তিনি জীবনের শেষ বারো-চৌদ্দ বছর কাটিয়েছেন এবং সেখানে থাকাকালীনই নিভৃতে নিজের মতো করে অন্তত তিনটি তত্ত্বভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, সে-সব গ্রন্থ বিদেশে প্রকাশিত ও সংবর্ধিত হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নিথর ডোবায় তাঁর কোনো অনুকম্পন অনুভূত হয়নি।” অশোক মিত্র মনে করেন, “তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ অর্থনীতির শিক্ষক আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন নি।”১০

পশ্চিমবঙ্গে-পূর্ববঙ্গে ব্যবধান, ঘটিতে-বাঙ্গালে দ্বন্দ্ব, অবস্থানগত কারণে পূর্বের ব্যাপারে পশ্চিমের উন্নাসিকতা, এসব অবশ্য পুরনো ইতিহাস, তবে সাতচল্লিশ এসে সেই পার্থক্যটাকে আরও গভীর ও অনতিক্রম্য করে দিয়েছিল।


ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্যের প্রবহমানতা অচ্ছেদ্য রূপে বজায় রাখা সম্ভব না হলেও, সমাজ ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ধারাবাহিকতায় কিন্তু বিরাম ঘটেনি। প্রতিষ্ঠার সময়ে ঢাকা ও কলকাতা উভয় শহর থেকেই স্বার্থবাদীদের বিরোধিতা যেমন এসেছে, যাত্রা শুরুর পরেও তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈরিতার মোকাবিলা করেই এগুতে হয়েছে।

সমাজে দারিদ্র্য ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দানের ব্যাপারে পারিবারিক সামর্থ্যের অভাব দেখা গেছে, আবার কুসংস্কার-ব্যবসায়ীদের তৎপরতাও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে শিক্ষাদানের ব্যবস্থাটা তাও করা গিয়েছিল, কিন্তু ছেলেমেয়েদের মেলামেশার ব্যাপার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা কাজ করতো। আবাসিক হলগুলোতে সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাট্যাভিনয়। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যে এক সঙ্গে অভিনয় করবে এই ব্যবস্থা চালু হতে বহুদিন লেগেছে। ছেলেরাই মেয়ে সাজতো, আবার মেয়েরা যদি নিজেদের আবাসে নাটক মঞ্চস্থ করতো তবে মেয়েদেরকেই দায়িত্ব নিতে হতো পুরুষের ভূমিকায় অভিনয়ের। একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

এটি ১৯২৯ সালের ঘটনা। জগন্নাথ হল ছাত্রসংসদ একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করে, তার একটি অংশ ছিল এরকমের যে, ৮/১০ বছরের একটি মেয়ে কিছুটা সাজগোজ করে মঞ্চে উঠে হাতপা নেড়ে নৃত্যের ভঙ্গি করবে, পেছন থেকে তার বোন হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। অনুষ্ঠানসূচির খসড়াতে ড্যান্স কথাটার উল্লেখ ছিল, প্রভোস্ট রমেশচন্দ্র মজুমদার সেটিকে কেটে ‘অ্যাকশ সঙ’ করে দেন। তাতেও কিন্তু রেহাই মেলেনি। অনুষ্ঠানের পরের দিনই সাপ্তাহিক 'চাবুক' পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে খবর ছেপেছিল, “জগন্নাথ হলে আবার মেয়ে নাচিল।”১১

সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেয়েছে, সংঘর্ষ বেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ঢুকে পড়তে চেয়েছে; শহরে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়েছে; কলেরা ও বসন্ত যখন রূপ নিয়েছে, মহামারির বিপন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছুটি ঘোষণা করেছে, বাধ্য হয়ে।

তবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপই ছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর। স্বভাবগতভাবেই রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দ করে না। রাষ্ট্র চায় আনুগত্য, বিশ্ববিদ্যালয় চায় মুক্তি। দুয়ের ভেতর বিরোধ তাই অনিবার্য। এটা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে, বিশেষভাবে ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের জন্য তো অবশ্যই, শিক্ষকদের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মায়ের মতো; যেন দ্বিতীয় মাতা! পালনকারী মাতা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পালক মাতার লালন-পালন-কর্তব্য যথাযথই পালন করেছে, যদিও এই মাতার ওপর দিয়ে বহুধরনের ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে। রাষ্ট্র কিন্তু চরিত্রগতভাবেই পিতৃতান্ত্রিক, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষকে যেসকল রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল অসংশোধনীয় রূপেই পিতৃতান্ত্রিক। কর্তৃত্ব করেছে, আনুগত্য চেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সামাজিক প্রয়োজনে; রাষ্ট্র উৎসাহী ছিল না। তারপরেও দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। রাষ্ট্র ওই দুটি যুদ্ধে সরাসরি জড়িত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দরুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বিলম্বিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যে মন্বন্তর ঘটে, তাতে বাংলার ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এদের বেশীর ভাগই ছিল পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। মন্বন্তর যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রভাব বলয়ের বাইরে ছিল না। যুদ্ধের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে দেবার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উৎসাহের কোনো অপ্রতুলতা ঘটেনি। কিন্তু আরও যা দুঃখজনক তা হলো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ।

রাষ্ট্র নামে, আয়তনে এবং বাইরের চেহারাতে বদলেছে; ব্রিটিশ ভারতীয় রাষ্ট্রের জায়গাতে এসেছে পাকিস্তানি রাষ্ট্র কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তর্গত যে স্বভাব-চরিত্র, সেটা এক রকমেরই রয়ে গিয়েছে। বরঞ্চ আগেরটির তুলনায় পরেরটি আরও অধিক কর্তৃত্বপরায়ণ রূপ ধারণ করেছে। প্রথম সমাবর্তনে প্রাদেশিক গভর্নর লর্ড লিটন ঢাকাকে যে মুসলমানদের জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়বার এবং ঢাকার নতুন সাম্প্রদায়িক মানুষের সৃষ্টির কথা বলেছিলেন, সেটা যে কেবল তাঁর ব্যক্তিগত মত ছিল, তেমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। ওটি ছিল রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়েরই অভিব্যক্তি। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখার জন্য ১৯১২ সালে যে নাথান কমিটি গঠন করা হয়, তাদেরও সুপারিশ ছিল ইসলামী শিক্ষার ওপর গুরুত্বদানের।১২

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ হ্রাস করে দেবার ঘটনাটিও মোটেই অরাজনৈতিক ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয় যে কতটা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন ছিল, সেটা টের পাওয়া পদাধিকার বলে যে গভর্নররা চ্যান্সেলার হতেন, তাঁদেরকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেবার হিড়িক দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর লর্ড রোনাল্ডশকে ডক্টরেট দেওয়া হয়, ১৯২২ সালেই। পরবর্তীতে ওই একই সম্মানে ভূষিত হন লর্ড বুলওয়ার লিটন, স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন এবং স্যার জন এ্যান্ডারসন। যে বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশ চন্দ্র বসু, মুহম্মদ ইকবাল, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক বিজ্ঞানীকে ডক্টরেট দেয়, সেই একই বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রদেশের গভর্নরদেরকে, তাঁরা শাসনকর্তা এই বিবেচনায় একই সম্মানে ভূষিত করে, তখন সম্মাননার গৌরবে টান পড়ে তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের আবদ্ধ দশাটাও ধরা পড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যিনি উপাচার্য, ফিলিপ হার্টগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়েছেন, কিন্তু তাঁকে এবং তাঁর পরবর্তী উপাচার্যদেরকে মেনে নিতে হয়েছিল ওই ব্যবস্থা, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় তার চ্যান্সেলরদেরকে, তাঁরা প্রদেশের শাসনকর্তা এই বিবেচনাতেই সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিতো হতো।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১৯১২ সালে ন্যাথান কমিটি সুপারিশ করেছিল যে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চলবে যেমন সরকারি অর্থায়নে, তেমনি সরকারি নিয়ন্ত্রণে। বস্তুত কমিটি এটিকে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল। দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল ঔপনিবেশিক। কিন্তু ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়।

রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বদলে বিশ্ববিদ্যালয়কে যতটা সম্ভব স্বায়ত্তশাসন দেবার সুপারিশ এই কমিশনের রিপোর্টে ছিল। ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে আইনটি পাস করা হয়, সরকার সেটিতে নাথান কমিটির নয় বরং স্যাডলার কমিশনের প্রস্তাবই গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, নাথান কমিটির প্রধান রবার্ট ন্যাথান ছিলেন একজন ব্যারিস্টার। বোঝা যায়, তিনি আর যাই হোন না কেন, উদারনীতিক ছিলেন না। আর স্যাডলার কমিশনের প্রধান মাইকেল আর্নেস্ট স্যাডলার ছিলেন একজন সাবেক উপাচার্য, ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের; বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়।

স্যাডলার কমিশনের বক্তব্যটি ছিল এই রকমের যে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় autonomous হবে, যদিও তার অর্থ এই নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দায়িত্বজ্ঞান থাকবে না এবং সে রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক পরিমণ্ডলের বাইরে থাকবে। তবে, “They stated that without a certain degree of freedom, we do not think that the University of Dacca can even become a living and healthy organisation.”13.”১৩ কমিশন শিক্ষাকেই গুরুত্ব দিয়েছে, অনেকটা যেন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে।

১৯২০-এর এই আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোর্ট’কে দেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণ ক্ষমতা। পরবর্তীতে এই কোর্টকেই সিনেট বলা হয়েছে। প্রথম কোর্টে সদস্য ছিলেন ১শ ৫৮ জন। এঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার তো ছিলেনই, ছিলেন প্রফেসর ও রিডাররাও (পরবর্তীতে এঁদেরকে বলা হয়েছে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর)। শিক্ষকদের সংখ্যা ছিল ৩০ জন। পদাধিকার বলে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও সদস্য হয়েছিলেন। চ্যান্সেলর মনোনয়ন দিয়েছিলেন ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। ৫ জন ছিলেন শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। ব্যবস্থা ছিল রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদেরকে যুক্ত করবার; এঁরা নির্বাচন করেছিলেন তাঁদের ২৯ জন প্রতিনিধির; ১৫ জন অমুসলমান, ১৪ জন মুসলমান।

কোর্টের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করায় দায়িত্ব ছিল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের (পরবর্তী নাম সিন্ডিকেট)। দেখা যাচ্ছে, কেবল স্বায়ত্তশাসন নয়, সীমিত আকারে যদিও তথাপি সমাজকেও যুক্ত করার অভিপ্রায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই আইনে। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের পেছনে শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা যুক্ত করার পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিটা কাজ করে থাকবে। ভারতীয়দের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ছিল। তার দরুন উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের ভেতর অধিকার-চেতনা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বঙ্গভঙ্গ রদে মুসলমানদের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে কিছুটা শান্ত করবার ইচ্ছাটা থেকেই তো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে। বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ছিল একটি রাজনৈতিক ঘটনা; আর প্রতিষ্ঠাকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মেজাজের প্রতিফলন তার আইনে ঘটবে এটাই ছিল স্বাভাবিক।

তবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তো ছিলই। অর্থায়ন ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রীয়; উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, এঁরা সরকারের দ্বারাই নিয়োগ পেতেন। বার্ষিক সমাবর্তনে এসে চ্যান্সেলররা শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক অর্থাৎ অনুগত মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার পরামর্শ দিতে ভুলতেন না।

১৯৪৭-এ ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও দেশভাগের ফলে পাকিস্তান নামে যে নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটলো, তাতে অনেক কিছুই বদলে যাবার কথা; বিশ্ববিদ্যালয়ও বদলালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স তখন ২৬ বছরে পড়েছে, সে তার নিজস্বতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এবং নিজের পথেই এগুচ্ছে; এরই মধ্যে ঘটে গেল রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন। শুরু থেকেই ছাত্রদের শতকরা আশি ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের, শিক্ষকদের ভেতর অতিঅল্প কয়েকজন বাদ দিয়ে সবাই ছিলেন অমুসলিম। পাকিস্তান হওয়াতে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষকরা চলে যেতে শুরু করলেন। শিক্ষকদের কেউ ততদিনে অবসরেও চলে গেছেন; এঁরাও ছিলেন অমুসলিম। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের যে শিক্ষকরা গিয়েছিলেন, তাঁরাও আর ঢাকা ফেরত এলেন না। অমুসলিম ছাত্রদেরও ব্যাপক দেশত্যাগ ঘটলো। ফলে অনেকের কাছেই রাষ্ট্রের মতো বিশ্ববিদ্যালয়কেও নতুন ও অপরিচিত ঠেকলো, যে কথাটা ঢাকা-ছেড়ে-যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বলেছেন তাঁদের স্মৃতিকথায়।


শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানগুলোর একটি হচ্ছে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'। বাইরে যখন প্রবল সাম্প্রদায়িক হানাহানি চলছে এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ভাগ হওয়ার দিকে, এই বিশ্ববিদ্যালয় তখন কেবল যে সাম্প্রদায়িক হতে অস্বীকার করেছে, তাইই নয়, হয়ে উঠেছে 'ধর্মনিরপেক্ষ'ই। ধর্মনিরপেক্ষতার যে দুটি গুণ-ইহজাগতিকতা ও রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিচ্ছিন্নতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই দু’টিকে লালন করেছে।

শিক্ষকরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আর রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে বাড়িয়ে দেওয়ার আগ্রহ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ওই পথে এগোয়নি। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষাদান ও জ্ঞানসৃষ্টির কাজটা তো চলছিলই আরও যা ঘটছিল, তা হলো- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি। প্রথম সমাবর্তনে লর্ড লিটন যে বিশ্ববিদ্যালয়টি ইসলামী শিক্ষা চর্চার কেন্দ্র হবে বলে যে আশা প্রকাশ করেছিলেন, সে আশা মোটেই পূরণ হয়নি।

তবে ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার আসল কারণ হচ্ছে, ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে শিক্ষক এবং ছাত্রদের ভেতর সম্প্রীতি এবং ইহজাগতিক জ্ঞানের চর্চা। হ্যাঁ, মুসলিম ছাত্ররা ইসলামী বিদ্যা ও আরবি বিভাগেই বেশি সংখ্যায় গেছে বটে, তবে সেটা শুরুতে যতটা সত্য ছিল, পরবর্তীতে ততটা থাকেনি। নতুন যে ‘ঢাকার মানুষ’ (Dacca Man) তৈরি হবে বলে লর্ড লিটন আশা করেছিলেন, সেই ব্যক্তি যদি গড়ে উঠে থাকে তবে তার পরিচয় মোটেই সাম্প্রদায়িক ছিল না, ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। ঢাকা শহর তখন নানা ধরনের সংক্রামক রোগের জন্য খ্যাতি অর্জন করছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও কম ঘটেনি। সহিংসতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেও আছড়ে পড়েছে বৈক! তবে সাময়িক বিচ্যুতি সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ গৌরবের দাবি এর মূল ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্রদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে তো বটেই এমনকি পূজা দেখতেও মুসলমান ছাত্ররা যেতো। ঠিক একইভাবে মুসলিম হলের অনুষ্ঠানেও হিন্দু শিক্ষক ও ছাত্ররা নিমন্ত্রিত হতেন এবং যোগদান করতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ঢাকায় আসেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল ঠিক সেরকমটাই ঘটেছিল মুসলিম হলে তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও। নজরুল এসেছিলেন ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের আমন্ত্রণে কিন্তু তাঁকে আপনজন হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী।

'৪৭-এ নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলো। বলা হলো, এ রাষ্ট্র স্বাধীন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কি স্বাধীনতা পেলো! না, পেলো না। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। আমরা লক্ষ করেছি, ব্রিটিশ আমলে একের পর এক প্রাদেশিক গভর্নরদের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে। একই রকমের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও।

১৯৪৯ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনকে ওই সম্মাননা দেওয়া হয়। কারণ, তখন তিনি পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (যদিও তিনি বাঙালির স্বার্থ দেখতেন না, দেখতেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ)।

১৯৫৬-তে ডক্টরেট দেওয়া হয়, ইস্কান্দার মির্জাকে, যিনি তখন গভর্নর জেনারেল এবং এর আগেই যিনি গভর্নর হয়ে এসেছিলেন যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে নাকচ করে দেবার অভিসন্ধির অংশীদার হিসেবে। তিনিও ছিলেন বেশ ভালো রকমের বাঙালি-বিদ্বেষী।

১৯৬০ সালে ডক্টরেট পান জেনারেল আইয়ুব খান। তখন তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। আর ঠিক পরের বছরেই তিনি একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে ব্রিটিশ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে স্বায়ত্তশাসনটুকু দেওয়া হয়েছিল, সেটুকু পুরোপুরি হরণ করে নেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, নাথান কমিটি যে বলেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তার চেয়েও অধিক অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আগাপাশতলা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবার। আইয়ুব খানের ওই অর্ডিন্যান্সকে কালা-কানুন বলে অভিহিত করা হতো এবং '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় উত্থাপিত ছাত্রদের ১১ দফার ১ নম্বর দফাতেই ওটিকে বাতিল করার দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বাতিলের ওই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তদানীন্তন ইতিহাসের প্রথমবারের মতো রাজপথে মিছিল পর্যন্ত করেছেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ওই কালা-কানুন যে আরও কিছুকাল বলবৎ থাকতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আইয়ুব খান ও তাঁর সামরিক আমলাতন্ত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শত্রুপক্ষ বলেই মনে করতো। শহর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে একে রাজনীতিমুক্ত করা যায় কি না, সে চিন্তা তাদের ছিল। সামরিক শাসন জারির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে আসেন বিচারপতি হামুদুর রহমান। তিনি তার প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতাতে কথাটা আনুষ্ঠানিকভাবেই উত্থাপন করেন: “We have been driven to the conclusion that perhaps it would be better to shift the university to more congenial circumstanees in the outskirts of the city [...]”১৪

এই বক্তব্যে তিনি রাষ্ট্রীয় চিন্তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। কাজটি সম্পন্ন করতে তারা পারেননি। কারণ, এমনকী সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরাও এতে সম্মত হননি এবং স্থানান্তরকরণের জন্য যে বিপুল অর্থ বরাদ্দ দরকার ছিল সরকার তা দিতে সম্মতও ছিল না। তবে পরে যখন চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আবশ্যকতা দেখা দিলো, তখন সেটিকে শহরে না রেখে শহর থেকে অনেক দূরে প্রায়-দুর্গম একটি এলাকাতে স্থাপন করা হয়। ওদিকে আইয়ুব শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত ঘটানো চলছিলই। গভর্নর মোনায়েম খান তো ছাত্রদের একটি বাহিনীই তৈরি করেছিলেন যার সদস্যরা বহুবিধ দুষ্কর্মের উদ্যোক্তা ও নায়ক ছিল।

তারা অর্থনীতি বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক আবু মাহমুদকে ক্যাম্পাসের ভেতরেই এমনভাবে আক্রমণ করেছিল যে, তাঁর প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিল। এর কারণ সরকার-অনুগত উপাচার্যের একটি অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। শরণাপন্ন হয়েছিলেন হাইকোর্টের এবং হাইকোর্টের রায় তাঁর পক্ষে গিয়েছিল। স্বৈরশাসনের প্রবলতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক শাসনবিরোধী প্রবল ক্ষোভ গড়ে ওঠে, যার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৬৪ সালের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।

ছাত্রবিক্ষোভের দরুন সেটি পণ্ড হয়ে যায়। এরপরে শুরু হয়, দমনপীড়ন। আইয়ুব শাসনামলে থেকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হতো, রাষ্ট্রীয় অসুবিধার কারণে। আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তার সূত্রপাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ঘটায় এবং '৬৯ সালের যে গণঅভ্যুত্থানে ওই শাসনের পতন ঘটে, তাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তো সর্বজনবিদিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চরম আঘাতটাও আসে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বেই। আইয়ুবের লোকেরা চেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থানান্তরিত করবে। আইয়ুবের পরবর্তী সামরিক শাসক, তারই বশংবদ ও সকল তুলনাতেই নিকৃষ্টতর। ইয়াহিয়া খানের নিয়োজিত সৈন্যরা ঠিক করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়কে পারলে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, নইলে অন্তত একটি কঙ্কালে পরিণত করে ছাড়বে।

ঔপনিবেশিক শাসকেরা যেটিকে স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিল, ছদ্ম-ঔপনিবেশিক শাসকরা তাকে সহ্য করতে পারেনি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রশাসনের কাছে নত হতে সম্মত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা তাঁদের নিজেদের ও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পক্ষে এবং শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। একাত্তরে যুদ্ধটা প্রকৃত অর্থে ছিল একটি গণহত্যা এবং এই গণহত্যার শুরু করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।

২৫ শে মার্চের রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের যাকে হাতের কাছে পেয়েছে, হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকেই নির্বিচারে হত্যা করেছে। আবার যখন সময় এসেছে তাদের আত্মসমর্পণের তখন তারা বেছে বেছে প্রগতিশীল ও মেধাবী শিক্ষকদের কয়েকজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়ার শাসনে-উৎফুল্ল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুচরদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনীর লোকেরা চেয়েছিল গণহত্যার সুযোগকে ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি তথাকথিত ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করতে। লর্ড লিটনের চাইতেও বড় লর্ড ছিল এই পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা।

নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রথম সমাবর্তনে ‘জাতির পিতা’ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে বক্তৃতাটি দেন, তাতেই বোঝা গিয়েছিল নতুন শাসকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে দেখতে চান। গভর্নর জেনারেল হিসেবে সেটাই তাঁর প্রথম ও শেষ ঢাকা সফর। রেসকোর্স ময়দানের গণসংবর্ধনাতে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ঊর্দু এবং কেবল মাত্র ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। দু’দিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে তিনি ওই একই ঘোষণা দ্বিতীয়বার দিলেন।

ঊর্দুর পক্ষে তার যুক্তি ছিল ঊর্দু ভাষা “has been nurtured by a hundred million Muslims” এবং এই ভাষা “embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition”১৪।

ঊর্দু তাঁর নিজের মাতৃভাষা নয়। বস্তুত ঊর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের শতকরা ৫ জনেরও মাতৃভাষা ছিল না কিন্তু তবু ঊর্দুকে তিনি যে কেবল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন তার কারণটা মোটেই অস্পষ্ট ছিল না।

পাকিস্তান ছিল একটি অস্বাভাবিক ও অবাস্তবিক রাষ্ট্র। এর দুই অংশ ছিল শত্রুভাবাপন্ন ভারতের ১২০০ মাইল ভূমির দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং দুই অংশের ভেতর সাংস্কৃতিক মিল ছিল না বললেই চলে। দুই পাকিস্তানকে তিনি ঐক্যবদ্ধ রাখবেন কীভাবে! ধর্ম দিয়ে যে কুলাবে না, সেটা তিনি জানতেন। আচার-আচরণে, এমনকী বিশ্বাসেও নিজে তিনি ধর্মনিরপেক্ষই ছিলেন; ধর্মকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন রাজনৈতিক কারণে এবং রাজনৈতিকভাবে।

ভারতে বিপুলসংখ্যক মুসলমানকে তিনি রেখে এসেছেন এবং শরণার্থী হিসেবে যে-মুসলমানরা পাকিস্তানে এসেছে এবং যে অমুসলিমরা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে, তাদের দুর্দশা তিনি সচোখে দেখেছেন এবং মর্মাহত যে হননি তাও নয়। ধর্ম দিয়ে পাকিস্তানকে এক রাখার অন্তরায়ও ছিল। প্রথমত, পাকিস্তানি অমুসলিম মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। দ্বিতীয়ত, ধর্মাচারের ব্যাপারে এমনকী পাকিস্তানের দুই অংশের মুসলমানদের মধ্যেও বিস্তর পার্থক্য ছিল। তৃতীয়ত, পাকিস্তানে ছিল অন্তত পাঁচটি ভাষার মানুষের বসবাস। তিনি তাই মনে করেছিলেন যে, একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করে ‘ঐক্য’ ধরে রাখতে হবে। কেবল ঐক্য ধরে রাখা নয়, তিনি আশা করছিলেন যে, পাকিস্তানে নতুন একটা জাতিই তৈরি হবে এবং সেই জাতিগঠনের জন্য ঊর্দু উপযোগী।

বলা বাহুল্য, জিন্নাহর ওই ঘোষণাই পাকিস্তানের জন্য পতনের সূচনাটি সরবরাহ করলো। পাকিস্তানে বাঙালির সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৬ জন। পাকিস্তান যে এসেছে সেটাও বাঙালি মুসলমানদের ভোটের কারণেই অথচ রাষ্ট্রেরপ্রধান রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে যে ধারণা দিলেন, তার তাৎপর্য হলো এই যে, পাকিস্তানে বাঙালিদের চিরকাল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বসবাস করতে হবে। রেসকোর্সের ঘোষণার সময়েও মৃদু প্রতিবাদ উঠেছিল তবে সেটা জনসমুদ্রে হারিয়েই যায় কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সীমিতসংখ্যক শ্রোতাদের মধ্য থেকে যে প্রতিবাদটি উঠলো, সেটি প্রবল না হলেও অকর্ণগোচর থাকেনি। ছাত্রদের একাংশ ধ্বনি তুলেছিল 'হড় হড়' বলে।

ঊর্দুভাষী উপাচার্য মাহমুদ হাসান জিন্নাহকে কায়েদে আজম তো বটেই 'আমীর-ই-পাকিস্তান' বলে সম্বোধন করেছিলেন এবং পাকিস্তান যে একটি truly Islamic state হবে, এই বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করতে ভোলেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার যে 'ধর্মনিরপেক্ষ' ধারাটি গড়ে তুলেছিল, সেটিকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়ে তিনি বললেন, শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হবে ইসলামের মূলনীতি। তাঁর ভাষায়-

Basing our educational system on the fundamental principles of Islam will be beneficial to Muslims and non-Muslims alike, and there will be many conmon grounds between the different communities.

কী কারণে সেটা ঘটবে? ঘটবে তা এই কারণে যে, “The truly Islamic state allows the fullest development of all peoples and communities; for Islam is extensive and espansive like the sun....”১৫

উপাচার্য মহোদয় ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। তাঁর ভাষাতে প্রবল ইসলামী উদ্দীপনার সঙ্গে কাব্যিকতার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। জিন্নাহ অবশ্য ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। সে জন্য শিক্ষার্থীদেরকে তিনি সতর্ক করে দিলেন দেশের অর্থাৎ রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে। রেসকোর্সের বক্তৃতায় কমিউনিস্টদেরকে শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় তিনি পঞ্চম বাহিনীর (ফিফথ কলমিস্ট) তৎপরতার দিকে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তিনি বললেন, ছাত্রদেরকে রাষ্ট্রের “honest, unselfish servants” হতে হবে।

অলিখিত ওই বক্তৃতার শেষাংশে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান মানুষের জন্য সৌভাগ্যের দরজা খুলে দিয়েছে। দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন করাচির এক যুবকের। এই যুবক এক সময়ে ২০০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ করতো। এখন এক ব্যাংকের ম্যানেজার হতে পারায় তার বেতন হয়েছে ১,৫০০ টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য জিন্নাহ সাহেবের পরামর্শটা ছিল কেবল সরকারি চাকরির ওপর নির্ভর না করে বাণিজ্য ও শিল্প উদ্যোগের দিকে মনোযোগ দেওয়া চাই।

You will be far more happy and far more prosperous with far more opportunities to rise if you take to commerce and industry and will thus be helping not only yourselves but also your state..১৬ 

পরামর্শটা ইসলামী হবার নয়, ছিল পুঁজিবাদী উন্নতির রাস্তা ধরবার। তাঁর এই পরামর্শকে অবশ্য তখন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ওই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনো 'হড় হড়' ধ্বনি ওঠেনি। জিন্নাহ চাইছিলেন, পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র নয়, একটি বুর্জোয়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হোক। তিনি পুঁজিবাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর ওই পথপ্রদর্শনই পাকিস্তান রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে।

রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের কথাটা ছিল আবরণ মাত্র, ভেতরের আকাঙ্ক্ষাটা ছিল ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত মুনাফা লাভের। পাকিস্তান রাষ্ট্র ওই পথেই এগিয়েছে। ওই রাষ্ট্র পূর্ববঙ্গকে একটি উপনিবেশ হিসেবে ধরে রাখতে চাইছিল, ধর্মের আচ্ছাদনটা বিছানো হয়েছিল পুঁজিবাদী উন্নয়নের স্বার্থেই। অথচ সাধারণ মানুষ এবং তখনকার শিক্ষার্থীরাও চাইছিল, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গবাসী যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মুক্তি চেয়েছে, সেই জাতীয়তাবাদ কেবল যে ধর্মনিরপেক্ষ ছিল তাই নয়, ছিল গণতান্ত্রিকও এবং গণতন্ত্রের মূল কথাটাই হলো, নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য। তবে ইসলামী শিক্ষার কথাটা কিন্তু প্রবল বেগেই বলা হচ্ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতাগুলো পড়লে দেখা যায়, শিক্ষার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিকে খারিজ করে দেবার ব্যাপারে পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের উৎসাহের কোনো অভাব ছিল না। এর মূল কারণ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে এবং জিন্নাহ যেভাবে বুর্জোয়া (অর্থাৎ পুঁজিবাদী) রাষ্ট্রের কথা ভেবেছেন, সেই চিন্তাটা শিক্ষাবিদদের মধ্যে সবেগে প্রবাহিত হয়নি। অধ্যাপক মাহমুদ হাসানের পরে উপাচার্য হন বাঙালি অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। সমাবর্তন বক্তৃতায় তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধেই বলেছেন। বক্তৃতায় তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। সিদ্ধান্তটি ছিল এই যে, রাষ্ট্রের ইসলামী ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে “similar facilities should also be granted to other communities in respect of their religion should they so desire”১৭

উল্লেখ্য যে, এই শিক্ষা সম্মেলনেই কিন্তু এই প্রস্তাবও গৃহীত হয় যে, ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

শিক্ষাক্ষেত্রে উপাচার্যদের কথিত পাকিস্তানপন্থী চিন্তাধারা বেশ শক্তিশালী ছিল, এবং তা যে ঘটেছে বিশেষ ভাবে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের কারণে, সেটাও বোঝা যায়। পাকিস্তানী দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস লেখার চেষ্টা হয়েছে, এবং তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও যুক্ত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বাদ দেবো, এমন উক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একজনের কাছ থেকেই এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সমর্থক যে ছিলেন না, এমন নয়। তবে উদারনীতিকরাও ছিলেন; তাঁরা মাঝে মধ্যে নিজেদের বক্তব্য দিতে চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নি। কারণ রাষ্ট্রের কর্তারা ছিল বিপক্ষে।

১৯৫৭ সালে উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতায় সুনাগরিক হবার শিক্ষা এবং যথার্থ অর্থে মানবিক হওয়ার শিক্ষার ভেতর একটা পার্থক্যের কথা বলেন। তাঁর মতে নাগরিক হবার শিক্ষা একজন ব্যক্তির পক্ষে পরিপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে না। ব্যক্তি মানুষকে রহফরারফঁধষ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে,

The citizen is only a particular type of individual and his horizon of life is circumscribed and limited by his political affiliation and loyalty to the existing order of things or an order imposed by the most powerful political party in the state. 

তিনি বলেছিলেন যে, শিক্ষা যদি এই রকমের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয় তাহলে জ্ঞানের বিকাশ অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছিলেন,

If Christ had been born loyal to the order of his day, perhaps there would have been no Christianity. Similarly if Prophet Mohammed had not rebelled against the existing order there would have been no Islam.১৮

এই উক্তিটি ছিল ১৯৫৭ সালের; পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরে এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির আগে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক তখন পূর্ববঙ্গে গভর্নর, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলার। ওই সমাবর্তনে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় তিনি কিন্তু individual-এর সঙ্গে citizen-এর এই পার্থক্যকে অস্বীকার করেন। শেরে বাংলা বলেন, “the real, definite and decisive reason why I do not accept the distinction is the all-important fact that this runs counter to the principle of Islam.”১৯

পদার্থবিজ্ঞানের ইংরেজ অধ্যাপক ডব্লু এ জেনকিনস দুইবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমবার ১৯৩১ সালে, অর্থৎ ব্রিটিশ শাসনামলে; দ্বিতীয়বার ১৯৫৪-৫৫-তে, পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ শাসনের পতন এবং পূর্ববঙ্গবাসীর নির্বাচনী রায়কে বানচাল করবার কেন্দ্রীয় সরকারের চেষ্টার সময়ে। ১৯৩১ সালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আবহাওয়া বেশ তপ্ত ছিল। গান্ধী কারামুক্ত হয়েছেন, তবে তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যাচ্ছেন; অন্যদিকে চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহ ঘটেছে, পাঞ্জাবে বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়েছে; সেই সময়ে সনদপ্রার্থী গ্রাজুয়েটদেরকে উদ্দেশ্য করে জেনকিনস্ বলছেন, তারা যেন সাহস না হারায়। বলছেন, সাহাসী হও, “Leave cynicism and pessimism to the disillusionment of old age.”|

বলেছেন, “One of the tragedies of modern life is the movement inculcating cynicism and unbelief amongst the youth of to-day,””১৯

১৯৫৫-তে, অর্থাৎ যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের সময়ে অধ্যাপক জেনকিনস্ তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতায় যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটা হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা’। তিনি বলেছেন, “I have chosen this topic because it is one of those problems of what the finding of the correct solution is fundamental to the future useful development of the Universities and of the country.”২০

অধ্যাপক জেনকিনস কিন্তু দেশের কথাই বলেছেন, জাতির কথা নয়, দেশ বলতে তিনি হয়তো পূর্ববঙ্গের কথাই ভেবেছেন, জাতির প্রসঙ্গ আনলে ‘পাকিস্তান’ এসে যেত।

১৯৫৫ সালের ওই সমাবর্তনের চ্যান্সেলার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আমিরউদ্দিন আহমদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা উপাচার্য-উপস্থাপিত মতের সঙ্গে তিনি মোটেই ঐকমত্য প্রকাশ করেন নি। তাঁর মতে স্বাধীনতা নয়, প্রয়োজন হচ্ছে ‘সত্যের অন্বেষণ’। সমাজে অমঙ্গল দেখা দিয়েছে ‘প্রতিযোগিতা’র কারণে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন ভয়ঙ্কর একটি সত্য; সেটা হলো,

The manual labourer of yesterday has become the leader of today. The levelling down of class distinction has created new and serious social and moral problems and it is in the right solution of these problems and the proper guidance of various relations that the Universities of today can be of the greatest help and service....২১

সন্দেহ করবার তাই কোনো কারণ নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল চিন্তা যেমন শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাও কার্যকর ছিল, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ‘আদর্শবাদিতা’ ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হয়ে একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা যেমন প্রাণ দিয়েছেন, তেমনি ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরাও ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও ক্ষুদ্র যদিও তবু একাংশ ছিল যারা পাকিস্তানী হানাদারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে লড়াই করেই প্রগতিকে এগুতে হয়েছে; তবে প্রতিক্রিয়ার শক্তি ছিল বেশ বিস্তৃত।

একাত্তরের শেষে এসে দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অধ্যাদেশ পেল যেটি তাকে পরিপূর্ণ না হলেও অনেকটা স্বায়ত্তশাসনই দিলো, বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের বিশেষ একটি এলাকা হলো অর্থায়ন, এটি যাতে সরাসরি না ঘটে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানও তৈরী করা হলো। আশা ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বাধীনতা’ ও গণতান্ত্রিকতার অনুশীলন দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের তো বটেই, শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও সম্পর্কটা আগের মতো সামন্ততান্ত্রিক না থেকে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে।

শেষ পর্যন্ত তেমনটা কিন্তু ঘটে নি। বোঝা গেছে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের ঘাটতি ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয়ও তার বাইরে থাকতে পারে না। দেখা গেল রাষ্ট্রের শাসকরা চাইছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রভাব, সম্ভব হলে কর্তৃত্বই, বহাল থাকুক; আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও কিছুসংখ্যক শিক্ষক শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠলেন, কিছুটা মতাদর্শিক কারণে, অনেকটাই বৈষয়িক উন্নতির আশায়। ফলে অন্য পেশাতে যেমন শিক্ষকদের মধ্যেও তেমনি দলীয় বিভাজনের ভেতর দিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক বিভাজন চলে এলো। পরবর্তীতে সেটা বেড়েছে বৈকি, কমে নি। অভিযোগ আছে যে নিয়োগে ও পদোন্নতিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের বিবেচনা মেধাগত বিবেচনাকে ছাপিয়ে যায়।

রাষ্ট্রীয় কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার অভিব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে পাওয়া গেছে। ধরা যাক মনোগ্রামের (ক্রেস্ট) ব্যাপারটা। শুরুতে মনোগ্রামে এ অঞ্চলের চারটি প্রধান ধর্ম, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রতীকেরই স্থান দেওয়া হয়েছিল; পাকিস্তানের কালে মনোগ্রামে চলে এসেছে বাঁ পাশে চাঁদতারা ডানপাশে কোরআন শরীফ, নীচে একপাশে পাট অন্যপাশে ধান, এবং তারও নীচে নৌকা। শুরুতে মনোগ্রামে লেখা থাকতো ঞৎঁঃয ংযধষষ চৎবাধরষ; পাকিস্তান আমলে সেটা আর থাকে নি। মনোগ্রামের এই পাকিস্তানীকরণটি কিন্তু ঘটেছে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যখন প্রবল হয়ে উঠেছে তখন।


স্মরণ করলে দেখা যাবে যে, গত একশ’ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিস্তার ও উন্নয়ন ঘটেছে তা অসাধারণ। শিক্ষাক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বহুমুখী ও সুবিস্তৃত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে দরিদ্র, অবহেলিত ও প্রান্তিক এক জনপদের মানুষকে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহায্য করার দায়িত্ব নিয়ে। সে দায়িত্ব পালনে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রকার ত্রুটি করে নি। অসংখ্য মানুষকে সে সুশিক্ষিত করেছে; ওই শিক্ষিতজনেরা নিজেদেরকে আরও বিকশিত করেছেন, এবং শিক্ষা অন্যদের ভেতরও বিস্তৃত করে দিয়েছেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পূর্ববঙ্গে প্রথম ও একমাত্র, ক্রমে আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া গেছে; কিন্তু সেসব বিশ্ববিদ্যালয়েও মাতৃসম এই বিশ্ববিদ্যালয়কেই শিক্ষক সরবরাহ করতে হয়েছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, স্কুল কলেজের অনেক শিক্ষকই এখানে শিক্ষিত।

শুরুটা ছিল অনেকটা দায়সারা গোছেরই। তখন অনুষদ ছিল মোট তিনটি-কলা, বিজ্ঞান ও আইন। আইন অনুষদে বিভাগ মাত্র একটি; বিজ্ঞান অনুষদে একটু বেশী, দু’টি; বাকি নয়টি বিভাগ কলা অনুষদের। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ বলে কিছু ছিল না। অর্থনীতি ও রাজনীতি পড়ানো হতো একই বিভাগে। বাণিজ্য শিক্ষার জন্য কোনো স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা হয় নি; তাকে জায়গা করে নিতে হয়েছে অর্থনীতিতে। সব মিলিয়ে শিক্ষক ছিলেন মোট ৬০ জন, শিক্ষার্থী ৮৭৭।

তারপরেই কিন্তু দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। বাণিজ্য অনুষদ গঠিত হয়েছে, সেখানে প্রথমে বিভাগ ছিল দু’টি। এখন আছে নয়টি। অনুষদের নামও গেছে বদলে, নতুন নাম বিজনেস স্টাডিজ। ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিসট্রেশনের শুরুটা ঘটেছিল দ্বিধার সাথে, এখন সেটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি প্রতিষ্ঠান।

শুরুতে বিজ্ঞান অনুষদে বিভাগ ছিল মাত্র দু’টি, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন। রসায়ন বিভাগ থেকে প্রথমে এলো মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ; পরে ফার্মেসী; ফার্মেসী এখন সম্পূর্ণ একটি অনুষদ, বিভাগ সেখানে চারটি। মৃত্তিকা বিজ্ঞান যুক্ত হয়েছে জীববিজ্ঞান অনুষদের সাথে, সেখানে বিভাগ-সংখ্যা এখন দশটি। ভূগোল শিক্ষার নিজস্ব ব্যবস্থা শুরুতে ছিল না, পরে তার সাথে আরও পাঁচটি বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ। পদার্থ বিজ্ঞান একক ছিল একসময়ে; সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান; আরও পরে এ্যাপলায়েড ফিজিক্স। পরবর্তীতে গঠিত হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি অনুষদ, তাতে বিভাগ রয়েছে পাঁচটি।

দর্শন বিভাগ অবশ্য যাত্রাশুরুতেই ছিল, তবে মনোবিজ্ঞান ছিল না। পরে মনোবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে; ক্রমান্বয়ে এসেছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি এবং এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সিলিং বিভাগ। ভাষাবিজ্ঞান এখন একটি স্বতন্ত্র বিভাগ। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট গঠন করা হয়েছিল সময়ের প্রয়োজন মেটাতে; এখন সেটি একটি অত্যন্ত প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান। চারুকলা ইনস্টিটিউট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে, এক সময়ে যুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে; চারুকলা অনুষদে এখন বিভাগ রয়েছে আটটি। নাট্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল অনেক দিন ধরেই, এক সময়ে সেটা সম্ভব হয়েছে। এই বিভাগের শিক্ষাকার্যক্রম এখন প্রসারিত হয়েছে তিনটি বিভাগে-থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ, সঙ্গীত, এবং নৃত্যকলা। একদা-অনুপস্থিত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে বর্তমানে বিভাগ রয়েছে ষোলটি।

যাত্রার শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্ব দিয়েছে গ্রন্থাগারকে; এবং সেটিকে সে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করেছে। গ্রন্থাগারের একটি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে প্রাচীন পা-ুলিপি। বাংলা ছাড়াও ফার্সী, আরবী ও উর্দুভাষায় রচিত বিপুল পরিমাণ পা-ুলিপি আছে গ্রন্থাগারের সংগ্রহে। পা-ুলিপিগুলোর তালিকা প্রণয়ন ও মাইক্রোফিল্মের সাহায্যে তাদের সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটিকে এখন ইন্টারনেটের প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারটিও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে বহুসংখ্যক ইনস্টিটিউট এবং গবেষণা কেন্দ্র। প্রথম প্রতিষ্ঠা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের, তারপরে একে একে এসেছে আরও এগারটি। গবেষণা কেন্দ্রগুলোর ভেতর প্রথমে স্থাপিত হয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ব্যুরো, পরে এসেছে আরও নয়টি। শারীরিক শিক্ষাও মোটেই উপেক্ষিত থাকে নি, তার জন্যও রয়েছে একটি উন্নত জিমনেসিয়াম ও একটি স্টেডিয়াম। অভাব ছিল প্রকাশনা সংস্থার; এখন তা নেই।

সূচনাতেই বিশিষ্ট গবেষকরা শিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন। শহরটি মফস্বলীয় ছিল, কিন্তু এর শান্ত পরিবেশ ছিল অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তদুপরি বেতন ও আবাসন ব্যবস্থা দু’টোই ছিল আকর্ষণীয়। বিশিষ্ট গবেষক ও প-িতদেরকে পাওয়া গিয়েছিল শিক্ষক হিসেবে। তাঁরা নিজেরা গবেষণা করেছেন, এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেছেন গবেষণায়। অঙ্কুরটি তাঁরাই রোপণ করেছিলেন, পরে যেটা নিজস্বতা নিয়ে বিকশিত হয়েছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়; তাই চ্যালেঞ্জ ছিল বহুবিধ। বিশ্ববিদ্যালয় উদ্দীপনার সাথে সেই চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করেছে। শিক্ষার মানের ব্যাপারে কোনো আপোস করে নি। প্রতিটি উত্তর-পত্র দু’জন পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হতো, একজন ভেতরের অপরজন বাইরের। সে-ব্যবস্থা এখনও আছে।


বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা। শুরুতে ছাত্রী ছিল মাত্র দু’জন। প্রথমজন লীলা নাগ, যিনি নানা রকমের নিষেধ ডিঙিয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। আরেকজন ছিল আইন অনুষদের ডীন নরেশ সেনগুপ্তের কন্যা, সুস্মিতা সেনগুপ্ত। এই ছাত্রীটিকে সঙ্গ দিতে ক্লাসরুমে তার সঙ্গে গিয়ে বসতেন উপাচার্যের স্ত্রী। ছাত্রীটি অবশ্য শিক্ষা এখানে সমাপ্ত করে নি, কলকাতায় চলে গেছে। ক্লাশরুমে ছাত্রীরা থাকতো সংকোচে। অধ্যাপকরা তাদের নিয়ে যেতেন ক্লাসে, আবার ফেরত দিয়ে যেতেন ছাত্রীদের মিলনায়তনে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কথাবার্তা হতো না; দেখা করতে হলে প্রক্টরের অনুমোদন লাগতো। এই ব্যবস্থা চালু ছিল ১৯৫২ সাল পর্যন্ত; পরিবর্তন আসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়, যে আন্দোলনে মেয়েরাও যোগ দেয়। প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলাতুননেসা; তিনি এসেছেন চার বছর পরে, ১৯২৫-এ; এবং স্মরণীয় হয়ে আছেন অত্যন্ত ভালো ফল করে শুধু নয় সারা বাংলায় প্রথম মুসলমান মহিলা এম এ হিসেবেও। মহিলা শিক্ষকের আগমনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে অপেক্ষা করতে হয়েছে পনের বছর। ছাত্রীনিবাস স্থাপিত হলে প্রাথমিক ভাবে পাওয়া গিয়েছিল আটজনকে, তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিল মুসলমান। সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রী সংখ্যা ১৫,৩০৫। মহিলা শিক্ষক আছেন ৬৬৩ জন। ছাত্রীদের জন্য আবাস রয়েছে সাতটি। আরও প্রয়োজন।

তবে অভিযোগ যে নেই তাতো নয়। অভিযোগ আছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এখন আর আগের মতো নেই, নেমে গেছে। বলা হয় গবেষণাও আগের মতো হচ্ছে না। গবেষণা যে হচ্ছে না এটা মোটেই সত্য নয়; গবেষণা অবশ্যই চলছে, বহু শিক্ষার্থী পিএইচ ডি ডিগ্রি পাচ্ছে; শিক্ষকরা গবেষণা করছেন, তাঁদের প্রকাশনাও আছে; বিভাগীয় ও অনুষদীয় জার্নালও বের হয়। হয়তো আরও হলে ভালো হতো। তেমনটা না হওয়ার কারণ কিন্তু কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে খুঁজলে চলবে না, বাইরের দিকেও তাকাতে হবে। এটা সাধারণত সত্য, এবং স্বীকৃতও বটে যে দেশে জ্ঞানের মৃল্য না কমলেও দাম কমে গেছে। এমনকি মূল্য যে কমেনি তাও নয়। জিন্নাহ সাহেব যে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা যে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে এটা সত্য; যে রাষ্ট্র গড়ার জন্য তাঁর চেষ্টা ছিল সেই রাষ্ট্র এখন আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না; তবে রাষ্ট্র ভাঙলেও রাষ্ট্রের জন্য যে পুঁজিবাদী উন্নয়নের সোপারিশটি তিনি করেছিলেন উন্নয়নের সেই দর্শনটি কিন্তু ভেঙে পড়ে নি। ওই দর্শনের যাত্রা ব্রিটিশ শাসনের কালে শুরু হয়েছিল, পাকিস্তানী আমলে জোরদার হয়েছে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও চালু আছে। পুঁজিবাদী উন্নয়ন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় মুনাফাকে,্এবং চায় সবকিছুই পণ্যে পরিণত হোক। রাষ্ট্রের ওই দর্শন কায়েম থাকায় এবং বিশ্বপুঁজিবাদের বলয়ের ভেতরেই রাষ্ট্রের অবস্থান নেওয়াতে জ্ঞানের মূল্য কমে গেছে। দামও গেছে পড়ে। জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণের নিম্নগমনের দরুন গবেষণাতেও আগ্রহ কমেছে। সর্বত্রই কমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় তার বাইরে থাকতে পারে নি। থাকা অবশ্য প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাস্তবতায় সেটা ঘটতে দেয় নি।

শিক্ষার মানের ব্যাপারে মনে রাখা দরকার যে শিক্ষা কেবল দেবার ব্যাপার নয়, গ্রহণ করবার ব্যাপারও বৈকি। এই গ্রহণ করাটা অনেকাংশেই নির্ভর করে সংস্কৃতির ওপর। শিক্ষা ও সংস্কৃতি আসলে এক সঙ্গেই যায়। শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক জীবন ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও বিকাশশীল। শিক্ষার্থীরা যে কেবল ক্লাস রুমে শিক্ষা গ্রহণ করতো তা নয়, তারা গ্রন্থাগারে যেত, যেত ল্যাবরেটরিতে, এবং পরস্পরের সঙ্গে মিলতো, মিলতো সামাজিক ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি তো ছিল আবাসিক। শিক্ষকরাও কোনো না কোনো ছাত্রাবাসের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ঘটতো ক্লাসরুমের বাইরেও। যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা হতো শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিষয়ে।

শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ ছিল। ছাত্রসংসদ নাটক, বিতর্ক, গানের অনুষ্ঠান, বার্ষিকী প্রকাশ, বক্তৃতা, খেলাধুলা ইত্যাদির আয়োজন করতো। বিকেল ও সন্ধ্যাতে এক বা একাধিক অনুষ্ঠান পাওয়া যেত। তাতে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও যোগ দিতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো নিয়মিত। প্রথম দিকের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শিক্ষকরা তো বটেই এমনকি উপাচার্য নিজেও অংশ নিতেন ছাত্রদের সঙ্গে। ছাত্রসংসদের নির্বাচন ছিল অনেকটা সামাজিক উৎসবের মতো।

ছাত্রসংসদ কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়েও টিকে ছিল। অনিয়মিত হয়ে যায় বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত সময়কালে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রসংসদের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। এরপরে সামরিক শাসকদের শাসনামলে তিন বছর নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে ১৯৯১ থেকে, ঠিক সেই সময়টা থেকেই দেশে যখন সামরিক স্বৈরশাসনের বদলে নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তিত হয়েছে। ২৮ বছর পরে মাত্র একটি (২০১৯ সালে) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পেরেছে, তবে নির্বাচিতরা যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে সাংস্কৃতিক কর্মে মুখর করে রাখতে পেরেছে এমন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ক্লাব আছে, তাদের এবং বিভাগীয় উদ্যোগেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়; কিন্তু এরা মোটেই ছাত্রসংসদের বিকল্প নয়। সাংস্কৃতিক জীবন শিক্ষাজীবনের কেবল যে পরিপূরক তাই নয়, একে অপরের জন্য সহায়কও বটে; সাংস্কৃতিক জীবন সজীব না থাকলে শিক্ষাজীবনের স্বাস্থ্যও দুর্বল হতে বাধ্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যা অর্জন তা কেবল যে শিক্ষকদের কারণেই ঘটে এমন নয়; ছাত্রদের কাজটাও এখানে খুবই জরুরী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদেরকে গড়ে তুলেছেন, ছাত্ররাও তেমনি শিক্ষকদেরকে শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে উদ্দীপ্ত করেছে, এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে চরিতার্থতা তার বোধটাও শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যখন সঙ্কটাদি দেখা দিয়েছে তখন ছাত্ররাই প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ছাত্রদের এই যে সংবেদনশীলতা ও অধিকার-চেতনা ছিল একটি চালিকাশক্তি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির কর্মচারীদের ভূমিকাটি ভুলবার নয়। শিক্ষকদের মতোই কর্মচারীদেরও অনেকে তাঁদের কর্মজীবনের অধিকাংশটাই এখানেই কাটিয়েছেন এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মেরও অনেকে এখানে নানা স্তরের কাজে নিয়োগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনে শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে কর্মচারীদেরও একটি বিশেষ ধরনের ভূমিকা ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তনও একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সমাবর্তন নিয়মিত হয় নি। ১৯৪৭-এ হয় নি; ১৯৪৭ থেকে পরবর্তী ২৩ বছরে সমাবর্তন হয়েছে মোট ১৫টি; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংখ্যা আরও কমে গেছে, ৫০ বছরে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ১৩টি। না-হবার কারণটা রাজনৈতিক।

শিক্ষকদের মানের ওপর শিক্ষার মানের নির্ভরশীলতার ব্যাপারে তো কোনো সংশয়ই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবানদেরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে এসেছে, যে জন্য এখানে জ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগমন এক সময়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে পরিবর্তন দেখা গেছে; প্রথম দিকেই একটা শূন্যতা তৈরী হয়েছিল, পরে অবশ্য সেটা থাকে নি; তবে দেখা গেছে যে শিক্ষকদের একটা অংশ রাষ্ট্রীয় কাজে চলে গেছেন। কেউ গেছেন সাময়িক ভাবে, অনেকেই চলে গেছেন স্থায়ীভাবে। এর কারণ রাষ্ট্রীয় কাজে সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতি। রাষ্ট্র ছিল আমলাতান্ত্রিক; আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র মেধাবানদের টেনে নিয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থার সুবিধা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও দেখা গেছে মেধাবানদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় নিয়োগকেই পছন্দ করেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারতেন এমন বহু মেধাবী বিদেশে চলে গেছেন, নবীন শিক্ষকদের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফেরত আসেন নি। এই ঘটনাকে মেধাপাচার বলাটা অন্যায্য হবে না। মেধাপাচারও আসলে পুঁজিবাদেরই অনুষঙ্গ। কিন্তু এর দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার।

অভিযোগ রয়েছে যে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান উঁচুতে নয়। র‌্যাঙ্কিং-এর মূল্যায়ন যেভাবে হয় তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়-দায়িত্ব পালনের দিকটা বিবেচনায় আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওই দায়-দায়িত্ব নিয়মিত পালন করেছে এবং পালন করতে গিয়ে যে পরিমাণ বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছে তা তুলনাবিহীন। জ্ঞানের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে তার ছিল টিকে থাকবার সংগ্রামও, গরীব ঘরের মেধাবান বিদ্যোৎসাহী ছাত্রটির মতোই। জ্ঞানের আহরণ, সৃষ্টি ও বিতরণের ক্ষেত্রে কাজ করার পাশাপাশি ও কাজের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব নিতে হয়েছে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবারও। এবং উভয় ক্ষেত্রেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্যপালন অত্যন্ত উঁচু মানের। বলাই বাহুল্য যে কথিত একাডেমিক র‌্যাঙ্কিং-এর মাপকাঠিতে এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবদানটা ধরা পড়বার কথা নয়; ধরা পড়েও না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে ঘোষিত আকাক্সক্ষাটা ছিল পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু দারিদ্র্যর কারণে মুসলমান পরিবার থেকে শিক্ষার্থীরা তেমন আসতে পারে নি। শুরুতে তারা ছিল শতকরা বিশ জনেরও কম। সুবিধা তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদেরই বেশী হয়েছে। তবে ওই সম্প্রদায়েও কৃষক ছিল, দরিদ্র মানুষও ছিল; বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাটা তাদের জন্যও মোটেই সহজ ছিল না। হিন্দু সমাজে আরেকটা সমস্যা ছিল; সেটি বর্ণবিভাজনের। উচ্চবর্ণের লোকেরা নিম্নবর্ণের মানুষকে দূরে রাখতে চাইতো, ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি স্পর্শযোগ্যও বিবেচনা করতো না। উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের শিক্ষার্থীরা এক সঙ্গে একই ছাত্রাবাসে থাকবে, শুধু থাকবে নয়, একই রান্নায় এক সঙ্গে বসে আহারও করবে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অকল্পনীয় ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সেটাই ঘটিয়েছে, ছাত্রাবাসে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, ছুৎ-অচ্ছুৎ সবাইকে একত্রে রেখেছে, এবং একসঙ্গে একই পাচকের রান্না খাদ্য গ্রহণ সম্ভব করে দিয়েছে। উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীর ব্যবধান মুসলমান সমাজেও ছিল, সেখানেও আশরাফরা আতরাফদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে চাইতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রাবাসে সেই ব্যবধান ভেঙে গিয়েছিল।

খুব বড় রকমের উপকার হতো হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় যদি একসঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের যে শত্রুতা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এগুতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পরিবেশটা সেই সহযোগিতারই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পুরোপুরি টিকে থাকতে পারে নি। সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও রাষ্ট্রীয় বৈরিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমষ্টিগত অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে। ১৯৩৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এ এফ রহমান; তিনিই প্রথম মুসলিম উপাচার্য। এ এফ রহমান স্যার উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কমানোর কথা বলেছিলেন, এবং এই লক্ষ্যে যা প্রয়োজন তাকে এভাবে চিহ্নিত করেছিলেন : “a sympathetic appreciation of the contribution of the two great communities to her (India’s) culture and history.”২২

ওদিকে ১৯৩৬-এর বক্তৃতায় তিনি আবার ছাত্রদেরকে সতর্ক করেছেন তারা যেন বিভিন্ন ‘ism’-এর পাল্লায় না পড়ে। তাঁর ভাষায়, “Terms and phrases like “Capital”, “Labour”, “Socialism”, “Communalism” produce the armaments of Political conflict”২৩

এই ধরনের মনোভাব অবশ্য ছাত্রদের ভেতর থাকবার কথা নয়। আর সে জন্যই হয়তো কথাটা বলা। সমস্যাটা ছিল Communalism নিয়েই, Labour ও Socialism  নিয়ে নয়। সাম্প্রদায়িকতা ততোদিনে প্রবল হয়ে উঠেছে, এবং সেটা যে দেশের মানুষকে কোন পরিণতিতে নিয়ে যাবে রাজনৈতিক নেতারা তা বুঝতে পারেন নি; বুদ্ধিজীবীরাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন নি। সমঝোতার কথা অনেকে ভেবেছেন; যেমন উপাচার্য এ এফ রহমানও ভেবেছেন; কিন্তু সমঝোতা নয়, সংস্কারও নয়, প্রয়োজন ছিল যে মৌলিক পরিবর্তনের সেটা কেউ কেউ নিশ্চয়ই বুঝতেন; কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা তেমন হতো না। আলোচনা হলে Capital ও Labour যে এক নয়, এবং Socialism ও  Communalism  যে এক সঙ্গে যায় না, তা পরিষ্কার ভাবে জানানো সহজ হতো।

বিশ্ববিদ্যালয় তার অস্তিত্বের একশ’ বছর পার হয়ে এসেছে। সামনের দিনগুলোতে সে কিভাবে এগুবে সে প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত। এগুতে হবে অবশ্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবেই। সেটাই দাঁড়াবে প্রধান ও প্রাথমিক দায়িত্ব। তার জন্য প্রয়োজন হবে বিতরণের লক্ষ্যে জ্ঞান আহরণ ও সৃষ্টি। জ্ঞানের সৃষ্টি হয় গবেষণার মধ্য দিয়ে। তাই গবেষণা চাই। গবেষণাকে হতে হবে মৌলিক তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে উপযোগীও। আর গবেষণার ফল প্রকাশ করাও দরকার পড়বে। তার জন্য চাই প্রকাশনা। বস্তুত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনতে হলে সেখানে কী ধরনের ও মানের গবেষণা হচ্ছে সেটা যেমন দেখতে হয়, তেমনি খোঁজ নিতে হয় তার প্রকাশনারও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবশ্য একটি বড় ও বিশেষ রকমের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সেটা হলো বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা দান। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কেবল যে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে চেয়েছে তা-ই নয়, আমাদের আকাক্সক্ষা ছিল বাংলাভাষা হবে উচ্চ আদালতের ভাষা এবং অবশ্যই সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম। এই দু’টির কোনোটাই অর্জিত হয় নি। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান কেবল যে আত্মসম্মান রক্ষার ব্যাপার তা নয়, যথার্থ শিক্ষার ব্যাপারও বটে। এটা তো সবাই জানেন যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে না দিলে শিক্ষা গভীর ও স্থায়ী হবে না; আসলে যথার্থই হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেরও কর্তব্য রাষ্ট্রকে দায়িত্বসচেতন করে তোলা এবং নিজের দিক থেকেও উদ্যোগী হয়ে দায়িত্বটি গ্রহণ করা।

স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে; একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাহ্নে পরপর দু’টি সমাবর্তন দু’দিনে (৮ ও ৯ মার্চ, ১৯৭০)। দ্বিতীয় সমাবর্তনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা। তিনি তাঁর বক্তৃতাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “যেসকল দেশ আজ শিল্প ও বিজ্ঞানে উন্নত তাদের সকলের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে পরিশেষের স্তর পর্যন্ত শিক্ষার বাহন মাতৃভাষায় রেখেছে। আমরা আশা করেছিলাম বিভাগোত্তর দেশে এ বিষয়ে শিক্ষা আমরা সর্বাগ্রগামী হয়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও যাবতীয় অন্য বিষয়ে শিক্ষা ত্বরান্বিত করতে পারবো।”২৪ পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনে ওই লক্ষ্য অর্জন যে অসম্ভব ছিল তার প্রমাণ তো তখনকার ইতিহাসেই লিখিত রয়েছে। জোর দিয়ে তিনি বলেছেন,

বাঙ্গালী ছাত্ররা বর্তমানের (অর্থাৎ তখনকার) অসন্তোষজনক পরিস্থিতির মধ্যেও উন্নততর স্তর পর্যন্ত পৌঁছবার ক্ষমতা রাখে। আজকার এই সমাবর্তন উৎসবে বাংলা ভাষার আগমনে সকলের মনের কথা বলবার সুযোগ পেয়ে আমাদের শিক্ষাসমস্যার সমাধানরূপে বাংলাভাষাকে সর্বাধিক ভাব প্রকাশের মাধ্যম করণের প্রস্তাব করি। এর দাবীর কথা আর নতুন করে তুলবো না। এর দাবী রক্তের লেখায় বীর যুবকেরা লিখে গেছে। আর ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে চিরকালের জন্য অবিস্মরণীয় করেছেন তাঁরা। বাংলার সুধীবৃন্দের আজ শুধু প্রয়োজন তাদের শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান, কলা, কৌশল, এনজিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষার জন্য নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। আমার বিশ্বাস কাজ যথেষ্ট সহজ হয়ে উঠবে। বিভাগোত্তর যে ভীতি এরূপ পুস্তক প্রণয়নের পথে দেখতাম আজ তা দেখি না। আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে আমরা পাঠ্যপুস্তক না দিলে তারা চিরকাল বাইরের দিকে চেয়ে থাকবে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য। পরমুখাপেক্ষিতা জাতীয় জীবনের জন্য অভিশাপ, এর থেকে মুক্তি লাভ করা আশু প্রয়োজন।২৫

তিনি আরও বলেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়কে এদিকে নেতৃত্ব দিয়ে সারা দেশের উন্নতি বিধান করতে হবে।”

উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষায় সমাবর্তন বক্তৃতা দান ওই ছিল প্রথম। উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরীও বাংলাতেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করবার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দেবার আবশ্যকতা ছিল। এটা দুঃখজনক যে তেমনটা ঘটে নি। আগামীতে এই দায়িত্ব পালন করাটা হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্চ। কেবল নতুন বই লেখা নয়, বই লেখার জন্য গবেষণাও আবশ্যক হবে। তবে সেই গবেষণা প্রকাশ করতে হবে বাংলাভাষাতে, যাতে শিক্ষার্থী ও অন্য গবেষকদের কাছে তা সহজে পৌঁছাতে পারে। এই কাজ করতে পেলে দেখা যাবে ভাষার ধারণ ও প্রকাশ, উভয় ক্ষমতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং যিনি বই লিখছেন তাঁর নিজের কাছেও বইয়ের বিষয়বস্তু অধিকতর স্পষ্ট ও জীবন্ত হয়ে উঠছে।

নতুন বই শুধু নয়, অনুবাদও প্রয়োজন। অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসা চাই। অনুবাদ একা করা যায় না; এটি সব সময়েই একটি সমবেত কর্ম। বিষয়বস্তুটি ঠিক মতো বোঝা এবং তা বাংলাভাষায় যথার্থ রূপে প্রকাশিত হচ্ছে কি না সেটা দেখা, এই দুই কঠিন কাজের জন্যই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ তো বটেই, অনুবাদকে সাবলীল ও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ভাষায় দক্ষতা থাকাও অত্যাবশ্যক। মূল রচনার ভাষা এবং বাংলাভাষা, দু’টির কোনোটিতেই জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে চলবে না। অনুবাদের কাজেও বিশ্ববিদ্যালয়কে মনোযোগী হতে হবে।

বাংলাভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার খুব বড় রকমের একটা দুর্বলতা, দুর্বলতা নয় অভিশাপই, তিন ধারার যে বিভাজন, তার হাত থেকে অব্যাহতি লাভের দিকেও আমরা অগ্রসর হতে পারবো। তিন ধারাকে এক ধারায় (অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে) না আনলে শিক্ষার মধ্য দিয়ে শ্রেণী বিভাজনকে পোক্ত ও গভীর করার যে আত্মঘাতী কাজ আমরা করে চলেছি তা থেকে যে মুক্তি নেই। সে-কথাটা তো আর বাড়িয়ে বলবার দরকার পড়ে না।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জগুলোর আরেকটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক জীবনকে উজ্জীবিত করা। এর জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে ছাত্রসংসদের বার্ষিক নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকেও নিয়মিত উৎসবে পরিণত করা চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ যে সন্তোষজনক নয় সেটিও ভুললে চলবে না। পরিবেশের দুর্বলতার বিষয়ে অভিযোগ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নয়, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই যেহেতু প্রথম ও প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় তাই পরিবেশ উন্নয়নে নেতৃত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই দিতে হবে। এটি তার জন্য ইতিহাসনির্ধারিত কর্তব্য। পরিবেশ বিষয়ে বড় রকমের দু’টি অভিযোগ ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চ্যান্সেলর, যিনি আমাদের রাষ্ট্রপতিও, তিনি নিজেই করেছেন। প্রথমটি এই রকমের : “সম্প্রতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অমানবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জনের জন্য, লাশ হয়ে বা বহিষ্কৃত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নয়”। তাঁর দ্বিতীয় অভিযোগটি এই রকমের যে, তাঁর মতে ‘এক শ্রেণীর’ শিক্ষক নিজেদের স্বার্থে “বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে।”২৬ তিনি মনে করেন এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশু কর্তব্য। তিনি এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। সুতরাং এর জবাবদিহি জনগণের কাছে।”২৭

আমরাও আশা করবো যে প্রতিষ্ঠার পরে এক শতাব্দী পেরিয়ে নতুন শতাব্দীতে আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি উভয় ক্ষেত্রেই দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজেই নিজের গৌরবান্বিত ইতিহাসকে অতিক্রম করে যাবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সমাজেরও দায়িত্ব থাকবে। একটা দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আগ্রহী থাকা। সে আগ্রহ নানাভাবেই প্রকাশিত হতে পারে, এমনকি শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমেও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তার এক শ’ বছর অতিক্রম করে ইতিহাস নানা অর্জনে, অবদানে ও সাফল্যে উজ্জ্বল, আগামীতে সে-উজ্জ্বলতা আরও বৃদ্ধি পাবে এমনটা আশা করা মোটেই অযৌক্তিক নয়। অতীতে যেমন ভবিষ্যতেও তেমনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে এই জনপদের ইতিহাসের যে-সম্পর্ক সেখানে কোনো প্রকার বিচ্ছেদ ঘটবে না এই কামনাও সর্বজনীন বৈকি।

চ্যালেঞ্জ কিন্তু আরও একটা আছে। সেটা বৈশ্বিক ও বৈপ্লবিক। নাম তার চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লব উৎপাদনশীলতার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটাবে এবং পৃথিবী ভরে যাবে প্রাচুর্যে। আর এর কেন্দ্রে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রশ্ন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তার সৃষ্টিশীলতার মালিকানা থাকবে কাদের হাতে? আগের সকল বৈপ্লবিক অবদানের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে, তেমনি মালিকানা অল্পকিছু সুবিধাভোগীদের হাতেই কি থাকবে, বাকি মানুষদেরকে বঞ্চিত করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে মানুষের হৃদয়ের স্থানটা হবে কোথায়? হৃদয় কী নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধির? প্রশ্ন দু’টি আসলে চ্যালেঞ্জই। এখানে বিশ্ববিদ্যালগুলোর কর্তব্য থাকবে। সেটা হলো মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করা। তার জন্য প্রয়োজন তবে মানববিদ্যার চর্চা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি অপরিহার্য, কিন্তু মানববিদ্যার চর্চা যাতে সংঙ্কুচিত না হয়-সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ইত্যাদির সৃষ্টিশীল চর্চা যাতে গুরুত্ব না হারায় সেটা দেখা সকল বিশ্ববিদ্যালয়েরই কর্তব্য হবে; এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও। বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া চাই ইতিহাস ও সাহিত্যকে, যে দু’টি বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে জ্ঞানার্জন কখনোই পরিপূর্ণ হয় না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


তথ্যসূত্র

১. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ‘ঢাকার স্মৃতি’, আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্পাদক আশুতোষ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ সংস্করণ, ঢাকা, ২০২১, পৃ ৬৯
২. অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ, ‘একটি বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়’, প্রাগুক্ত, পৃ ১০৭
৩. ঐ, পৃ ১০৮
৪. Dhaka University : The Convocation Speeches, vol. I, compiled by Serajul Islam Choudhury, Dhaka Bishwabidyalay Prokashona, Sangstha, Dhaka, 1988, p 30
৫. ঐ, p 31
৬. ঐ
৭. ধীরেন্দ্রলাল দাশ, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি’, আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাগুক্ত, পৃ ১৩৫
৮. ঐ
৯. সুবোধ রায়, ‘আমাদের দিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, প্রাগুক্ত, পৃ ২৩৯
১০, অশোক মিত্র, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উজ্জ্বল স্মৃতি’, শতবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এ্যালামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা ২০২২, পৃ ৬৮-৬৯
১১. আশুতোষ ভট্টাচার্য, একটি অনুষ্ঠানের বিবরণ, আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাগুক্ত, পৃ ৩১৭
১২. M. A Rahim, The History of the University of Dacca, Dhaka Bishwabidyalay Prokashona Sangstha, Dhaka, p 16 
১৩. ঐ,p 14 
১৪. Dhaka University Convocation Speeches, vol II, op.cit, p 20
১৫. ঐ, p 13
১৬. ঐ, p 26
১৭. ঐ, p 41
১৮. ঐ, p 157
১৯. ঐ, p 205
২০. ঐ,vol. I, p 131
২১. ঐ,vol. II, p 143
২২. ঐ,vol. I, p 260 
২৩. ঐ,vol. I, p 305 
২৪. ঐ,vol. II, p 294
২৫. ঐ, p 95 
২৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : সমাবর্তন বক্তৃতা (১৯৭৪-২০১৯), সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক সংকলিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,

প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা ২০২১, পৃ ৩২২
২৭. ঐ, পৃ ৩২৩