বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি জ্ঞান বিতরণে অবদান রেখে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রাক্কালে যখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন করছি, তখনও আমরা জানি যে, উচ্চ শিক্ষার এই বিদ্যাপীঠটি আগামীর সম্বৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বলিষ্ঠভাবে ভূমিকা রেখে যাবে।
বিশ্বনাগরিক গড়ে তোলার কারখানা বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি যুগের ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে তোলে, যাতে তারা তাদের সময়ে অর্থাৎ সামনের দিনগুলিতে দেশ ও জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি না, সারা দুনিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয় একই কাজ করে থাকে। সেদিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা, তা অবিস্মরণীয়!
পৃথিবীতে বহু বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতির মুক্তিতে এতটা ভূমিকা রেখেছে, তা কখনও দেখা যায়নি। এইদিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তাঁর ছাত্র রাজনীতির উৎকর্ষ লাভ করেছিলেন। এখান থেকেই তিনি যে যাত্রা শুরু করলেন, সেই যাত্রার পথ ধরেই আমাদের দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয় যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে জীবনদান করে দেশটিকে স্বাধীন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে ফ্রান্সের দার্শনিক আঁদ্রে মালরো ঢাকা সফরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি আজ পৃথিবীর এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবিত ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে মৃত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি’!
এই মৃত ছাত্র-ছাত্রী কারা! তাঁরা হচ্ছেন-মহান মুক্তিযুদ্ধে শরীরের রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে স্বাধীন করা বীরসন্তানেরা! পরবর্তী সময়ে যদি আমরা দেখি, তবে দেখবো, দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ প্রতিষ্ঠা দিবস। এই দিবসে আমরা আশা করবো, এই একবিংশ শতাব্দীর যে বাস্তবতা, এই শতাব্দীর যে চ্যালেঞ্জ, সেটি মোকাবিলা করার জন্য শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা দেওয়া এবং তাদের মানসিক পূর্ণ বিকাশে; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ যা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে,তার আদর্শে তাদের গড়ে তোলা, মানসিকতাকে সম্বৃদ্ধ করার মতো কাজগুলো বিশ্ববিদ্যালয় অবিরামভাবে করে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আছেন, তাঁরা যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক মেধাবী এবং অনেক বেশি যোগ্য ও দক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকগণ প্রায় সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর গবেষণা ডিগ্রি নিয়েছেন। গবেষণায় বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে আছে বলে বিভিন্ন সময় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তার একটা মূল কারণ হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণাখাতে যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া দরকার, যে পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি থাকা দরকার, সেগুলোর কিছুটা ঘাটতি আছে। অবকাঠামোগত কিছু দুর্বলতা আছে। সেকারণে আমার মনে হয়, গবেষণার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে বিষয়গুলো মোকাবিলার চেষ্টা করছে, তাতে আমার ধারণা অচিরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাবে।
আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় সবসময়ই যে পিছিয়ে ছিল তা নয়, আমরা জানি, অধ্যাপক সত্যেন বোস থেকে শুরু করে অনেক গুণী শিক্ষক ও গবেষকগণ যাঁরা বিভিন্ন সময় অধ্যয়ন, গবেষণা করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাঁরা যে অবদান বিজ্ঞানচর্চায়, সমাজবিজ্ঞানে কিংবা দর্শনের ক্ষেত্রে রেখেছেন, তা সারা পৃথিবীতে আজও সমাদৃত।
আমার মনে হয়, সবকিছু মিলিয়েই একটি বিশ্ববিদ্যালয়! বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা থাকবে, লেখাপড়ার পরিবেশ থাকবে; রাজনীতি সচেতন জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার চেষ্টা থাকবে। সেখানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থাকবে। আজ যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খেলাধুলা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। খেলাধুলায় যাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে, তারা যেন তাদের শারীরিক ও মানসিক গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই বিষয়গুলিও আমাদের দেখার প্রয়োজন আছে।
আমরা এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজে বসবাস করি। হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমানতালে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। শিক্ষা ও গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে যাঁরা আছেন, তাঁরা আর্থিক বরাদ্দ ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করবেন, সেটাই কাঙ্ক্ষিত!
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শ্রুতিলিখন: নিউজরুম, বার্তা২৪.কম