রূপালি পর্দায় তিনি স্বপ্নের ছবি আঁকতেন। প্রেম ও রোমান্টিক আবহে সাধারণ, মধ্যবিত্ত মানুষের আটপৌরে জীবনসংগ্রামের কঠিনতম প্রান্তরে আনতেন স্বপ্নের ছোঁয়া। স্বপ্ন নিয়েই তিনি বেঁচে ছিলেন। তার একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'হঠাৎ বৃষ্টি'তে নচিকেতার কণ্ঠে গাওয়া 'একদিন স্বপ্নের দিন, বেদনার বর্ণবিহীন' গানের রেশ ধরে ‘স্বপ্নের দিনে’ চিরতরে চলে গেলেন পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি (জন্ম: ১০ জানুয়ারি ১৯৩০, মৃত্যু: ৪ জুন ২০২০)।
করোনার সামাজিক দূরত্বের পরিস্থিতিতেও তার মৃত্যু বোম্বে চলচ্চিত্র জগত ও সিনেমাবোদ্ধাদের গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে সামাজিক সিনেমার লিজেন্ডারি পরিচালক হিসেবে। 'মিডল ক্লাস আরবান' তথা নাগরিক মধ্যবিত্তের রোমান্টিক জীবনের চাওয়া-পাওয়া, সফলতা-ব্যর্থতাকে এতো স্পষ্টভাবে নান্দনিক পরিসরে খুব কম পরিচালকই ধরতে পেরেছেন।
তার মৃত্যু সংবাদ শুনতেই তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো ভিড় করে সামনে এসে দাঁড়ায়। বোম্বের হিন্দি চলচ্চিত্রের আজগুবি জগতে আলাদা ঘরানার এই পরিচালক বাসু চ্যাটার্জির ছবি যারা দেখেছেন, তারা সহজেই তাকে ও তার কাজকে ভুলতে পারবেনা।
বিশেষত সামাজিক ও রোমান্টিক চলচ্চিত্র নির্মাণে তার দক্ষতা প্রবাদপ্রতিম। বাংলাদেশের নায়ক ফেরদৌসকে নিয়ে তার নির্মিত 'হঠাৎ বৃষ্টি' ছবিটি যারা দেখেছেন, তাদের মনে আছে রোমান্টিক কাহিনির চিত্রায়ণে তিনি কতটুকু পারঙ্গম।
সারা জীবন মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-বিরহ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। বোম্বের বাঘা-বাঘা পরিচালকের ক্রাইম, অ্যাকশন, ভায়োলেন্সভিত্তিক ম্যাগাফিল্মের সঙ্গে নিটোল নির্মাণশৈলী ও কাহিনির জোরে লড়াই করেছেন তিনি। একজন শিল্পিত নির্মাতা হিসেবে তার কদর ছিল সর্বজনবিদিত।
বাসু চ্যাটার্জি গুরুত্ব দিতেন কাহিনি ও নির্মার্ণকলায়। গভীর অনুভূতিসূচক কাহিনিকে তিনি সিনেমাটোগ্রাফি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও নেপথ্য সঙ্গীতের আবহে জমিয়ে দিতেন। তার অধিকাংশ ছবির সঙ্গীত পরিচালনায় সঙ্গত কারণেই ছিলেন বিখ্যাত সলিল চৌধুরী।
খুবই স্নিগ্ধ আর হৈচৈ-হট্টগোল ছাড়া ছবি করতেন বাসু চৌধুরী। অল্প কয়জন অভিনেতাকে নিয়েই তার ছবি উতরে গেছে। প্রতিটি চরিত্রকে গভীরভাবে ফোকাস করার মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে কাহিনি ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবন্ত করে তুলতেন।
চলচ্চিত্রের গ্রামার তিনি এতোটাই ভালো বুঝতেন যে, বিশাল স্টেজ, বড় ক্যানভাস, সুপার হিরো-হিরোইন, অনেক কাস্টিং ও রং-বেরঙের কস্টিউমস ছাড়াও তার ছবি নান্দনিক সুষমায় উজ্জ্বল ও জনপ্রিয়। শিক্ষিত, পরিশীলিত, রুচিশীল দর্শকদের পছন্দের তালিকায় তিনি সব সময়ই ছিলেন।
বাসু চ্যাটার্জি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, বোম্বে তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাঙালির অবদান নেহাৎ কম নয়। চলচ্চিত্র শিল্পের উত্থানপর্বের ঐতিহাসিক ধারায় অনেক বাঙালি শিল্পী, পরিচালক, কলাকুশলীর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে তেমনি নামজাদা পরিচালক ছিলেন হৃষীকেশ মুখার্জি ও বসু ভট্টাচার্য।
গত শতকের ৬০ ও ৭০ দশকে বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে উল্লেখযোগ্য আলোড়ন তৈরি করেছিলেন এ দুজন বাঙালি পরিচালক।
চলচ্চিত্রে বাসু চ্যাটার্জির বিকাশ হৃষীকেশ মুখার্জি হাত ধরে। পরিচালক বসু ভট্টাচার্যর পৃষ্ঠপোষকতাও তিনি পেয়েছিলেন। তিনি হৃষীকেশ মুখার্জি এবং বসু ভট্টাচার্যের সহকারী হিসাবে চিত্রনির্মাণ করেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ছিল তিসরি কসম। রাজ কাপুর ও ওয়াহিদা রহমান অভিনীত তিসরি কসম চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিল।
মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে সিনেমা বানানোর দিকেই ছিল বাসু চ্যাটার্জির বিশেষ প্রবণতা ও ঝোঁক। সামাজিক আখ্যানভিত্তিক ছবিই প্রধানত তিনি নির্মাণ করেছে। বাসু চ্যাটার্জির প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র সারা আকাশ (১৯৬৯)। এই ছবিটির জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
চিত্রনাট্য, সংলাপ রচয়িতা , কাহিনিকার, পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে তিনি শতাধিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি কিছু বাংলা সিনেমা ও টিভি সিরিয়াল পরিচালনা করেন। তার বিখ্যাত কিছু ছবির মধ্যে রয়েছে সারা আকাশ, রজনীগন্ধা, ছোটি সে বাত, স্বামী, গোধূলি, ত্রিশঙ্কু ইত্যাদি।
বাঙালি বাবু হলেও বাসু চ্যাটার্জি হিন্দি চলচ্চিত্রে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কারণ তিনি জন্ম নেন হিন্দিভাষী অঞ্চলে, ১৯৩০ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতের রাজস্থান প্রদেশের ঐতিহাসিক আজমির শহরে। তার বহু ছবিতেই উত্তর ভারত তথা জন্মস্থান রাজস্থানের প্রকৃতি, পরিবেশ ও নিসর্গের ব্যবহার রয়েছে।
বিশেষত 'হঠাৎ বৃষ্টি' ছবিতে প্রত্নঐতিহ্য ও মরুময় জয়সলমীর চমৎকারভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম রাজস্থানের থর মরুভূমির মাঝখানে পাকিস্তানের সীমান্ত ঘেঁষা জয়সলমীরের বিরাণ ও ঊষর প্রান্তরে বাঙালি যুবকের (ফেরদৌস) প্রেম ও বিরহ ছবিটিকে দর্শকপ্রিয় করেছে। অচেনা ও নবাগত ফেরদৌসকেও এই ছবি বিখ্যাত করেছে। এমন অনেকেই লাইম লাইটের আলোয় এনেছেন মেধাবী পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি।
বাসু চ্যাটার্জিকে লড়তে হয়েছে পর্বত-সদৃশ্য রাজ কাপুর এবং দিলীপ কুমারের ইমেজের বিরুদ্ধে সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে। তাকে লড়তে হয়েছে বিখ্যাত নায়কের মিছিলের বিরাট বাজেটের চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধেও, যেখানে ছিলেন সুনীল দত্ত, অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র, বিনোদ খান্না, শত্রুঘ্ন সিনহার মতো সুপারস্টার। তবু তিনি নতুন ও অচেনাদের দিয়ে বিকল্প জগৎ নির্মাণ করতে সফল হয়েছেন। যেখানে দর্শকরা নিজের স্বপ্নের অদেখা জগতকে রূপালি পর্দায় পেয়েছে।
বোম্বের অন্য পরিচালকের মতো বাসু চ্যাটার্জি স্বপ্ন ও ফ্যান্টাসির তোপ দেগে দেননি দর্শকদের মগজে। বরং দর্শকের সুপ্ত মনস্তাত্ত্বিক স্তরের অবচেতনে যে অসফল বা চাপা পড়া স্বপ্ন আছে, তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ ও তাদের দৈনন্দিন স্বপ্ন-সংগ্রামই ছিল তার উপজীব্য।
নায়ক অনিল কাপুর তার অভিনয় জীবনে বাসু চ্যাটার্জির ভূমিকা স্বীকার করে বলেছেন, তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে। চলতি পথের বাইরে। বিকল্পের উদ্ভাবক। মেধা ও স্বকীয়তায় অগ্রগামী।
বিশিষ্ট পরিচালক মাধুর ভাণ্ডারকার মনে করেন, বাসু চ্যাটার্জির নাম চিরস্মরণীয় থাকবে এইজন্য যে তিনি সিরিয়াস সামাজিক ইস্যুকে হালকা চালে ও হাস্যকৌতুকের সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছেন। মানুষের জীবনের সীমাহীন অপ্রাপ্তির পরেও তার ভেতরে লুক্কায়িত রোমান্টিক স্বপ্নটিকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। শত বেদনা ও হতাশায় আকীর্ণ সামাজিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সুপ্ত সৌন্দর্যকে তার মতো সফলতায় খুব কম পরিচালকই তুলে ধরতে পেরেছেন।
বোম্বের বহু চলচ্চিত্রজন শোকবার্তায় এমনটিই জানিয়েছেন যে, চলচ্চিত্র মাধ্যমকে মানুষের হৃদয়স্পর্শী করার কৃতিত্ব তার। সাধারণ টেকনিক ও সরল উপস্থাপনায় তিনি সেটা করেছেন। কঠিন কঠিন সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ইস্যুকে সহজে ধারণ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি সেলুলয়েডে স্বপ্ন বিনির্মাণ করতে পারতেন।
৯০ বছরের সুদীর্ঘ জীবন চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকলেও বাসু চ্যাটার্জী মুম্বাই থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড Blitz-এ অঙ্কনশিল্পী এবং কার্টুনিস্ট হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তবে জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে সিনেমার স্বপ্নময় রূপালি জগতকেই তিনি আপন করে নেন। মৃত্যুর উড়ালপথে তিনি সিনেমার স্বপ্নময় জগত থেকে চলে গেলেন চিরকালের স্বপ্নের দিনে।