অনেকক্ষণ ডুবে থাকতে পারে ছোট ডুবুরি



বিভোর বিশ্বাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
ভয় পেয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ছোট-ডুবুরির দল। ছবি: ইনাম আল হক

ভয় পেয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ছোট-ডুবুরির দল। ছবি: ইনাম আল হক

  • Font increase
  • Font Decrease

নির্জন জলাভূমি আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো নানাভাবে মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ায় আজ গভীর সংকটে জলজ প্রাণীরা। তাদের জীবন আজ টিকে থাকার সংগ্রামমুখর। বাংলাদেশের অন্যতম জলচর পাখি ‘ছোট-ডুবুরি’। এর ইংরেজি নাম Little Grebe।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, এ পাখিটা সবার চোখের সামনে আছে অথচ চোখে ধরা পড়ে না- সেটা হলো আমাদের ‘ছোট ডুবুরি’। পৃথিবীতে ‘ডুবুরি’ পাখি আছে মাত্র ২০ প্রজাতির। আর আমাদের দেশে ১টি মাত্র প্রজাতি আর সে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট-ডুবুরি। সে সারাবছর আমাদের দেশে থাকে। অন্যডুবুরিরা শীতে আসে এখানে। ২৫ থেকে ২৯ সেন্টিমিটারের পাখি সে।

তিনি আরো বলেন, ‘এই জলজপাখিটা অতি সুন্দর একটা পাখি। হঠাৎ ডুবে যায়; অনেকক্ষণ পর অনেক দূরে গিয়ে ভেসে ওঠে। পানির নিচে থাকার তার কোনো ইচ্ছে নেই; একমাত্র ভয় পেলেই কেবল সে এটা করে। বাচ্চা হলে বাচ্চাদের সঙ্গ নিয়ে পানিতে ভেসে বেড়ায়; এতো সুন্দর লাগে দেখতে তখন! বর্ষাকালে প্রজনন মৌসুমে ওর গলাটা খয়েরি রং ধারণ করে। এমনিতে সে হালকা মেটে রং। জলজউদ্ভিদের সাথে সহজে মিশে যায়; দেখা যায় না।’

একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট-ডুবুরি। ছবি: ইনাম আল হক

ভেসে থাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ডুব দিয়ে সে বহুক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে এরকম পাখি খুব কম আছে। যেমন- পানকৌড়ি। কারণ ওর ডানার পালকগুলো পানিতে ভিজে যায়। ভিজলে পানির নিচে থাকা যায়। যে পালক পানিতে ভিজে না; সেগুলো পানির নিচে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না; কিন্তু ডুবুরি আবার ভিন্ন। ডুবুরি পালক কিন্তু পানিতে ভিজে না। ওর পালকটা তুলার পিন্ডর মতো; সহজে ভেতরে পানি ঢুকে না।

‘সে পায়ের জোরে পানির একেবারে নিচে যেতে পারে। ওর পা আবার ভিন্ন। সাধারণত পাখির পা যেমন থাকে তেমন নয়। ওর প্রতিটি আংগুল অনেকখানি চওড়া চওড়া; একেবারে গাছের পাতা বা বৈঠার মতো। ফলে ছোটডুবুরি সহজে পানিতে ঢাক্কা দিয়ে নিচে চলে যেতে পারে।’

ভিন্ন নাম প্রসঙ্গে ইনাম বলেন, এরা বাইক্কাবিলসহ চা বাগানের বিভিন্ন নির্জন জলাশয়গুলোতে আছে। সে পানির যে কোনো জায়গা টিকে থাকতে পারে। সে জলে বিচরণ করা পোকামাকড়, লতাপাতা, ক্ষুদে মাছের পোনা এগুলো খেয়ে দিব্বি দিন কেটে যায়। বাংলাদেশের প্রতিটি ডুবায় এরা এক সময় ছিল। আমি প্রায় ৩০ বছর আগেও তাকে সব জায়গায় দেখেছি। তখন মানুষ চিনতো। এখন তো মানুষ চিনে না। যদি আপনি বলেন- ‘ডুবুরি’ বলে কোনো পাখি আছে? চিনবে না। বাংলাদেশের বেশিভাগ গ্রামের লোকেরা এই পাখিটাকে বলে ‘ছ্যারছ্যারি’। ও ভয় পেলে পানির উপর দিয়ে অনেক দূরে উড়ে যায় বলে এই নাম।

ছোট-ডুবুরির দল। ছবি: ইনাম আল হক

তিনি আরো বলেন, শীতের দিনে পানি কমে গেলে ওরা একত্রিত হয়ে দল বেঁধে থাকে। কোনো কোনো দলে ১০০/২০০ পাখিও আমি খুঁজে পেয়েছি। এখনো কোনো কোনো বিলে আমি দেখতে পাই তাদের। লোকে নৌকা নিয়ে গেলে ওরা পানির উপর দিয়ে ভয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতো। এমন একটা ভাব তার যে- না উড়ছে, না ডুবছে। সে পানির উপর দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে।

পাখিটি ছোট থাকায় সুবিধে হলো- খাবার কম লাগে। অল্প জায়গায় থাকাসহ সহজে লুকতে পারে। আর অসুবিধা হলো- এর ডিমটা খুবই ছোট। ফলে টিকটিকি, গিরগিটি, অঞ্জন প্রভৃতি সরীসৃপরা এর ডিম খেয়ে ফেলতে পারে। এছাড়াও চিল, গুইসাপ প্রভৃতি ওর শত্রু রয়েছে। ও তো পানির উপরের পাতার মধ্যেই ডিম পাড়ে; ডিমে তা দেয়া, ছানাদের বড় করা এ বড়ই কঠিন কাজ। ও আগে যেসব প্রাকৃতিক বিল-হাওরগুলোতে ছিল, এখন তো এসব প্রাকৃতিক বিলে মানুষের আনাগোনা। নিড়িবিলি থাকতে দিচ্ছে না। প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো কোনো না কোনোভাবে ব্যবহার করে ফেলা হচ্ছে বলে জানান প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।

১১টি তিলা মুনিয়া পাখি উদ্ধার এবং অবমুক্ত



বিভোর বিশ্বাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
তিলা মুনিয়া পাখিদের খুনসুটি। ছবি: এবি সিদ্দিক

তিলা মুনিয়া পাখিদের খুনসুটি। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা থেকে সম্প্রতি ১১টি তিলা মুনিয়া (Sealy-breasted Munia) পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এ সময় জবাই করা ১০টি তিলা মুনিয়া পাখিসহ একজনকে আটক করা হয়েছে।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, শুক্রবার (৩১ মার্চ) সন্ধ্যায় উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমা চা বাগানের বাঘাছড়া এলাকা থেকে এক শিকারী আটক করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে ১১টি পাখিসহ শিকারের করা ফাঁদ জব্দ করেছে বন্যপ্রাণী বিভাগ।

আটক শিকারী উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের কানাইদেশী গ্রামের তাজ বক্সের ছেলে আনছর আলী (৫০)। এসময় দুই শিকারি পালিয়ে যায়। আশরাফুল মিয়া ও আজিবুর। তাদের দুই জনের বাড়িও একই উপজেলার রাজকান্দি গ্রামে।

কুরমা চা বাগানের বাঘাছড়া হাওড় হতে শিকার করার সরঞ্জাম, ১টি দা, ২টি বাইসাইকেল ১টি মোবাইল ফোন ও ১টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। বন্যপ্রাণী বিষয়ক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।

বাসা তৈরির জন্য উপকরণ নিয়ে যাচ্ছে তিলা মুনিয়া। ছবি: এবি সিদ্দিক

বন্যপ্রাণী রেঞ্জের রেঞ্জকর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, গোপন সূত্রের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। জবাই করা ১০টি তিলা মুনিয়া পাখি জব্দ করার পাশাপাশি একই সঙ্গে জীবিত ১১টি মুনিয়া পাখি উদ্ধার করে ঘটনাস্থলেই অবমুক্ত করে দেয়া হয়। জবাই করা পাখিগুলোকে মাটিতে পুতে ফেলা হয়। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে। এর আগে গত ১৮ মার্চ একই এলাকা থেকে জবাই করা ৩৮টি তিলা মুনিয়া জব্দ করে মাটিতে পুতে ফেলা হয়েছিল। তখন শিকারিরা পালিয়ে যায় বলে জানান তিনি।

তিলা মুনিয়া অতিপরিচিত গায়ক পাখি। বেশ সুরেলা গলা তার। এ দেশের শহর-বন্দর-গ্রামে প্রচুর দেখা যায়। লম্বায় ১১.৫ সেন্টিমিটার। মাথা থেকে লেজের ডগা জলপাই-বাদামি। চিবুক গাঢ় রঙের। বুকের ওপরটা খয়েরি। পেট কালচে-বাদামি, তাতে সাদা ফোঁটা থাকে। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। মুনিয়া বেশ চঞ্চল।ফসলের খেত, মাঠ, নলখাগড়ার বন, বাগান প্রভৃতি স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ে বেড়ায়।

এ পাখিটি অতি সুন্দর। এজন্য অসাধু পাখিশিকারীরা তাকে জাল, ফাঁদ প্রভৃতির সাহায্যে ধরে পাখিপ্রেমীদের নিকট উচ্চমূল্যে বিক্রয় করে থাকেন। তবে দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে অন্যান্য পাখির মতো এই পাখিও ধরা, পালন করা, হত্যা করা কিংবা খাওয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।

;

জুবায়ের সিদ্দিকী ছিলেন সিলেটে শিক্ষাবিপ্লবের সমর নায়ক



সাঈদ চৌধুরী
জুবায়ের সিদ্দিকী

জুবায়ের সিদ্দিকী

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.) ছিলেন সিলেটে এক নীরব শিক্ষা বিপ্লবের মহানায়ক। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। অন্তঃকরণে এই একটাই ভাবনা ছিল। স্কলার্স হোম ছিল তার স্বপ্নপূরণের গন্তব্য। তার অন্তঃকরণ কল্পনাতীত ভাবেই উদার ও সুপ্রশস্ত ছিল।

জুবায়ের সিদ্দিকী মূলত একজন অকুতোভয় সৈনিক, সফল শিক্ষাবিদ ও খ্যাতিমান লেখক। নিয়মানুবর্তী এই মানুষটার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই হৃদয়ের কোণে জমে আছে অফুরান ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা। তার নতুন দুটি মাইলফলক অর্জন, একজন সমর নায়ক থেকে শিক্ষক ও লেখক হিসেবে সফল উত্তরণ আমাদের চোখের সামনেই। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তাকে কাছে থেকে দেখেছি। তাই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারি, এই বহুমুখী শিল্প সাধকের অনেকগুলো উত্তম গুণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিরল। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবনের অধিকারী।

হঠাৎ এই আলোর প্রদীপ নিভে যাবে তা ভাবতে পারিনি। ইন্তেকালের কিছুদিন আগে তার শিক্ষা বিপ্লব নিয়ে কথা হয়েছিল। এক্ষেত্রে তিনি আমাকে প্রেরণা সঞ্চারকারী ভাবতেন। সিলেটে ইংরেজি মাধ্যমে খাজাঞ্চীবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের যাত্রা আগে শুরু হলেও আমাদের বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলকে (বিবিআইএস) তিনি নতুন মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে তার শিক্ষা কার্যক্রম ও ক্যাম্পাস বৃদ্ধির সর্বশেষ অগ্রগতি শেয়ার করতেন। এ নিয়ে কিছু লেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু লেখার আগেই তিনি চলে গেলেন তার শেষ ঠিকানায়, মহান মাবুদের কাছে।

২০২০ সালের ৯ মার্চ বাহাত্তর বছরে পা রাখেন প্রবীণ এই কৃতি ব্যক্তিত্ব। বয়সের কারণে তাকে প্রবীণ বললেও এক উজ্জল তারুণ্য তার মাঝে ছিল বিদ্যমান। সৈনিক জীবন থেকে অবসরে এলেও কর্মজীবনে কোন বিরতি গ্রহণ করেননি। তার সর্বশেষ সাধনার ক্ষেত্র ছিল হাফিজ মজুমদার ট্রাস্টের শিক্ষা প্রকল্প ‘স্কলার্স হোম’।

১৯৯৭ সালে আমরা বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস) প্রতিষ্ঠার পর সিলেট অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কলার্স হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বর্তমানে এর ছয়টি শাখা রয়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। সেখানে হাজার হাজার কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জীবন গড়ার প্রধান কারিগর এই জুবায়ের সিদ্দিকী। সিলেটে এক নিরব শিক্ষা বিপ্লবের তিনি ছিলেন সমর নায়ক।

কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। মানব কল্যাণে জীবন উৎসর্গকারী হাফিজ মজুমদার ঠিকই চিনতে পেরেছেন সিলেটের দুই রত্নকে। একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.) আর অন্যজন হলেন বৃটেনে সাড়া জাগানো মেইনস্ট্রিম পলিটিশিয়ান ও শিক্ষাবিদ ড. কবীর চৌধুরী। এই কৃতি ব্যক্তিত্বরা সিলেট অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে রেখেছেন অপরিমেয় অবদান। এ এক বিরাট জাগরণ।

স্কলার্স হোম যেন খুলে দিয়েছে রূপকথার দরজা৷ জুবায়ের সিদ্দিকী বুঝতে পেরেছিলেন, আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে কত পিস মিগ বিমান এল তার চেয়ে কতটা ছেলে-মেয়ে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হল তা অনেক বেশি গুরুত্বপর্ণ। উন্নত বিশ্বের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন তিনি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছি, সেখানে আধুনিক শিক্ষার উপরে যে থিসিস হয়েছে তা জানতে গিয়ে তার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি মনে করতেন, সিলেটে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী হবে, যদি সেখানে স্থানীয় শিক্ষার্থী ভর্তি হতে না পারে! স্কলার্স হোমকে তিনি সে ঘাটতি পূরণের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করতে পেরেছেন। আরও বিশাল মহীরূহে পরিণত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন।

জুবায়ের সিদ্দিকী সৈনিক জীবন থেকে সিভিলিয়ান জীবনে ফিরে এলেও সময় নষ্ট করার মত সাধারণ্যে তিনি ফিরে আসেননি। এজন্য পরিচিত মহলেও তার কিছুটা দূরত্ব ছিল। এটা তিনি সহজভাবে স্বীকার করতেন। সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা ও দলাদলির এই দেশে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে জুবায়ের সিদ্দিকী সামাজিক ও রাজনৈতিক বেড়াজাল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি কখনও কোনো দল বা মতের পক্ষে কথা বলেননি।

সৈনিক জীবনে অনেক দক্ষ ও সাহসী ভূমিকার ফলে পর্যায়ক্রমে জুবায়ের সিদ্দিকী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কুয়েতের স্বাধীনতা রক্ষায় তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। ১৯৯০ সালে ইরাক অতর্কিতে কুয়েত দখল করলে আমেরিকা সেখানে যৌথবাহিনী পাঠায়। বাংলাদেশ থেকেও আড়াই হাজার সৈন্য অংশ নেয়। বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন জুবায়ের সিদ্দিকী।

কর্মজীবনে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জুবায়ের সিদ্দিকী ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে ৩২ বছরের সেনাবাহিনী জীবনের ইতি টানেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.)’র আত্মজীবনিমুলক বই ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ পড়লে মুগ্ধ হতে হয়। এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রখ্যাত কবি, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মোফাজ্জল করিম বলেছিলেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকীরা সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন করেছেন। জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করেই মহাপুরুষে পরিণত হয়েছেন। দেশকে সুন্দর করতে সমৃদ্ধ করতে সোনালী ভবিষ্যতের জন্যে প্রয়োজন তারমত দেশপ্রেমিক নিষ্কলুষ মানুষের।

সিলেটে এক সময় আমার সহযোদ্ধা দাপুটে সাংবাদিক ও বাম রাজনীতিক শামীম সিদ্দিকীর বড় ভাই আমাদের প্রিয় জুবায়ের সিদ্দিকী ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বুধবার ভোরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। ২৪ মার্চ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে তাকে সিলেটের হার্ট ফাউন্ডেশনে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই দিন বিকেলে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মারা যান।

জুবায়ের সিদ্দিকী স্মরণে দেশে ও প্রবাসে অনেক অনুষ্ঠান হয়। গত বুধবার (২২ মার্চ) সকালে স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মুনীর আহমেদ কাদেরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জুবায়ের সিদ্দিকী বৃত্তি প্রদান ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ইয়াসমিন সিদ্দিকী, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, ট্রাস্টের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ছয়ফুল করিম চৌধুরী হায়াত।

ফারজানা মুর্শেদের সঞ্চালনায় এসময় আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন হাফিজ মজুমদার ট্রাস্টের যুগ্ম সচিব খায়রল আলম, মদনীবাগ ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ আক্তারী বেগম,পাঠানটুলা (প্রাথমিক) ক্যাম্পাসের ইনচার্জ জেবুন্নেছা জীবন, মেজরটিলা ক্যাম্পাসের নাহিদা খান, মোস্তাফিজুর রহমান ও শরিফ উদ্দিন। কবিতা আবৃত্তি করেন গণিত বিভাগের প্রভাষক বাপ্পি কুমার মজুমদার, দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাওদুরা রহমান আরিশা। জুবায়ের সিদ্দিকীর মহৎকর্ম নিয়ে ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করেন আইসিটি বিভাগের প্রভাষক জাহিদুল ইসলাম।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী (অব.) ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এবছর বিভিন্ন শ্রেণির ১৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তারা এই মহতি মানুষের অবদান স্মরণ করে নতুন প্রজন্মকে সেভাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমীন।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

;

১৩টি ‘মহাবিপন্ন’ বাংলা শকুনের মৃত্যু



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বাংলা শকুন। ছবি: বন বিভাগ

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বাংলা শকুন। ছবি: বন বিভাগ

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি প্রাণ হারিয়েছে ১৩টি মহাবিপন্ন বাংলা শকুন (White-ramped Vulture)। তবে এদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। বিষক্রিয়াজনিত কারণে এদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ দাবি করেছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) সকালে সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কালারবাজারের কাছে বড়কাপন গ্রামের বুড়িকোনা বিল থেকে বনবিভাগের কর্মকর্তারা ১০টি মৃত শকুন উদ্ধার করেন। পরে সেদিন দুপুরে সেখান থেকে আরও ৩টি মৃত শকুন উদ্ধার করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর সর্বশেষ ২০১৪ সালে জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬০টি শকুন ছিল। এর মধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ছিল ৮০টি। এই ১৩টি শকুনের মৃত্যুর পর সংখ্যাটি আরও কমে গেল।

মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুস ছামাদ বলেন, ‘মৃত ১০টি শকুন আইইউসিএন কর্মকর্তারা বস্তায় করে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। এগুলো ১০-১২ দিন আগে মরেছে বলে ধারণা করছি। সব পচে-গলে গেছে। শকুনগুলোর মৃত্যুর কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিলেট ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছি। ধারণা করছি, মৃত গরু, ছাগল, কুকুর বা শিয়ালের মাংশ খেয়ে শকুনগুলো মারা যেতে পারে। অনেক সময় গরুর চিকিৎসায় নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় এবং কুকুর-শিয়াল নিধনে গ্রামগঞ্জে বিষ জাতীয় পদার্থ ব্যবহৃত হয়। এই প্রাণীগুলোর কোনোটি মারা যাওয়ার পর তার মাংস শকুন ভক্ষণ করলে তারাও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।’

ঘটনাস্থলে বনবিভাগের কর্মকর্তাগণ। ছবি: বন বিভাগ

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, ‘মহাবিপন্ন বাংলা শকুন এক সঙ্গে এতগুলো মারা যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যাপক খোঁজাখুজির পর আরো তিনটি শকুন মৃত অবস্থায় পেয়ে উদ্ধার করেছি। এর আগে ১০টি মৃত শকুন আইইউসিএনের কর্মীরা সিলেটে নিয়ে গেছেন। অর্থাৎ মোট ১৩টি শকুন বা তার বেশি মারা গেছে।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, বিষক্রিয়ায় শকুনগুলো মারা গেছে। এই শকুনগুলোর মৃত্যুর ব্যাপারে স্থানীয় কেউই তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করেনি। তবে এই শিশু আমাদের জানিয়েছে এই এলাকায় শিয়াল একাধিক ছাগল খেলে ফেলায় মৃতছাগলের পরিত্যক্ত মংশে বিষ মিশিয়ে দেয়া হয় শিয়ালদের মারার জন্য। সেই বিষ থেকে শকুনগুলো মারা যেতে পারে বলেও আমাদের ধারণা। তবে সিলেট ল্যাব থেকে রিপোর্ট পেলে শকুনগুলোর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে মৌলভীবাজার মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পাখি গবেষকেরা বলছেন, পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া দুটি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই মূলত শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। এই দুইটি ওষুধ খাওয়া প্রাণীর মাংস খাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায় শকুন।

পাখি বিশেষজ্ঞ, পাখিপ্রেমী এবং পরিবেশকর্মীদের জোর দাবীর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকার ২০১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক এবং ২০১৭ সালে দেশের দুইটি এলাকায় কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

;

পাখি ও বন্যপ্রাণীদের দুঃসময়



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনের বিপন্ন প্যারাপাখি। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কমেছে পাখির আবাসস্থল। ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।

বৈশ্বিক পাখি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ ভাগ। বিগত দুশো বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের খয়রাপাখা মাছরাঙা পাখি। ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি বিশেজ্ঞরা বলছে, বনের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারণে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলেও কাজে আসছে না তার সুফল।

পাখি বিশেজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে পাখি সংখ্যা কমলেও ভারত অংশে সুন্দরবনে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের পাখি-বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’। ‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামের সেই বইটিতে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতিটি পাখি প্রজাতির ছবি-সহ বিশদ বর্ণনা নথিভুক্ত হয়েছে।

‘বার্ডস অফ দ্য সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার’ নামক বই।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সুন্দরবনে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখি মিলিয়ে রয়েছে ৪২৮টি প্রজাতি। দেশে প্রাপ্ত ১২টি প্রজাতির মাছরাঙার ৯টিরই দেখা মেলে এই অঞ্চলে। সেইসঙ্গে গোলিয়াথ হেরোন, স্পুনবিল স্যান্টপিপার, হুইমবেল, লার্জ ইগ্রেট, টেরেক স্যান্ডপিপার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্রোভারের মতো বিরল প্রজাতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই অঞ্চলে।

যা ইতিবাচক দিক হিসেবেই মনে করছেন ভারতের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। ভারতে বর্তমানে ১৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই বাসিন্দা সুন্দরবনের। বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে যা রয়েছে শীর্ষস্থানে। আবাসস্থল ও অবাধে চলাচলের জন্যে বাংলাদেশ অংশের পাখিরা ভারত অংশের সুন্দরবনে নিজেদের নিরাপদ মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

অন্যদিকে, কমতে থাকায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী - তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন এর ‘লাল তালিকা’ দেখা যেতে পারে। সেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ ভাগ। গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ২ ভাগ।

;