আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাক দম্ভের পতন
“পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে জানা অসম্ভব। রেডিও পাকিস্তানের ভাষ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই মূলত পূর্বাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। ভারতীয় প্রতিবেদন অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত, ১৬ হাজার শক্তিশালী পূর্ব পাকিস্তানি (বাঙালি) রাইফেলস সদস্য ও পুলিশ টিক্কা খানের বাহিনীর মোকাবেলা করছে এবং দু’দিনের জনযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছে (সংখ্যা ১০ হাজার না লাখ, জানা নেই)। এখন স্পষ্টতই পৃথিবী জেনে গেছে পাকিস্তান টুকরা হয়ে গেছে; অলৌকিক কোনো রাজনৈতিক ঘটনা ছাড়া পাকিস্তানকে আর এক করা সম্ভব নয়।”
সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের সম্পাদকীয়- ২৯ মার্চ, ১৯৭১
যুদ্ধ যখন ঠেকানো যায় না, তার পূর্বাভাস বহু আগে থেকেই মেলে। তার পেছনে থাকে সুস্পষ্ট কারণ, বহু দিনের জমে থাকা অন্যায়, শোষণ, অসম আচরণ। সেনাবাহিনীর বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমন-পীড়নের ইতিহাস পৃথিবীতে যেমন নতুন নয়, তেমনি মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের কাছে সামরিক অস্ত্র বা অক্ষশক্তির ন্যাক্কারজনক পরাজয়ও বারবার এসেছে নতুন রূপ নিয়ে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের থেকে ডিসেম্বরের টাইমলাইনে এসে স্বাধীনতাকামী মানুষের যে বিজয়, সেটি কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভই নয়; মানবতার খেরোখাতারও একটি বিজয়ী অধ্যায়।
পাকিস্তানি, তথা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বা নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ অনেকটা লম্বা সময় ধরেই নিজেদের পরিণতি সম্বন্ধে আন্দাজ করতে বা মেনে নিতে পারেননি। সে জন্য, দমন নিপীড়ন হিংস্রভাবে জারি রাখলেও বারবারই তারা দম্ভোক্তি করে গেছেন। দেশীয় তো বটেই, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতেও তাদের স্বর ন্যূনতম নত হয়নি কখনো। সেই সাথে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তারা নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করেছেন, এমনকি তাদের বহিষ্কারও করেছেন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনে ১৯৭১ সালের ৭ মে প্রকাশিত একটি ‘সেন্সর’ করা সংবাদে টিক্কা খানের ভাষ্য ছিল এ রকম—
“আমাদের বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা ছাত্র কিংবা কোনো একক দলকে আক্রমণ করিনি। যখন আমাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, আমরা পাল্টা গুলি চালিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় তো বন্ধ ছিল। যেখানে যারা ছিল তাদের থাকার কোনো কারণ ছিল না। যারা ভেতরে ছিল, তাদের বেরিয়ে আসতে বলেছি, তখন তারা গুলি চালায়। আমাদের তখন পাল্টা গুলি চালাতে হয়েছে। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করেছি, তাৎক্ষণিকভাবে শক্ত ব্যবস্থা নিলে পরের ক্ষয়ক্ষতি যা সাধারণত ঘটে থাকে, এড়ানো সম্ভব হয়।”
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ৩৫ জন বিদেশি সংবাদদাতাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করে, এমনকি তাদের নোট বইও বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায় যে, উত্তর ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে বের হলে তদের গুলি করার হুমকি দেয় পাক সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সাংবাদিকেরা হোটেল থেকে দেখতে পেয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানি বিদ্রোহীদের সমর্থনকারী নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনকে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গুলি করছে। করাচির উদ্দেশ্যে সাংবাদিকদের উড়োজাহাজে উড়োজাহাজে তোলার আগে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি শ্যানবার্গসহ অন্য সাংবাদিকদের তল্লাশি চালানো হয়। তাদের নোটবই, ছবির ফিল্ম ও ফাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়।
তবে এই দম্ভ মিলিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে স্বাধীনতার সংগ্রামের কাছে। ১৫ ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ছেড়ে অপমানিত হয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কেননা, বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া তার কোনো উপায়ও ছিল না। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা ও চাপের মুখে ভুট্টো একেবারেই ভেঙে পড়েন এবং নিজের কাগজপত্র দুমড়ে ফেলে চেয়ার ঠেলে চলে যাওয়ার আগে বলেন, এই পরিষদের সদস্যদের মুখ তিনি আর কখনো দেখতে চান না। ১৫ ডিসেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে বিশেষ প্রতিবেদক হেনরি ট্যানারের লেখায়, কাউন্সিল ত্যাগ করার আগে মিস্টার ভুট্টোর বক্তব্য ছিল এ রকম—
“মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি বিশ্বাসঘাতক নই। আমি জীবনেও কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমি অনেকবার হত্যাচেষ্টার সম্মুখীন হয়েছে, জেলও খাটতে হয়েছে আমার। আজ আমি কোনো দুমুখো আচরণ করছি না, তবে আপনার এই সিকিউরিটি কাউন্সিল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।”
মিস্টার ভুট্টো দাবি করেন যে, যে শর্ত বা চুক্তিতে সম্মত হওয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটি তার নিজের এবং দেশের জন্য অপমানজনক। এ জন্যই তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। এই কাউন্সিলে তিনি থাকার এতটুকুও প্রয়োজন বোধ করেন না।
তবে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভুট্টো আদতে অপমান ঘাড়ে নিয়েই বের হয়ে গিয়েছেন। দাম্ভিক জুলফিকার আলী ভুট্টোর পোর্ট্রেয়াল একজন অপমানিত ব্যক্তি হিসেবেই বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল।
আত্মসমর্পণের আগ দিয়ে ইন্ডিয়ান চিফ অব স্টাফ জেনারেল মানেকশ’ পাক জেনারেল নিয়াজীকে একটি মেসেজ পাঠান, যাতে আত্মসমর্পণের পাশাপাশি বারবারই তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এই বার্তায় স্পষ্টতই পাকিস্তানি সামরিক শক্তির ভঙ্গুর এবং ভীত অবস্থা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমসে এই বার্তাটি হুবহু তুলে ধরা হয়।
পাকিস্তানি সামরিক শক্তির নৃশংস অপরাধ ও অত্যাচারের পাশাপাশি সব সময়ই স্পষ্ট ছিল গণমাধ্যমের প্রতি দম্ভোক্তি এবং বলপ্রয়োগ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দম্ভোক্তির তেজ আর থাকেনি, বরং তা পরাজয় আর অপমান আর ভীতির সাথে সাথেই শেষ হয়েছে। লন্ডন টাইমসে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ‘পাকিস্তানি জেনারেল, নেয়ার টু টিয়ারস, সাইনস অ্যাট রেসকোর্স সেরেমনি’ বা এ রকম অজস্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও পাকিস্তানি দম্ভের পতন বারবারই ফুটে উঠেছে সে সময়; যা প্রকারান্তরে গণমাধ্যমেরও একটি প্রতিশোধ বা উচিত জবাব ছিল বটে!
কৃতজ্ঞতা ও তথ্যসূত্র
বহির্বিশ্বে গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : সুরমা জাহিদ সম্পাদিত, (অনিন্দ্য প্রকাশ)
বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভ
নিউইয়র্ক টাইমস
স্মিথসোনিয়ান