‘কারাগারে থেকেই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি’
‘ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম। ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, মার্শাল ‘ল’ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ‘ল’ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হই। পরে সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এক বছর কারাবরণ করি। কারাগারে থেকেই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হলে আমিও মুক্তি পাই’। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মনছুরুল হক এসব কথা বলেন।
মনছুরুল হক বলেন, ‘১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর তালবাহানায় আমরা বুঝে ফেলি স্বাধীনতার বিকল্প নাই। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ আইনজীবী আক্তারুজ্জামানকে আহবায়ক করে লক্ষ্মীপুরে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আমি ছিলাম ওই কমিটির সদস্য। লক্ষ্মীপুর পুরাতন আদালত ভবনের বার লাইব্রেরীর ২য় তলায় ছিল আমাদের অফিস’।
তিনি আরও বলেন, ‘২৫ ও ২৬ মার্চের বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক বাহিনীর সদস্য ধনুর চাইনিজ রাইফেল, বাঙ্গাখাঁর আবুল কাশেমের একটি স্টেনগান ও ৩টি ত্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে আমরা লক্ষ্মীপুরে প্রথম ইউনিট গঠন করি। এপ্রিল মাসের ৪ কিংবা ৫ তারিখে লক্ষ্মীপুরের ছাত্রদের নিয়ে একটি দল গঠন করে ভারতে চলে যাই। রায়পুরের আওয়ামী লীগ নেতা মাওলানা ইপ্তেহাদীর সাথে সেখানে দেখা হয়’।
মুক্তিযোদ্ধা মনছুরুল হক বলেন, ‘হাই কমান্ডের নির্দেশে আরও একটা গ্রুপকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ভারত থেকে দেশে চলে আসি। দ্বিতীয়বার আবারও ভারতে গেলে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য আমাদেরকে উত্তর প্রদেশের দেমাগিরি আন্ডার গ্রাউন্ড ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে মিয়ানমার হয়ে নাফ নদী পার হয়ে আমরা চট্টগ্রাম আসি। সেখানে আমি স্কট লিডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। তিব্বতের স্বাধীনতা কামী একটি দল, যারা মাউন্ট ব্যাটালিয়ন হিসাবে পরিচিত তাদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনির একটি দলকে আমরা পরাজিত করি। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। যুদ্ধ শেষে নিজের আবাসস্থল লক্ষ্মীপুরে ফিরে আসি’।
জানা গেছে, ১৯৫০সালের ৮ই মে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ভেন্ডর বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন মনছুরুল হক। তারা পিতা মরহুম রহমত উল্যাহক ও মাতা আনোয়ারা বেগম। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তার বড় মেয়ে তামান্না আফরোজ হক ঢাকার একটি কলেজের প্রভাষক ও ছেলে এহতেশাম উল হক রবিন পেশায় আইনজীবী।
বর্তমান লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের প্রথম নির্বাচিত ভিপি ছিলেন মনছুরুল হক। তিনি ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক পদের দায়িত্ব পান।
মনছুরুল হকের কর্মজীবন, ১৯৭৬ সালে দত্তপাড়া ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন তিনি। পরে তিনি লক্ষ্মীপুরে একটি মহিলা কলেজের প্রয়োজন অনুভব করেন। এর থেকেই লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৭ সালের ১২ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজ সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০১ সালে অধ্যক্ষ তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে মনোনীত হন। তার প্রতিষ্ঠান লক্ষ্মীপুর সরকারি মহিলা কলেজ দুই বার জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনোনীত হয়।
এছাড়া ১৯৯৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে একটি বেসরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সুধী সম্মেলন ডাকেন। ওই সম্মেলনে লক্ষ্মীপুর পৌর আইডিয়াল কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই কলেজের অবৈতনিক অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।