বাঘের থেকেও বিরল পাখি সুন্দরী হাঁস

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কচিখালির কাছে ছুটা কটকা খালের পাড়ে অতি বিরল পুরুষ সুন্দরী হাঁস। ছবি- আমিনুর রহমান

কচিখালির কাছে ছুটা কটকা খালের পাড়ে অতি বিরল পুরুষ সুন্দরী হাঁস। ছবি- আমিনুর রহমান

সুন্দরবনের গহীনে বাঘের থেকেও বিরল এক বন্যপ্রাণীর বাস। তবে, বন্যপ্রাণীটি বাঘের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী নয় মোটেও, বরং রহস্যময় এক পাখি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অতি বিরল এই পাখিটির মাত্র ৩০০টির মতো সদস্য বেঁচে আছে যার প্রায় শ-দুয়েক আমাদের সুন্দরবনের বাসিন্দা। আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে ভাটার সময় সুন্দরবনের গোলগাছে ঘেরা কাদাময় অচেনা এক খালের পাড়ে দূর থেকে পাখিটির দেখা পেয়েছিলাম এক পলকের জন্য; ফলে ভালোভাবে ওকে দেখতে পারিনি, ছবি তোলা তো দূরের কথা। এরপর বহুদিন কেটে গেছে। বহুবার সুন্দরবন গেছি। কিন্তু রহস্যময় পাখিটির দেখা পাইনি কোনদিন। ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি রাতে ফের সুন্দরবন রওয়ানা হলাম রহস্যময় পাখিটির সন্ধানে। বাঘের বৈঠকখানা খ্যাত কচিখালি পৌঁছলাম পরের দিন সন্ধ্যায়। পরদিন সকালটা কচিখালি কাটিয়ে ১০টা নাগাদ বাঘের বাড়ি খ্যাত কটকার পথে রওয়ানা হলাম।

কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে পুরুষ সুন্দরী হাঁস। ছবি- লেখক

অভিজ্ঞ সারেং সগির ও মাঝি গাউসের পরামর্শে বড় কটকা খাল দিয়ে না গিয়ে ছোট একটি খাল, যার নাম ছুটা কটকা খাল, দিয়ে এগুতে থাকলাম। কারণ এখানে রহস্যময় ও বিরল পাখিটির থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ভাটা চলছে। কাজেই ক্যামেরা হাতে আমরা সাতজন টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খালের দুপাশে গোলগাছের সারি, দৃষ্টি সবার এই গোলবনের পলিময় কাদার দিকেই। কিন্তু এভাবে ভারি ক্যামেরা তাক করে আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়? পরিশ্রান্ত সবাই কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে গেল। কিন্তু আমার দৃষ্টি গোলবনের কাদার দিকেই থাকল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে হাঁসের মতো কিন্তু অদ্ভুত একটি পাখির চেহারা ভেঁসে ওঠল। ওর ঠোঁটটি হাঁসের মতো চ্যাপ্টা নয় বরং চোখা। পায়ের পাতাও কেমন যেন অন্যরকম, পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে যুক্ত নয়। বিচিত্র এক পাখি! মন্ত্রমূগ্ধের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আর আমার আঙ্গুল অজান্তেই শাটারে ক্লিক করে গেল। হঠাৎই বলে ওঠলাম হাঁসপাখি! হাঁসপাখি!! পাখিটি দ্রুত গোলবনের কাদাময় পাড় থেকে পানিতে নেমে গেল। আমি ও অন্য এক আলোকচিত্রী ছাড়া কেউ ওর ছবি তুলতে পারল না।

বিজ্ঞাপন
সুন্দরী খালে ভাসমান পুরুষ সুন্দরী হাঁস। ছবি- লেখক

রহস্যময় পাখিটির আবিষ্কারে মনপ্রাণ আনন্দে ভরে ওঠল। খানিক পর এই খালেই আরও দুটি হাঁসপাখির দেখা পেলাম। পরদিন ভোরে কটকার কাছে সুন্দরী বা হোমরা খালে আরও চারটি একই পাখির পাখির দেখা পেলাম, যার মধ্যে একটি স্ত্রী পাখিও ছিল। এক যাত্রার সাতটি হাঁসপাখির দেখা পাওয়া বিরল দৃষ্টান্ত ও মহাভাগ্যের ব্যাপার। তবে এরপর আরও অনেকবার সুন্দরবন গেছি, কিন্তু পলিমাটিতে পায়ের ছাঁপ দেখলেও হাঁসপাখির দেখা পাইনি।

বাঘের থেকেও বিরল গোলবনের রহস্যময় পাখিটি আর কেউ নয়, এদেশের বিরল ও বিপন্ন এক পাখি সুন্দরী বা গেইলো হাঁস। অন্তত সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালি-মৌয়াল-জোংরাখুটাদের কাছে ওরা এই নামেই পরিচিত। অবশ্য অনেকে এদেরকে গোলবনের হাঁসপাখি বা বাইলা হাঁসপাখি নামেও ডাকে। তবে নাম হাঁসপাখি হলেও আদতে হংস বা Anatidae গোত্রের ধারে-কাছের পাখিও নয় এটি। বরং জলমুরগি, যেমন- রাঙা হালতি, ডুংকর, ডাহুক, কোড়া, কালেম ও সারস ক্রেন পাখিদের নিকটাত্মীয় এটি। পাখিটির ইংরেজি নাম  Masked Finfoot  বা Asian Finfoot। | Helornithidae গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Heliopais personata (হেলিওপাইস পারসোন্যাটা)। অতি লাজুক পাখিটিকে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন
খালের পাড়ে স্ত্রী সুন্দরী হাঁস

সুন্দরী হাঁসের দেহের দৈর্ঘ্য ৫৬ সেন্টিমিটার। দেহের পালকের মূল রঙ গাঢ় বাদামি। লম্বা গলাটি হালকা বাদামি। পিঠ জলপাই-বাদামি। ডানার প্রাথমিক পালক কালচে জলপাই-বাদামি। বুক-পেট-লেজতল হালকা বাদামি। চোখের পিছন থেকে ঘাড়ের পার্শ্বদিক পর্যন্ত সাদা ডোরা রয়েছে। হলুদ চঞ্চুটি লম্বা ও ড্যাগারের মতো চোখা। পায়ের আঙ্গুলে পর্দা থাকলেও তা হাঁসের মতো পায়ের পাতায় যুক্ত থাকে না। বরং দেখতে অনেকটা মাছের পাখনার মতো। পায়ের রঙ সবুজাভ-হলুদ। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় অল্পবিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের ঘাড়, গলার সম্মুখভাগ ও চিবুক কালো, স্ত্রীটির ক্ষেত্রে যা সাদা। পুরুষের চোখ গাঢ় বাদামি ও চঞ্চুর গোড়ায় শিংজাতীয় পদার্থ থাকে। অন্যদিকে, স্ত্রীর চোখ হলুদ ও চঞ্চুর গোড়ায় শিং থাকে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কপালের ধূসর ও চঞ্চুর ক্রিম-হলুদ রঙ ছাড়া বাকি সবই দেখতে স্ত্রী পাখির মতো।

আগেই বলেছি সুন্দরী হাঁস বিরল আবাসিক পাখি, বর্তমানে বিপন্ন হিসেবে বিবেচিত। একমাত্র সুন্দরবনেই দেখা যায়। অতি লাজুক এই পাখিটি একাকী, জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে বিচরণ করে। অল্প পানিতে সাঁতার কেটে বা কাদায় হেঁটে চিংড়ি, ছোট মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙাচি, শামুক, জলজ কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়। ভয় পেলে বা বিপদ দেখলে চঞ্চুসমেত মাথা পানিতে ভাসিয়ে ডুবে থাকে বা দ্রুত দৌড়ে পালায়। এরা হাঁসের মতোই উচ্চস্বরে ‘প্যাক-প্যাক----’ শব্দে ডাকে।

সুন্দরবনে ক্যামেরা হাতে লেখক

জুলাই থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এসময় মাটি বা পানি থেকে ১-৩ মিটার উপরে গাছের বড় শাখায় ঘন পাতার আড়ালে কাঠিকুটি ও শিকড়-বাকড় দিয়ে স্তুপের মতো গোলাকার বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৮টি। লম্বাটে ডিমগুলো ধূসরাভ সাদা, যাতে থাকে গাঢ় ছিটছোপ। সদ্যফোটা ছানার কোমল পালক ধূসর ও চঞ্চুর ওপর সাদা ফোটা থাকে। আয়ুষ্কাল ১০ বছরের বেশি।

E-mail: [email protected], [email protected]