আমাদের প্রজাপতি



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে চাতুল (Monkey Puzzle) প্রজাপতি। ছবি- লেখক।

মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে চাতুল (Monkey Puzzle) প্রজাপতি। ছবি- লেখক।

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রজাপতির (Butterfly) মতো এতো সুন্দর পতঙ্গ এই ধরনীতে আর আছে কি? সম্ভবত নেই। কল্পনায় যত রঙ আঁকা যায়, তার সবগুলো রঙেরই প্রজাপতি থাকা সম্ভব। বাহারি কারুকাজযুক্ত রঙির ডানাওয়ালা পতঙ্গগুলোকে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ বাদে বিশ্বের প্রায় সবখানেই দেখা যায়। ছোট্ট বর্নিল নিরীহ পতঙ্গগুলোকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। রঙিন এই পতঙ্গগুলো যখন নরম ডানায় ভর করে কারো পাশ দিয়ে ধীর গতিতে উড়ে যায় তখন মূগ্ধ দৃষ্টিতে না তাকিয়ে কি থাকা যায় না।

প্রজাপতি লেপিডপটেরা বর্গের সদস্য, গ্রীক ভাষায় যার অর্থ আঁশযুক্ত ডানাওয়ালা পতঙ্গ। প্রজাপতি ছাড়া এই বর্গে আরও রয়েছে মথ (Moth)। আর সেকারণেই মথ প্রজাপতির নিকটাত্মীয়। প্রজাপতির বিভিন্ন গোত্র বা পরিবারগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- ১. সত্যিকারের প্রজাপতি (True Butterfly), ২. কাপ্তান (The Skipper) ও মথ-প্রজাপতি (Moth-Butterfly)। লেপিডপটেরার বাদবাকি পরিবারগুলোর সদস্যরাই হলো মথ। এ বর্গের ৮৯-৯৪%-ই মথ ও বাকি মাত্র ৬-১১% প্রজাপতি। প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ওদের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। বিশ্বব্যাপী ১৫-২০ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৩০টি প্রজাতি তালিকাভুক্ত হলেও মোট প্রজাতি সংখ্যা পাঁচশ-এর বেশি হতে পারে। এদেশে বর্তমানে তিনটি প্রজাপতি পার্ক রয়েছে। প্রথমটি চট্রগ্রামের পতেঙ্গায়, দ্বিতীয়টি গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ও তৃতীয়টি গাজীপুরের বাঘের বাজারে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের ভেতর।

পুরুষ চোরকাটা কমলা (Leopard Lacewing) প্রজাপতি। ছবি- লেখক

হাতির যেমন শুঁড় (proboscis) আছে প্রজাপতিরও তেমনি শুঁড় রয়েছে যা দিয়ে এরা ফুলের ভিতর থেকে নির্যাস বা রস (Nectar) বের করে আনে। পাপুয়া নিউ গিনির ‘রাণী আলেকজান্দ্রার বিহন’ বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাপতি, যার প্রসারিত ডানা ২৫০ থেকে ২৮০ মিলিমিটার এবং উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার ‘পশ্চিমা বামন নীল’ বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রজাপতি (প্রসারিত ডানা ১০ মিলিমিটার)। ‘বেনুবিহন’ বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রজাপতি (প্রসারিত ডানা ১৪০ থেকে ১৯০ মিলিমিটার) ও ‘সলমা’ ক্ষুদ্রতম (প্রসারিত ডানা ২০ থেকে ২২ মিলিমিটার)। বিশ্বব্যাপী বহু সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি ও মথ রয়েছে, যেমন- নীল প্রজাপতি, সচ্ছ প্রজাপতি, ৮৮ প্রজাপতি ইত্যাদি। এসব প্রজাপতি বা ওদের নিকটাত্বীয় কিছু প্রজাতি এদেশেও রয়েছে, যেমন- বেণুবিহন, শ্বেত ফড়িংলেজী, তিতিমৌরল, মরাপাতা ইত্যাদি। অন্যান্য সুন্দর প্রজাপতির মধ্যে রয়েছে গর্দাপেয়ারী, নিশি সিন্ধুপ, রতœচূড়, চোরকাটা কমলা, নীল শিখীপর্ণ, বিদুষক ইত্যাদি।

আমাদের প্রজাপতির মধ্যে সচরাচর যেগুলোকে দেশজুড়ে দেখা যায় তার মধ্যে উদয়াবল্লী, সাত ডোরা,  নীরদ সিন্ধু, মনমেঘা, কস্তুরী শার্দুল, নীল ডোরা, চোরকাটা কমলা, উষসী বায়স, নীল পুনম, অংশশুচপল, কমলা শিখীপর্ণ, ধূসর শিখীপর্ণ, বনবেদে, নাবিক, কৃষ্ণতরঙ্গ, গুণনকর বনপাল, কুম্ভীধনু, তৃণাঙ্গুরী, উষসী কপিল, ভোল ভ্রামরী, রাগ নকশী, হেমশুভ্র, চৈতালী দূত, তৃণ গোধুম, তৃণ বিদুষক, তিলাইয়া, কৃষ্ণতিলা, পঞ্চতিলা, তিন্নি, নীলবিজুড়ী, মলয় মশাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দুলর্ভ ও বিরল প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বেণুবিহন, কেশবতী, কাজল, চন্দ্রাবল্লী, হলদে খঞ্জর, শ্বেত ফড়িংলেজী, তিতিমৌরল, নীল বায়স, বনমালী, নীল শিখীপর্ণ, পালিপার্বন, দেতাবকী, নিশি সিন্ধুপ, একাঙ্ক গোধুম, বান্দর, ময়ূরী রেণূ, পীতরতœ, চাতুল, নীল খয়ের, আকাশচারী, ভাটুরে বউল, শিখা বউল, জলদ আকাশি, ছিটকুল, সূর্যচঞ্চল, স্বর্ণছরা, ছাযাকরণ ইত্যাদি। মহাবিপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে স্বর্ণবিহন, সিঁদুরী পদ্মরাগ, চুমকি, সুন্দরী বায়স, শ্বেত শার্দুল, চিত্রল বায়স, সুন্দরী বনদেবী, বনবেণু, রত্মচূড়, উদয়ধনু, রক্তডানা, কৃষ্ণ অধিরাজা, কৃষ্ণ যুবরাজ, তালডিঙি, পিপুলকাঠি, উর্মিমালা, কুল মুকুল, ভাঁড় ইত্যাদি।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাগ নকশী (Common Jezebel) প্রজাপতি। ছবি- লেখক। 

প্রজপাতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক সংস্কার বা কুসংস্কার রয়েছে। যেমন- কারো গায়ে প্রজাপতি বসাকে সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে ধরে নেয়া হয়। এদেশে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত লোকের দেহে প্রজপাতি বসলে তার বিয়ের ফুল ফুটলো বলে ধরে নেয়া হয়। সাদা রঙের প্রজপতিকে কোথাও কোথাও সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রজাপতি নিয়ে বহু পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় Psyche (সাইকি) অর্থ হলো প্রজাপতি। Psyche-এর শাব্দিক অর্থ Soul বা আত্মা অথবা Mind বা মন। গ্রীকরা বিশ্বাস করে যে, প্রাতিটি মথ প্রজাপতি থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্মার জন্ম হয়। প্রজাপতি নিয়ে জাপানী মিথ হলো- যার ঘরে প্রজাপতি প্রবেশ করে, সবচেয়ে পছন্দের ব্যাক্তিটি তাকে দেখতে আসে। দু’টি প্রজাপতি একসঙ্গে উড়াকে চীনারা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখে। ফিলিপিনোরা মনে করে, কোন ঘরে যদি কালো প্রজাপতি প্রবেশ করে বা এর মথ আনা হয় বা জন্ম হয়, তবে ঐ পরিবারের কেউ মারা গেছে বা শীঘ্রই মারা যাবে। প্রাচীন ইউরোপিয়রা মনে করতো মানুষের আত্মা নেয়া হয় প্রজাপতির রূপে, তাই তারা প্রজাপতিকে খুবই শ্রদ্ধা ও ভয়ের সাথে দেখতো। আইরিশরা মনে করে, মৃত ব্যক্তিদের আত্মা স্বর্গে প্রবেশের আগ পর্যন্ত প্রজাপতি হযে থাকে। মেক্সিকোর কোন কোন আদিবাসী বিশ্বাস করে যে, প্রজাপতি হলো পৃতিবীর উর্বরতার প্রতীক। মায়া আদিবাসীরা মনে করে, মৃত যোদ্ধাদের আত্মা প্রজাপতির রূপ নিয়ে পৃথিবীতে বিরাজ করে। আসামের নাগাস অঞ্চলের লোকেদের বিশ্বাস এই যে, আত্মা পৃথিবীতে এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর সর্বশেষ ধাপে প্রজাপতি হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই প্রজাপতির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মার রূপান্তরও শেষ হয়।

মৌলভীবাজারের আদমপুর বিটে ভাঁড় (Harlequin) প্রজাপতি। ছবি- লেখক।   

প্রজাপতি দিনের বেলায় ফুল থেকে ফুলে ওড়ে বেড়ায় ও ফুলের রস পান করে। ফুলের পরাগায়ণে অর্থাৎ গাছের বংশবিস্তারে এরা বেশ সাহায্য করে। এদের পঞ্চেন্দ্রিয় উন্নত ধরনের। পূর্ণবয়ষ্ক প্রজাপতির মাথায় একজোড়া প্রায় গোলাকার যৌগিক চোখ বা পুঞ্জাক্ষি (Compound Eye) থাকে যা দিয়ে এরা চারদিক দেখতে পারে। প্রজাপতি পুঞ্জাক্ষির সাহায্যে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ও বস্তু শণাক্ত করতে পারে। এদের লম্বা দেহটি তিনভাগে বিভক্ত, যেমন মাথা, বুক ও উদর বা পেট। উদর লম্বা বেলুনাকার যা দশটি খন্ডে বিভক্ত। সাধারণত দেহ এবং ডানার উপর ও নিচের দিকের রঙ এবং কারুকাজে ভিন্নতা থাকে। মাথার দু’পাশে একটি করে অ্যান্টেনাও রয়েছে। চোখ বাদে পুরো দেহ ছোট ছোট রোম ও চ্যাপ্টা আঁশে আবৃত থাকে। এদের ডানা চারটি ও পা তিন জোড়া।

ঠাণ্ডা মৌসুমে প্রজাপতি উড়তে পারে না। এদের স্বাভাবিক কাজকর্ম বা ওড়াউড়ি করার জন্য পরিবেশের তাপমাত্রা ২৮-২৯- সেলসিয়াস থাকা বাঞ্ছনীয়। এরা শীতল রক্তসম্পন্ন প্রাণী, তাই দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এজন্য পরিবেশের তাপমাত্রা এদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের তাপমাত্রা যদি ১৩- ডিগ্রী সেলসিয়াসের কম থাকে তবে এরা নড়াচড়া করতে পারে না, এমনকি নিজেদের জন্য খাদ্য সংগ্রহেও যেতে পারে না। শীতে প্রজাপতিদের চলাফেরার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যের তাপের প্রয়োজন হয়। নতুন জন্ম নেয়া প্রজাপতি উড়তে পারে না। কারণ এদের পাখাগুলো দেহের সাথে লেগে থাকে। প্রজাপতির পুরো দেহ শুষ্ক হওয়ার জন্য কয়েক ঘন্টা সময় লাগে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাদামি শঙ্কু (Chestnut Angle) প্রজাপতি। ছবি- লেখক। 

প্রজাপতির জীবন চক্র চারটি পর্বে বিভক্ত। যথা- ১) ডিম, ২) শুককীট (বা শুঁয়াপোকা), ৩) মূককীট (বা কোকুন) ও ৩) পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গ (বা ইমাগো)। এটিকে বলে সম্পূর্ণ রূপান্তর। প্রজাপতি ও মথের ধরনের উপর নির্ভর করে জীবন চক্রের দৈর্ঘ্য মাস থেকে বছরব্যাপী হতে পারে। জীবন চক্রের প্রথম পর্যায় হলো ডিম। ডিমের আকার ও আকৃতি ওদের ধরনের উপর নির্ভর করে। ডিম ছোট, গোলাকার, ডিম্বাকার বা নলাকার হয় ও কমবেশি সচ্ছ থাকে। স্ত্রী সচরাচর পছন্দনীয় উদ্ভিদ অর্থাৎ পোষক গাছের কচি পাতা, অঙ্কুর বা কাণ্ডে ডিম পাড়ে। বসন্ত ও গ্রীষ্ম ডিম পাড়ার উপযুক্ত মৌসুম, তবে অন্য সময়েও ডিম পাড়তে সক্ষম। স্ত্রী একসঙ্গে প্রচুর ডিম পাড়ে, তবে শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি বেঁচে থাকে। জীবন চক্রের দ্বিতীয় পর্যায় হলো শুককীট। এটি দেখতে লম্বা পোকার মতো যার চোখ বয়ষ্কগুলোর মতো যৌগিক নয় বরং সরল। ডিম ফুটে বের হওয়ার পর প্রথমেই শুককীট ডিমের খোসাটি খেয়ে ফেলে। ওরা গাছের পাতা খেয়ে ও কয়েকবার (সচরাচর পাঁচবার) দেহের খোলস পাল্টে আকারে বড় হয় ও পরের ধাপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। বেশিরভাগ শুককীটই গাছের ক্ষতি করে। অবশ্য কোনো কোনো প্রজাতি ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকদের উপকারও করে। মূককীট হলো জীবন চক্রের তৃতীয় পর্যায়। এ পর্যায়ে শুককীট খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেহের চারিদিকে একটি খোলস সৃষ্টি করে এবং নিজেকে তার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। শক্ত খোলসের ভিতরে এটি দ্রুত পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত হয়ে মূককীটে পরিণত হয়। এই রূপান্তরে, শুককীটের কলা, অঙ্গ, প্রতঙ্গ ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়ে প্রজাপতিতে পরিণত হয়। এক সপ্তাহ থেকে কয়েকমাস, এমনকি বছর পর্যন্ত এটি সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। জীবন চক্রের চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্যায় হলো প্রাপ্তবয়স্ক ধাপ বা ইমাগো। মূককীটের ভিতরে রূপান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর উপযুক্ত সময় ও পরিবেশে সুপ্তিকালশেষে একদিন খোলস কেটে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি। এ সময় তার দু’ডানাই ভেঁজা, নরম ও দেহের সঙ্গে ভাঁজ হয়ে থাকে। ডানা পুরোপুরি শুকানোর পর সে ওড়াউড়ি শুরু করে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে উতলকুট (Great Mormon) প্রজাপতি। ছবি- লেখক। 

যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতির মূল কাজ হলো বংশবিস্তার করা তাই সে সঙ্গী খোঁজে, মিলিত হয়, ডিম পাড়ে ও বংশবিস্তার করে। এই পর্যায়ে কিছু প্রজাপতি ফুল থেকে নির্যাস পান করে। অন্যরা গাছের রস, মল, ভিজা মাটির রস, পচনশীল ও মৃত প্রাণীজ পদার্থ এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। প্রজাপতি মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাঁচে, কারণ ওদের জীবকাল গড়ে ৩-৪ সপ্তাহ। তবে, পরিযায়ী প্রকৃতিরগুলো বছরখানেকও বাঁচতে পারে। প্রজাপতিরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। তবে এদেশে হেডিলিডি গোত্রের কোনো প্রজাপতি না থাকায় বাংলাদেশের প্রজাপতিগুলোকে ছয়টি গোত্রেই দেখানো হয়, যেমন- ১) প্যাপিলিওনিডি বা সোয়ালোলেজী প্রজাপতি (উদাহরন- উতলকূট, অভ্রকূট), ২) নিম্ফালিডি বা চারপেয়ে প্রজাপতি (চোরকাটা কমলা, কস্তুরী শার্দুল), ৩) পিয়েরিডি বা সাদা ও হলুদ প্রজাপতি (রাগ নকশী, শুদ্ধ হরিদ্রা), ৪) লাইকিনিডি বা নীল প্রজাপতি (জলদ আকাশী, চাতুল), ৫) রিওডিনিডি বা ধাতবচিহ্নযুক্ত প্রজাপতি (ভাঁড়, বিদুষক) ও হেস্পারিডি বা অধিনায়ক (বাদামি শঙ্কু, শিকনদেও) প্রজাপতি। কোনো কোনো পুরনো শ্রেণিবিন্যাসে কিছু অতিরিক্ত গোত্র, যেমন- ড্যানাইডি, হেলিকোনিডি, লিবিথিইডি, স্যাটিরিডি, অ্যাকারিইডি, অ্যামাসথুসিইডি ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিলেও আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসে এগুলোকে নিম্ফালিডি গোত্রের অর্ন্তগত উপগোত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রজাপতি দেখতে বেশ সুন্দর ও বর্নিল হলেও শুককীটগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তেমন একটা সুন্দর হয় না। তাছাড়া এরা গাছের বেশ ক্ষতি করে। অবশ্য কোন কোন প্রজাতির শুককীট ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকদের বেশ উপকারও করে। আবার শূককীট বা শুয়াপোকা অনেক পাখির কাছেই অত্যন্ত প্রিয় খাবার। কাজেই অনেক প্রজাতির পাখিও প্রজাপতির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। গাছের বৈচিত্র্য তৈরিতে প্রজাপতি ভূমিকা রাখে।

প্রকৃতির সুন্দর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে ফুল, পাখি ও প্রজাপতি অন্যতম। সুন্দর এই প্রজাপতিগুলো দেখে আমরা মুগ্ধ হই। কিন্তু এদের প্রতি আমরা মোটেও সচেতন নই। আামদের দেশের শিশু-কিশোর এমনকি বড়রাও সঠিকভাবে প্রজাপতি চিনে না। এদের উপকারিতা সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানে না। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদ ও প্রাণী-পাখির মতো প্রজাপতিরও যে ভূমিকা রয়েছে তা অনেকেরই জানা নেই। প্রজাপতি পরিবেশের সুস্থতার নির্নায়ক। এদেশে বর্তমানে কয় প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্তির দোড়গোড়ায় ও কয়টি ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। কাজেই এ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। তবে আমাদের প্রাকৃতিক গাছগুলোকে সংরক্ষণ করে প্রজাপতিকে রক্ষা করা সম্ভব। কেননা কিছু কিছু গাছ রয়েছে যার ওপর প্রজাপতিরা সরাসরি নির্ভরশীল। তবে কিছু কিছু প্রজাতি মারাত্মকভাবে হুমকীর সম্মূখীন রয়েছে। কাজেই এদের রক্ষা করার ব্যাপারে এখনই সচেতন না হলে এদেরকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।

কেশবতী (Common Batwing) প্রজাপতির পাশে লেখক

 E-mail:[email protected], [email protected]

   

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;

এক ঘরেই তিন বলী



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

  • Font increase
  • Font Decrease

চুল থেকে দাড়ি-সবই সফেদ। হাঁটাচলায় মন্থর। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় প্রথম দেখাতেই। কিন্তু তার ষাটোর্ধ্ব বয়সটা যেন কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। বয়স যতই ছোবল বসানোর চেষ্টা করুক না কেন-তিনি যেন এখনো ২৫ এর টগবগে তরুণ। সেই বলেই তো ফুসফুসের রোগবালাইকে তুড়ি মেরে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা এলেই হাজির হয়ে যান রিংয়ে। এক দুবার নয়, এবার কিনা পূর্ণ হলো সুবর্ণজয়ন্তী!

চট্টগ্রামের অন্যতম আবেগের ঠিকানা ঐতিহাসিক এই বলীখেলার বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা এই বলীর নাম খাজা আহমদ বলী। ৫০ বছর ধরে বলীখেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া এই বলীর এখন পড়ন্ত বয়স। ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে রোগ। কানেও শোনেন কম। খাজা আহমদ বুঝে গিয়েছেন, তার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বলীখেলার স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যেতে চান না। সেজন্যই উত্তরসূরী হিসেবে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন নিজের দুই ছেলেকে। বাবার পাশাপাশি দুই ভাইও এখন বলীখেলার নিয়মিত প্রতিযোগী।

খাজা আহমেদ বলীর বাবাও বলীখেলায় অংশ নিতেন। বাবার সঙ্গে বলীখেলায় এসে ১৯৭৪ সালে শখের বসে খেলতে নামেন খাজা আহমেদও। বয়স তখন ১২ বছরের আশপাশে। সেই শুরু, আর কোনোদিন মিস করেননি বলীখেলায় অংশ নেওয়া। একবার চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বহু বছর ধরে খাজা আহমেদ বলী ও সত্তরোর্ধ্ব মফিজুর রহমানের ‘বলীযুদ্ধ’ জব্বারের বলীখেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দ্বৈরথ হয়তো আর দেখা যাবে না। দুই বছর আগে উৎপত্তি হওয়া ফুসফুসের রোগটা ইদানিং যে খাজা আহমদকে বেশিই ভোগাচ্ছে। সেজন্য গতবছর অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার দুই ছেলেকে নিয়ে বলীখেলায় এসে আবেগ সামলাতে পারেননি খাজা আহমেদ। ছেলেদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রিংয়ে। সেজন্য আরও একবার মফিজুর রহমান-খাজা আহমেদের লড়াই দেখল হাজারো দর্শক। যদিওবা যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন রেফারি।

প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমানের সঙ্গে বলী-যুদ্ধে খাজা আহমদ

কেন অবসর ভাঙলেন এমন প্রশ্নে হাসি খেলা করে যায় খাজা আহমেদ বলীর মুখে। বলতে থাকেন, ‘বয়সের কারণে শরীর দস্ত। ফুসফুসও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সেজন্য অবসর নিয়েছিলাম। কিন্তু বলীখেলায় আসার পর দেখলাম দর্শকেরা সবাই অনুরোধ করছেন। সেজন্য মন বলল, না খেললে দর্শকদের প্রতি অন্যায় হবে। আর আবেগ ও ভালোবাসার কাছে বয়স-রোগ পেরেছে কবে?’

তবে এখানেই সব শেষ, বলে দিয়েছেন খাজা আহমেদ বলী। বলেছেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। মনে হয় না আর খেলতে পারব। অসুখটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেজন্য মনে মনে মেনে নিয়েছি এটাই আমার শেষ অংশগ্রহণ। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা খাজা আহমদের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়। কৃষিকাজ করেই চলে সংসার। তবে বলীখেলা এলে সব কাজ বাধ। কয়েকদিন ধরে চলে প্রস্তুতি। নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে এরই মধ্যে খাজা আহমেদ নিজের দুই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন বলী হিসেবে। ২০১২ সাল থেকে বলীখেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তার বড় ছেলে মো. সেলিম। গত বছর থেকে যোগ দিয়েছেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। এখন বলীখেলার আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে খাজা আহমদের প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমরা বলীখেলা শিখেছি। বয়সের কারণে বাবা এখন অসুস্থ। হয়তো আর খেলা হবে না। সেজন্য তার উত্তরসূরী হিসেবে আমরা বলীখেলায় অংশ নেব সামনের দিনগুলোতে। এটা শুধু পরিবারের বলীর প্রজন্ম ধরে রাখার জন্য নয়, তরুণদের মাদক-সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগও।’

বাবাকে পাশে রেখে একই কথা বললেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। বলেন, ‘হয়তো বাবা আর খেলবেন না। তবে তিনি না খেললেও যতদিন বেঁচে থাকবেন বলীখেলা দেখতে আসবেন। রিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন।’

ছেলের কথা শুনে আবেগ খেলে যায় খাজা আহমেদ বলীর মনে। কাঁধের গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না খেললেও যতদিন বাঁচি এখানে, এই বলীর মাঠ লালদীঘি ময়দানে ছুটে আসব। এটা থেকে দূরে থাকতে পারব না।’

খাজা আহমেদ যখন কথা বলছিলেন দূরে কোথাও তখন মাইকে বাজছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অক্লান্ত গলায় গেয়ে চলেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...

;