নেচে-গেয়ে নবান্ন বন্দনা
‘বাংলার বধু কার্তিক সাজে এক নব বেশে, হিমেল হাওয়া হঠাৎ থেমে যায় নবান্নের এই দেশে, অবাক নয়নে চেয়ে দেখে সে বাংলার এই রূপ, শীতের স্পর্শে শত কোলাহল থেমে গিয়ে হয় চুপ, আঁধারে সুখের রেখা ফুটে কষ্টে দিন শেষে, কৃষানেরে বড় কাছে টেনে নেয় কৃষাণী ভালোবেসে’- এভাবেই মৃত্তিকার বুকে সোনালী ধানের গল্পময় ঋতুকন্যা হেমন্তের প্রতি জানানো হলো অনুরাগ। উদ্যাপিত হলো কৃষকের হাসিমাখা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যময় নবান্ন উৎসব।
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী ফসলের উৎসব নবান্ন উদযাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের বকুল তলায় বর্ণিল উৎসবে মেতেছে সবাই। অতীতে নবান্নে সোনালী ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। অগ্রহায়ণ মাস এলেই পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে গ্রাম-বাংলায় জানান দিত নবান্নের কথা। সকলের ঘরে ঘরে নতুন আমন ধানের চালের বাহারি পিঠা, পায়েসসহ নানা আয়োজন দেখা যেত।
কিন্তু শহুরে জনজীবনে এই চিত্র যেন একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই প্রাচীন এই ঐতিহ্য যাতে হারিয়ে না যায় তারই প্রয়াসে প্রতিবছর ঢাবির বকুলতলায় উদযাপিত হয় নবান্ন উৎসব। এ বছরও তার ব্যতীক্রম হয়নি। নাচে, গানে, কবিতায় মুখরিত হয়ে উঠেছে বকুলতলার আঙিনা।
‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’- স্লোগানে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) দুইদিন ব্যাপী এই উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। উদ্বোধনকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতীয় ভিত্তিতে সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একই দিনে নবান্ন উৎসব আয়োজনের বিষয়ে তিনি উদ্যোগ নেবেন।
এ সময় সভাপতির বক্তব্যে উদযাপন পর্ষদের সভাপতি লায়লা হাসান জানান, শহরের নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয় তুলে ধরতেই তারা এই উৎসব আয়োজন করে আসছেন। এই উৎসবগুলো মানুষে মানুষে মানবিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী ও কবি বুলবুল মহলানবীশের স্মৃতির প্রতি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বুলবুল মহলানবীশের স্ত্রী সরিৎ কুমার লালা। উদ্বোধনী আলোচনা পর্বের পরে দর্শকদের মধ্যে খই, মোয়া, মুড়কি, বাতাসা, খাজা, গজা বিতরণ করা হয়।
‘আবার জমবে মেলা’ গানটি ‘তারার মেলা’র শিশুদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। নবান্ন বন্দনা করে কবিতা আবৃত্তি করেন নিমাই মণ্ডল।
বরেণ্য শিল্পী লায়লা হাসানের পরিকল্পনায় ‘ও ধান ভানি রে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন দীপা খন্দকার, নিলুফার ওয়াহিদসহ জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা। দর্শকের মন মাতাতে ফরিদা পারভীন গেয়ে শোনান লালন সাঁইয়ের গান খাঁচার ভিতর অচিন পাখি/ কে’মনে আসে যায় ...। তার সঙ্গে বাঁশি বাজিয়েছেন গাজী আবদুল হাকিম।
নবনীতা জাহিদ চৌধুরী গেয়ে শোনান নজরুলসঙ্গীত ‘হেমন্তিকা এসো’। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন ‘ধান কাটি, কাটি ধান’।
এ আয়োজনে পিছিয়ে নেই শিশুরাও । শিশুদের সংগঠন নন্দন কুঁড়ির শিশুরা গেয়েছে ‘ধন্য ধন্য বলি তারে।’
দুই দিনের এই উৎসবের প্রথম দিনের আয়োজনে আরও ছিল দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের একক গান, আবৃত্তি, দলীয় সঙ্গীত, দলীয় নৃত্য ও শিশুদের পরিবেশনা।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) বকুলতলায় দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান বিকাল ৪ টায় শুরু হবে বলে জানান আয়োজকরা। সঙ্গীতা ইমামের সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন উদযাপন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক নাঈম হাসান।