গণকবর থেকে বাঁশঝাড়
নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর এলাকার একটি গ্রামের নাম আটিয়াগাঁও। এই গ্রামেই এক স্থানে রয়েছে ১৮ জন মানুষের গণকবর। বর্তমানে সেখানে রয়েছে বাঁশের ঝাড়। অথচ সরকারিভাবে সেই গণকবরগুলো চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত করে রাখার কথা। তা না করে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পরও বাঁশঝাড়্টি এখন স্মৃতি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। আটিয়াগাঁও গ্রামের অরক্ষিত বাঁশঝাড়ের স্থানটিতে পাকবাহিনী ৭১ সালে প্রায় ৩০ জন নিরীহ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে এবং তাদেরকে গণকবর দেয়া হয়।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের এই দিনে ঘোড়াশাল আটিয়াগাঁও গ্রামে একই বাড়িতে শিশুসহ ১৮ জন নর-নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী। পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বেশকিছু ঘর-বাড়ি। নির্মম হত্যাযজ্ঞে গ্রামের শিশুসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন নারী পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে পাক বাহিনী। এরপর থেকে ৬ ডিসেম্বর দিনটি আসলে আজও সেই স্মৃতি মনে করে চোখে পানি এসে যায়। মাঝেমাঝে সেই স্মৃতি মনে হলে আজও মন আঁৎকে উঠে। অথচ দিবসটিকে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা জানায়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৯ দিন আগে দেশজুড়ে যখন কোণঠাসা পশ্চিমা পাক হানাদার বাহিনী। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘোড়াশাল এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিকামী বাঙালির সাথে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়। বিজয়ের কাছাকাছি সময়ে এসে পাক বাহিনীর সদস্যরা ফিরে যাওয়ার সময় ৬ ডিসেম্বর ঘোড়াশালের আটিয়াগাঁও গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে প্রবেশ করেই আবুল কাসেম নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে হত্যাকাণ্ড চালায়। এসময় বাড়িতে থাকা ৪ মাসের এক শিশু আয়শাসহ হত্যা করা হয় মোকছেদ আলী, মালাবক্স, শাহাজাহান, রহম আলী, আঃ হেকিম, হযরত আলী, আম্বিয়া খাতুন, মজিদা, শাহাজউদ্দিন, নেহাজউদ্দিন ও নেজুসহ প্রায় ১৮ জন নর-নারীকে। জ্বালিয়ে দেয়া তাদের বাড়িঘর। এভাবে শুধু আটিয়াগাঁও গ্রামেই ২৫ থেকে ৩০ নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহত হয় আরো প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন। হত্যাযজ্ঞের পরের দিন মৃতদের মধ্যে অনেককেই গণকবর হিসেবে মাটি দেয়া হয়। সেই গণকবরগুলো আজও অরক্ষিত, ঝোপঝাড়ে পরিণত, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। আর শহিদ পরিবারের খাতায়ও তাদের নাম আছে কিনা কেউ জানেন না। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সহায়তায় শহিদের প্রত্যেক পরিবারের জন্য দেয়া দুই হাজার করে টাকা। এছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই সুযোগ সুবিধা ভাগ্যে জোটেনি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে শহিদদের পরিবারের খোঁজখবর একটিবারের জন্যও কেউ নেয়নি বলে পরিবারগুলোর অভিযোগ।
আটিয়াগাঁও এলাকার শহিদ হযরত আলীর ছেলে মোঃ হাবিবুল্লাহ জানান, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীরা আমার বাবা, দাদি ও ফফুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে মা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে আমাদের নিঃস্ব করে দেয়া হয়। সেদিন আমাদের চলার মতো তেমন কিছুই ছিল না। আশপাশের গ্রামের লোকজন আমাদের চলার পথে সহায়তা করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার আজ ৫২টি বছর পার হলেও সাংবাদিক ছাড়া কেউ আমাদের কোনো খবর নেয়নি। এছাড়া শহিদ পরিবারের তালিকায় তাদের নাম আছে কিনা তার উত্তরও কেউ দিতে পারেননি।
একই এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্তার বাবুল এ প্রতিনিধিকে জানান, পাক বাহিনীরা এই এলাকায় প্রবেশ করেই প্রথমে আমাদের ঘরে আগুন দিয়েছিল। তখন বাড়িতে যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। পাক বাহিনীর সদস্যরা ৪ মাসের শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। তবে কয়েকজন বাড়ির পাশে একটি গর্ত করে তাতে লুকিয়ে থেকে কোনোক্রমে নিজেকে রক্ষা করেন।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নারী রাহাতুন বেগম বলেন, তখন অগ্রহায়ণ মাস, বাড়ির পাশেই ধানের কাজ করছিলেন তিনি। এমন সময় পাক বাহিনীর সদস্যরা এসে বাড়িঘরে আগুন দেয়। আর গুলি করে হত্যা করেছে যাকে পেয়েছে তাকেই। পরে নিহতদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল। আর এই গণকবরের স্থানে এখন বাঁশের ঝাড়।
এলাকার শহিদদের কবরস্থানে বধ্যভূমি নির্মাণের পাশাপাশি পরিবারগুলোর সহায়তায় সরকারকে পাশে দাঁড়ানোর দাবি জানিয়েছেন, ঘোড়াশাল পৌরসভা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও ঘোড়াশাল পৌর সভার সাবেক কাউন্সিলর বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক ভূইয়া।
এ অঞ্চলের ট্র্যাজেডির কথা উল্লেখ করে শহিদ পরিবারেরগুলোর স্মৃতি রক্ষায় একটি বধ্যভূমি নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন পলাশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন।
বিজয়ের ৫২ টি বছর পেরিয়ে আজ এলাকাবাসীর দাবি হত্যাযজ্ঞে নিহত শহিদদের তালিকা প্রণয়ন, গণকবর তৈরি করে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদা দানের। এতে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা স্থানীয়দের।