জাবিতে কমছে পরিযায়ী পাখি, শীতেও মিলছেনা দেখা

  • মাহমুদুল হাসান, বার্তা২৪.কম, জাবি করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: অরিত্র সাত্তার

ছবি: অরিত্র সাত্তার

পরিযায়ী পাখির এক অবাধ বিচরণস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। আঁকা-বাঁকা লেক আর সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত এই ক্যাম্পাসে শীতের পূর্ব থেকেই আসতে শুরু করে পাখিগুলো। তবে বিগত কয়েকবছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধে গাছ কাটা পড়ায় কমেছে এসব পাখির নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়া যেসকল লেকে এই পাখিরা বিচরণ করে সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় বেশ কয়েকবছর ধরে কমতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা। এ অবস্থা জারি থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ক্যাম্পাসে এই পাখির দেখা মিলবেনা বলে আশঙ্কা করছেন পাখিপ্রেমিরা।

জানা যায়, সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে এসব পাখি আসতে শুরু করে। তবে এবার ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও লেকগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাখি দেখা মিলছেনা। সাধারণত জলময়ূর, ছোট সরালি, গার্গিনি, চিতা টুপি, বামুনিয়া, মুরহেন, খঞ্জনা, পিনটেইল, কোম্বডাক, পচার্ড, লাল গুড়গুটি, জলপিপি, শামুকভাঙা, নাকতা, মানিকজোড়, খোঁপাডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি প্রভৃতি পরিযায়ী পাখি ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে আসে। তবে এবছর দেশীয় সরালিসহ মাত্র তিন থেকে চারটি প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে।

বিজ্ঞাপন

 

উত্তরের লেঞ্জা হাঁস/ ছবি: অরিত্র সাত্তার

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে লেক রয়েছে ২৬টি। এগুলোর মধ্যে ট্রান্সপোর্ট চত্বর সংলগ্ন লেক, আলবেরুণী হলের বর্ধিতাংশ সংলগ্ন লেক, মনপুরা সংলগ্ন লেক ও ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের অভ্যন্তরের লেকটিতে গত কয়েকবছর ধরে পাখি বিচরণ করতে দেখা গেছে। এছাড়া কয়েকবছর আগেও আল বেরুনি হল সংলগ্ন লেক, জিমনেশিয়াম সংলগ্ন লেক, বিপিএটিসি সংলগ্ন লেকে পরিযায়ী পাখির দেখা মিললেও বর্তমানে দেখা যায় না।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সরেজমিনে লেকগুলোতে দেখা যায়, এবার ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের অভ্যন্তরের লেকে সবচেয়ে বেশি পাখি এসেছে। ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেকে প্রথমদিকে কিছু পাখি আসলেও সেগুলো পরে আল বেরুণী হলের বর্ধিতাংশ সংলগ্ন লেকে শিফট করেছে। এর বাইরে অন্য লেকগুলোতে পাখির দেখা মিলেনি। পাখির নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে একটি ফেস্টুন ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আর কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রম চোখে পড়েনি। ছোট ছোট কিছু বোর্ড দেখা গেলেও সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উদ্যোগে লাগানো হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বছর লেক পরিষ্কার করা হলেও এবার পাখি আসাকে কেন্দ্র করে নতুন করে কোন পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম করা হয়নি।

 

উত্তরের খুন্তি হাঁস/ ছবি: অরিত্র সাত্তার

পাখি গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বার্তা২৪ ডটকমকে বলেন, ‘অন্যান্য বছরে এই সময়ে যে পরিমাণ পাখি থাকে এবার তার চেয়ে অনেক কম। হয়তো এবছর শীত বাড়লে পাখির পরিমাণ বাড়তে পারে। এখন পর্যন্ত দেশীয় পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে সরালি আর বাহিরের পাখিদের মধ্যে খঞ্জনা, টেগা, চটক, ওয়ারব্লার এই কয়েকটি প্রজাতির পাখিই এসেছে। তবে অন্যান্য বছর এই সময়ে কিছু হাস আসে, কিন্তু এ বছর সেগুলো চোখে পড়েনি।’

সম্প্রতি ট্রান্সপোর্ট সংলগ্ন লেকের পিছনে সমাজবিজ্ঞান ভবনের বর্ধিতাংশ ভবন নির্মাণের কারণে কাটা পড়েছে অনেক গাছ ও ঝোপঝাড়। গাছগুলো কাটা পড়ায় পাখিরা হারিয়েছে তাদের আবাসস্থল। ফলে গাছে থাকা পাখিগুলো তাদের বিচরণস্থল পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে বলে মনে করেন পাখিপ্রেমিরা। এছাড়া ট্রান্সপোর্ট চত্বর সংশ্লিষ্ট দোকানগুলোর পেছনে শিক্ষার্থীসহ বহিরাগতদের আড্ডা বাড়ার কারণে ও লেক পরিষ্কারকালীন অনেক প্রয়োজনীয় জলজ উদ্ভিদ উপড়ে ফেলায় সেখানে পাখি অবস্থান না করার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী অরিত্র সাত্তার।

তিনি বলেন, ‘মানুষের আচরণগত কারণে দিন দিন এখানে অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। লেকগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে কিন্তু কাজের সময় দায়িত্বশীল কেউ সেখানে থাকেনা দেখভালের জন্য। ফলে সবসময়ই দেখা যায় কচুরিপানার সাথে সাথে পাখিদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জলজ উদ্ভিদও উপড়ে ফেলা হচ্ছে। যার কারণে পাখিরা আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ট্রান্সপোর্টের লেকে এখন পাখি দেখা যাচ্ছে না, অথচ তার পাশের লেকেই দেখা যাওয়ার কারণ সেখানে পাখিদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। আমাদের উচিত লেকের পরিবেশ ও পাখিদের আশ্রয়স্থল পরিযায়ী পাখিদের জন্য নিরাপদ রাখা।’

 

রাজ সরালি/ ছবি: অরিত্র সাত্তার

ক্যাম্পাসে আসা পাখিগুলো অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অতিথি পাখিরা আমাদের ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে এখন খুব একটা আসছে না। এর মানে এই নয় যে তারা আর কোথাও আসছে না। ক্যাম্পাসের আশেপাশের গেরুয়া, মিরেরটেক এলাকা সংলগ্ন লেকগুলোতে পাখিরা ঠিকই আসছে।’

এছাড়া পাখি গবেষক অধ্যাপক মনিরুল হাসান বার্তা২৪ ডটকমকে বলেন, ‘এবছর অনেক গরম আবহাওয়া পাখি কমার একটা কারণ হতে পারে। সাধারণত ডিসেম্বরে অনেক বেশি ঠান্ডা থাকলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে পাখিগুলো গাছপালায় থাকে সাধারণভাবেই গাছপালা কাটার কারণে সেগুলোর পরিমাণও কমে যাবে। জলবায়ুর পরিবর্তনও পাখি কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে। লেকগুলোর পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় কচুরিপানা দ্রুতই বেড়ে যায়। আমরা প্রতিবারই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পরিযায়ী পাখি আসার পূর্বেই লেকগুলো সংস্কারের পরামর্শ দেই। এছাড়া পাখির কমে যাওয়া ঠেকাতে আবাসস্থলগুলোকে নির্বিঘ্ন, নিরাপদ ও কোলাহলমুক্ত রাখতে হবে।’