বিশ্ব জানুক বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা
দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানি শাসকদের অসাম্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনই ছিল না, এর সঙ্গে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ-সংগ্রাম। বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামীরা রাজনৈতিক সংগ্রামীদের পাশে থেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে কাজ করলেও তাদের সেই কাজের পরিধি ছিল ব্যাপক, এবং অনুপ্রেরণাদায়ী।
বুদ্ধিজীবী কারা এনিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে সরকারের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটি একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী—১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহিদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহিদ বুদ্ধিজীবী।
একাত্তরের পুরোটা সময় এবং বিজয় অর্জনের আরও দেড় মাস পর পর্যন্ত ধরা হয়েছে শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে নির্ধারণের। জাতীয় কমিটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করলেও এনিয়ে এখনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এনিয়ে কাজ করছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা, রাজাকারদের তালিকার মতো এই তালিকাও অসম্পূর্ণ। মন্ত্রণালয় একাধিকবার এনিয়ে কাজের কথা বললেও সেটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। জাতীয় কমিটি গঠনের তিন বছরে একটিমাত্র তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে স্থান পেয়েছেন মাত্র ১৯১ জন শহিদ বুদ্ধিজীবী। সরকার বলছে, আগামী জানুয়ারিতে দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশের কথা।
বাস্তবতা বলছে, প্রতি বছর যেকোনো দিবসকে সামনে রেখে এধরনের আলোচনা শুরু হয়, এবং দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে দায়সারা গোছের একটা বক্তব্য দেওয়া হয়। এরপর নির্দিষ্ট তারিখ ধরে অপেক্ষা শেষে সেই তারিখটিও পেরিয়ে যায়; অনেকেই খবর রাখে না। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে রেখে এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও আশ্বাস এসেছে, বেড়েছে স্বভাব অপেক্ষা।
দেশে-দেশে বুদ্ধিজীবী-নিধন নজিরবিহীন নয়। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যারা জনতার স্বার্থে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছেন তারা শাসকের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন। তবে সম্ভবত বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে পৃথকভাবে কোন দিবস পালন করে থাকে। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণার্থে পৃথক সৌধ রয়েছে দেশে। দিবসী আয়োজনে হলেও জাতির প্রতিনিধিত্বশীল অংশ তাদের স্মরণ করে, শ্রদ্ধার ফুল অর্পণ করে।
ফুলেল শ্রদ্ধায় থেমে থাকেনি দেশ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে যারা পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিল সেই আল বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদসহ অনেক যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত আল বদর বাহিনীর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান এখনো পলাতক। বিদেশে অবস্থানরত ওই খুনিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হলেও দেশে ফিরিয়ে এনে সেই দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। এই দুই বুদ্ধিজীবী-হন্তারকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন আল বদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। মুঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ছিলেন অপারেশন ইন-চার্জ এবং আশরাফুজ্জামান ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। এই দুই খুনির মধ্যে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে কয়েকদিন আগে কানাডায় জনসমক্ষে দেখা গেছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশের যে উদ্যোগ সেখানে প্রাথমিক বিবেচনায় থাকবেন নিশ্চিতভাবেই কেন্দ্র বা রাজধানীতে নিহত বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু ঢাকার বাইরে সারাদেশে যে সকল বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তাদের নাম কতখানি ওঠে আসবে এনিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আমরা জানি না, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা কখনো প্রকাশ হবে কিনা। মুক্তিযোদ্ধার তালিকাই যেখানে অসম্পূর্ণ এবং আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সেখানে শহিদ বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত তালিকা ও তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান অনিশ্চয়তায় থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আশা করতে পারি, এবং সাধারণ মানুষ হিসেবে এতটুকুই আমাদের সামর্থ্য কিংবা সীমাবদ্ধতা!
দিবসী আয়োজনের হলেও দেশে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে আলোচনা হয়, শ্রদ্ধার ফুল অর্পণ করা হয় তাদের উদ্দেশে। আয়োজন সীমিত হলেও এটা উল্লেখযোগ্য। দিবসী আয়োজনের ব্যাপ্তি বাড়াতে গবেষকদের এখানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে আরও গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ঘৃণ্য এই হত্যাকাণ্ডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগী হতে হবে।
একাত্তরের জেনোসাইড এখনো বৈশ্বিক স্বীকৃতি পায়নি। জেনোসাইডের প্রধান সকল বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে। ব্যর্থতা রয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই পলাতক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে। তবে এই ব্যর্থতা সত্ত্বেও সাফল্য আছে কতক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকরের। কার্যকর হওয়া দণ্ডগুলো অপরাপর দণ্ডিতের দণ্ড কার্যকর আশাবাদী করে। দেশবাসী নিশ্চয় সে দিনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশ শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে পৃথক দিবস পালন করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের তোলে ধরতে পারে। পরাজয় স্বীকারের ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানিরা কীভাবে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল সে বিষয়টি জানানোর দরকার বিশ্ববাসীকে। বিশ্ব দেখুক কত রক্ত আর কত ত্যাগে জন্ম বাংলাদেশের; বিশ্ব জানুক মেধাশূন্য করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন পরেও কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ!