আমাদের বন কপোত
পায়রা শান্তির প্রতীক। কবুতর বা কপোত নামেও পরিচিত। জানামতে, রোমানরাই সর্বপ্রথম পায়রাকে ‘শান্তির প্রতীক’ হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। মানুষ ও পায়রার সম্পর্ক অতি প্রাচীনকালের। জীববিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, পায়রার সঙ্গে মানুষের প্রথম পরিচয় ঘটে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছর আগে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে বুনো পায়রাকে পোষ মানিয়ে গৃহে পালন শুরু হয়। তবে, এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাছাড়া প্রথম কোথায় পায়রাকে পোষ মানানো হয়েছিল তা নিয়েও রয়েছে মতপার্থক্য। কেউ বলেন লিবিয়ায়, কেউ বলেন ব্যাবিলনে, আবার কেউ বলেন মিশরে। মুসলিম সুফি সাধক ও ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহজালাল (রঃ) এদেশে আসার সময় সঙ্গে করে পায়রা নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলোর বংশধররাই আজ ‘জালালি কবুতর’ নামে পরিচিত। কাজেই আমাদের দেশে বুনো পায়রা প্রজাতির কোনো মূল বংশধারা আছে কি-না সন্দেহ? এদের প্রায় সবগুলোই প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়া জালালি কবুতরের বংশধর, যারা অনেকটা না বুনো, না পোষা স্বভাবের। তাই এগুলোকে উপপ্রাকৃতিক পায়রা (Feral Pigeon) বলা যেতে পারে।
পায়রা বা কপোত কোলাম্বিফরমেস (Columbiformes) বা পারাবত বর্গের পাখি। এদের আকার ছোট থেকে মাঝারি, দেহ তুলনামূলকভাবে ভারি, মাথা ছোট, ঠোঁট ও পা খাটো। ওড়ার পেশি বেশ শক্তিশালী। তাই বেশ দ্রুত ও দীর্ঘক্ষণ উড়তে সক্ষম। লেজ হাতপাখার মতো বিস্তৃত। এদেশে পারাবত বর্গে কোলাম্বিডি (Columbidae) বা কপোত নামে একটিমাত্র গোত্র রয়েছে। পায়রা ও ঘুঘু এই গোত্রের সদস্য। এদের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজেদের গলার থলিতে উৎপন্ন ক্ষীরের মতো অর্ধতরল দুধ খাইয়ে ছানাদের বড় করে তোলে যা ‘পায়রা বা ঘুঘুর দুধ (Crop/Pigeon/Dove Milk)’ নামে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী এই বর্গ ও গোত্রে মোট ৩৬৫টি প্রজাতি রযেছে, যার মাত্র ১৮টি এদেশে বাস করে। এই ১৮টি প্রজাতির মধ্যে ১০টি কপোত ও ৮টি ঘুঘু প্রজাতি। এদেশের সবগুলো প্রজাতির কপোতই আবাসিক অর্থাৎ এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এদের মধ্যে ৭টি প্রজাতিই সবুজ কপোত। এখানে আমাদের বন কপোতগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো।
এক. বুনো পায়রা (Blue Rock/Rock/Common Pigeon)
এরা জালালি কবুতর, জংলা কবুতর, বুনো কবুতর, কপোত বা গোলা পায়রা (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। পুরো দেশব্যাপী বিস্তৃত ও বহুল দৃশ্যমান আবাসিক কবুতরটির বৈজ্ঞানিক নাম Columba livia (কোলাম্বা লিভিয়া)। প্রাকৃতিকভাবে বুনো পায়রা পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা। দেহের দৈর্ঘ্য ২৯ থেকে ৩৭ সেন্টিমিটার, প্রসারিত অবস্থায় ডানা ৬২ থেকে ৭২ সেন্টিমিটার ও ওজন ২৩৮ থেকে ৩৮০ গ্রাম।
দুই. গোলাপি কবুতর (Pale-capped/Purple Wood Pigeon)
গোলাপি কবুতর এদেশের সবচেয়ে বিরল ও মহাবিপন্ন প্রজাতির কপোত। বৈজ্ঞানিক নাম Columba punicea (কোলাম্বা পুনিসিয়া)। সূত্রমতে, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে এদেরকে দেখা গেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। আমি বহুবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গেলেও কখনোই গোলাপি কবুতরের সন্ধান পাইনি।
তিন. কমলাবুক হরিয়াল (Orange-breasted Green Pigeon)
এটি হরিকল নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে গোলা পায়রা। এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক বন কপোতটির বৈজ্ঞানিক নাম Treron bicinctus (ট্রেরন বিসিঙ্কটাস)। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন- পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এরা বাস করে। প্রাপ্তবয়স্ক কমলাবুক হরিয়ালের দৈর্ঘ্য ২৯ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ১৫৫ থেকে ১৯৪ গ্রাম।
চার. ছোট হরিয়াল (Ashy-headed/Pompadour Green Pigeon)
এরা এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। হরেল, লোনা হরেল বা ধূসরমাথা হরিয়াল (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Treron phayrei (ট্রেরন ফাইরেই)। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন- ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন, লাওস, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে দেখা যায়। ছোট হরিয়ালের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার ও গড় ওজন ১৩০ গ্রাম।
পাঁচ. হরিকল (Thick-billed Green Pigeon)
অন্যান্য বন কপোতের তুলনায় এর ঠোঁট কিছুটা মোটা বলে পশ্চিমবঙ্গে এটি ঠোঁটমোটা হরিয়াল নামে পরিচিত। দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Treron curvirostra (ট্রেরন কার্ভিরস্ট্রা)। ভারতের পূর্বা ল থেকে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ হয়ে চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন পর্যন্ত পাখিটির আবাস এলাকা বিস্তৃত। হরিকলের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার ও ওজন ১৭০ থেকে ১৯০ গ্রাম।
ছয়. বটকল (Yellow-footed/Yellow-legged Green Pigeon)
বটকল এদেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক বন কপোত। এছাড়াও এটি হরিতাল, বড় হরিয়াল, হলদে পা হরিয়াল বা হলদে পা সবুজ কপোত নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে হরিয়াল। বৈজ্ঞানিক নাম Treron phoenicoptera (ট্রেরন ফিনিকপটেরা)। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানের পূর্বা ল থেকে পুরো ভারত হয়ে নেপাল, ভুটান, দক্ষিণ চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাপ্তবয়স্ক বটকলের দেহের দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার ও ওজন ২২৫ থেকে ২৬০ গ্রাম।
সাত. লেজচোখা হরিয়াল (Pin-tailed Green Pigeon)
লেজচোখা হরিয়াল এদেশের বিরল ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন প্রজাতি। হরিকল বা কোখলা (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Treron apicauda (ট্রেরন অ্যাপিকডা)। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনে বাস করে। তবে কাপ্তাই, সাতছড়ি বা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অনেক খুঁজেও বন কপোতটির দেখা পাইনি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান, নেপাল, দক্ষিণ চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে বিস্তৃত। প্রাপ্তবয়স্ক কপোতের দৈর্ঘ্য ৩২ থেকে ৩৬ সেন্টিমিটার ও ওজন ১৮৫ থেকে ২৫৫ গ্রাম।
আাট. হরিয়াল (Wedge-tailed/Kokla Green Pigeon)
এটি এদেশের এক বিরল আবাসিক বন কপোত। পশ্চিমবঙ্গে কীলক হরিয়াল নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Treron sphenurus (ট্রেরন স্ফেনুরাস)। বাংলাদেশ ছাড়াও হিমালয়ের পাদদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার্বত্যা ল থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। দেহের দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ২০৫ থেকে ২১৪ গ্রাম।
নয়. ধূমকল (Green/Northern Green Imperial Pigeon)
ধূমকলের অন্য নাম রাজ হরিয়াল। আমাদের এই আবাসিক পায়রাটি পশ্চিমবঙ্গে ডুকল বা সোনা কবুতর নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Ducula aenea (ডুকুলা ইনিয়া)। ভারতের পূর্বা ল থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। ধূমকল বড় আকারের বন কপোত। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৪৭ সেন্টিমিটার ও ওজন ৩৬৫ থেকে ৬৪৫ গ্রাম।
দশ. ডুকল (Mountain Imperial Pigeon)
এটি এদেশের এক বিরল ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন আবাসিক বন কপোত। আমার অদেখা বন কপোতটি পাহাড়ি ধূমকল নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Ducula badia (ডুকুলা বাডিয়া)। এদেশে এটিকে কেবলমাত্র চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনে দেখা যায়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, চীনের দক্ষিণা ল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সুমাত্রায় বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক কপোতের দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৪৭ সেন্টিমিটার।
জালালি কবুতর বাদে বাকি সব বন কপোত চিরসবুজ, পত্রঝরা ও বাদা বন এবং গ্রামীণ বন ও ফলের বাগানে বিচরণ করে। সচরাচর ছোট থেকে মাঝারি বা বড় দলে ফলদ গাছের উপর হেঁটে হেঁটে বট, পাকুর, ডুমুর ও অন্যান্য ছোট রসালো ফল খায়। এছাড়াও শস্য দানা ও বীজও খেতে পারে। পানি পান ও লবণাক্ত মাটি খাওয়া ছাড়া সচরাচর মাটিতে নামে না। অবশ্য জালালি কবুতর মাটিতে হেঁটে হেঁটে শস্যবীজ ও শস্যদানা খুঁটে খায়।
জালালি কবুতর সারাবছরই প্রজনন করে; পুরনো ধ্বংসাবশেষ, দরদালানের ফাঁকফোকর ও লোকালয়ে দল বেঁধে কাঠিকুটি দিয়ে বাসা বানায়। তবে বন কপোত প্রজাতিভেদে মার্চ থেকে আগস্ট মাসে প্রজনন করে। গাছের ডালে কাঠিকুটি দিয়ে ঘুঘুর থেকে কম ঢিলেঢালা ও বেশি গভীর বাসা বানায়। সচরাচর সাদা রঙের দুটি ডিম পাড়ে। অবশ্য কোনো কোনো প্রজাতি একটি ডিমও পেড়ে থাকে। পায়রা-পায়রি দুজনেই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। প্রজাতিভেদে ১২ থেকে ১৫ কিংবা ২১ দিনে ডিম ফোটে। বাবা-মা দুজনেই ছানাদের পায়রার দুধ খাইয়ে বড় করে তোলে। ছানারা প্রজাতিভেদে ১০ থেকে ১৩ দিন কিংবা ২১ থেকে ২৮ দিনে উড়তে শিখে। আয়ুষ্কাল প্রজাতিভেদে ৪ থেকে ৭ বছর।
লেখক: অধ্যাপক, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ এবং প্রজননতান্ত্রিক জৈব-প্রযুক্তি গবেষণাগার গাইনিকোলজি, অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ বিভাগ ও বিশেষজ্ঞ প্রাণিচিকিৎসক, ভেটেরিনারি টিচিং হসপিটাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
E-mail: [email protected], [email protected]