হ্যাকার ধরার প্রতিজ্ঞা থেকে এএসপি হওয়ার গল্প

  • তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হ্যাকার ধরার প্রতিজ্ঞা থেকে এএসপি হওয়ার গল্প

হ্যাকার ধরার প্রতিজ্ঞা থেকে এএসপি হওয়ার গল্প

ছোটকাল থেকেই লেখালেখির বাতিক ছিল সালাহ্‌উদ্দিন কাদেরের। কিন্তু নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ভাই-বোনদের পড়ালেখার খরচ জোগানোর ব্যস্ততায় লেখার সময় আর সুযোগের মেলবন্ধন কোনোভাবেই হচ্ছিল না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার দিনগুলোতে টিউশনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার ভূত জাগে মাথায়। সেই থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে খোলেন-‘টিউশনের গল্প’ নামের একটি পেজ। ওই পেজেই প্রতিদিন লিখতে শুরু করেন টিউশনের ‘অম্ল-মধুর’ আখ্যান। সালাউদ্দিনের দেখাদেখি অনেকেই সেখানে লিখতে থাকেন নিজেদের জীবনের নানা কথা।

এভাবেই দিনে দিনে বড় হতে থাকে-টিউশনের গল্প। গ্রুপটির জনপ্রিয়তা যখন একেবারেই মধ্যগগনে তখনই কিনা চোখ পড়ে হ্যাকারের। এক ভোরে ঘুম ভেঙে সালাহ্‌উদ্দিন কাদের আবিষ্কার করেন গ্রুপ আর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-দুইটো আর তাঁর নিজের আয়ত্বে নেই। এত দিন ধরে সন্তানের মতো করে লালন করে বড় করা গ্রুপটি এভাবেই হারিয়ে যাবে, কোনোভাবেই মানতে পারেননি এই তরুণ। গ্রুপটি হ্যাকারের হাত থেকে উদ্ধারে তাই ঘুরতে থাকেন এই থানা থেকে ওই থানায়, এমনকি ঢাকার ডিবি কার্যালয়ের সাইবার ক্রাইম বিভাগেও! শেষমেশ ঢাকা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। কেউ আশা দেখিয়েছিনে, কেউবা করেছেন তাচ্ছিল্য। শেষ পর্যন্ত আর গ্রুপটি ফেরত পাননি সালাহ্‌উদ্দিন কাদের। তিন বছর আগের সেই মন খারাপের সময়গুলোতেই সালাহ্‌উদ্দিন বুকের ভেতরে গড়ে নেন সংকল্প, ‘একদিন আমি নিজেই হবো পুলিশ অফিসার। আমার আইডি, গ্রুপ আমি নিজেই উদ্ধার করব।’ সেই জেদই সালাহ্‌উদ্দিনকে নামিয়ে দেয় বিসিএস-লড়াইয়ে। কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে নিবিষ্ট মনে পড়ে থাকেন পড়াশোনায়। সেই সব প্রচেষ্টা অবশেষে হলো পুরষ্কৃত।

বিজ্ঞাপন

জীবনের প্রথম বিসিএস পরীক্ষা দিয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সাবেক এই ছাত্র হলেন ‘পুলিশ অফিসার’। সদ্য প্রকাশিত ফলে পুলিশ ক্যাডারে সালাহ্‌উদ্দিনের মেধাক্রম ৫১ তম।

কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের ফকিরাঘোনা গ্রামের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সালাহ্‌উদ্দিন কাদের। বাবা সৈয়দ আহমদের পানের সামান্য ব্যবসা, সেটিও এই আছে, এই নেই দশা। মা নিতান্তই গৃহবধূ। তথাকথিত পারিবারিক বংশপরিচয়ও নেই। সবমিলিয়ে টানাপোড়ন ছিল বারোমাস। সেই দুঃখ-বেধনার উল্টো পিঠে ছিল একরাশ আনন্দ। সেই আনন্দের পুরোটা জুড়েই ছিল বাড়ির বড় ছেলে সালাহ্‌উদ্দিনের একের পর এক কৃতীত্ব। কখনো ‘ফার্স্ট বয়’ হয়ে বাবা-মাকে গর্বিত করছিলেন, কখনোবা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে পুরো স্কুলের নামই ছড়িয়ে দিয়েছেন সবখানে। এখন তো এমনই এক অর্জনে নিজের নাম বসালেন, সেটিতে তো পুরো উপজেলা গর্বিত হলো সালাহ্‌উদ্দিনের জন্য।

বিজ্ঞাপন

 ‘আমি প্রত্যন্ত গ্রামের খুবই সাধারণ একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছি। এখানে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আমার বাবা সৈয়দ আহমদ ছিলেন একজন শিক্ষিত বেকার। কিন্তু আমার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া মা ছিলেন ভীষণ পড়ালেখা সচেতন। তিনিই আমাকে দেখিয়ে দেন ভবিষ্যতের আলো। আমার চাচাতো ভাই বোনেরা কেউই পড়ালেখা করতেন না, কিন্তু মা ঠিকই আমাকে প্রতিদিন নিয়ম করে পড়াতে বসাতেন। লেখাতেন ‘অ, আ, ক, খ। শেখাতেন গল্প-কবিতা।’ জীবনের শুরুর গল্প জানতে চাইলে ঠিক এভাবেই শুরু করেন সালাহ্‌উদ্দিন কাদের।

একটু ভালো পড়াশোনার আশায় ২০০০ সালে গ্রামের পাশের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সালাহ্‌উদ্দিনকে ভর্তি করান মা। কিন্তু সেখানে প্রতিমাসে বেতন দিতে হতো ৫০টাকা। সেই টাকা বহু কষ্টে জোগাড় করতে হতো মাকে। অবশ্য মায়ের সেই দুশ্চিন্তা সালাহ্‌উদ্দিন মুছে দেন দুর্দান্ত ফলাফলে। প্রতিবছর ফার্স্ট বয় হতেন বলে মওকুপ করা হতো বেতন। অবশ্য স্কুলের দিনগুলোতে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের অকৃত্রিম ছায়া পেয়েছেন সালাহ্‌উদ্দিন, কেউ তাঁকে পড়িয়েছেন, কেউবা শিখিয়েছেন-একেবারে বিনাবেতনেই। সালাহ্‌উদ্দিনের সংগ্রামের এই দীর্ঘ সফরে দুই মামার অবদানও কম নয়। পরীক্ষা ফি কিংবা কোচিং ভর্তির টাকা চাইলেই মামারা নির্দ্বিধায় পকেট থেকে বের করে দিয়েছেন টাকা।

পরিবারের সঙ্গে সালাউদ্দিন

সালাহ্‌উদ্দিনের বিসিএস লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের শুরুতে, ওই ফেসবুক গ্রুপটি হারানোর পর। বললেন, ‘আইডিটি হারানোর পর বহু জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করলাম, শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলাম। সেই জেদ থেকেই ফিরে এলাম চট্টগ্রামে, চকবাজারে কনফিডেন্স কোচিং সেন্টারে ৪৩ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ব্যাচে ভর্তি হলাম। কিন্তু ক্লাস শুরুর কদিন পরেই শুরু হলো করোনা, বন্ধ হয়ে গেল সব। তখন আমার স্নাতক শ্রেণির একটি পরীক্ষা বাকি ছিল মাত্র। টিউশন-কোচিং সব ছেড়েছুড়ে ফিরে গেলাম বাড়িতে। লকডাউন উঠে গেলে আবারও চট্টগ্রামে ফিরে শুরু করলাম পড়াশোনা। ছয় মাসের প্রস্তুতিতে আমি প্রিলিতে উত্তীর্ণ হই। কয়েকমাস পর লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিলাম। এরপর ৪৪ তম প্রিলিতেও উত্তীর্ণ হলাম। এদিকে ৪৩ তমর লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষা করতে করতে ৪৪ তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাও দিয়ে দিলাম। আশানুরূপ একটা লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার পর বুকে আত্মবিশ্বাস চলে এলো, ৪৩ এ পুলিশ ক্যাডার না পেলেও ৪৪ এ পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।’

কিন্তু ৪৪ তম বিসিএসের ফলের জন্য আর অপেক্ষা করতে হচ্ছে না সালাহ্‌উদ্দিন কাদেরকে। কেননা স্বপ্ন যে পূরণ হয়ে গেছে ৪৩ তম বিসিএস পরীক্ষাতেই।

স্বপ্নটা যে এভাবে ধরা দেবে ভাবেননি এই তরুণ। কদিন আগেই বিয়ে করেছেন, স্ত্রীকে নিয়ে এখনো আত্মীয়দের বাড়িতের বেড়ানো পর্ব চলছে। ২৬ ডিসেম্বর ফল প্রকাশের সময়ও এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াচ্ছিলেন, তখনই ঢাকা থেকে আরেক বন্ধুর ফোন। বাকিটা শুনোন সালাহ্‌উদ্দিনের কণ্ঠে, ‘ও ফোন করেই বলল, বন্ধু তোর স্বপ্ন তো পূরণ হয়ে গেল। আমি প্রথমে ভাবছি মজা করছে। তাই আমিও মজা করে তাকে বললাম আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর কত বলতো তাহলে? দেখলাম সে ঠিকঠাকই বলল। তখন ফোন কেটে দ্রুত নেট থেকে ফলের তালিকাটা নিলাম। সেখানে আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা সার্চ করতেই দেখি সেটি লাল রঙে ভেসে উঠল। সেই মুহূর্তুটা আসলে কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো যাবে না।’

বাড়িতে বউ আসার কদিন পরেই এল দারুণ ফলও। অনেকে তাই দুটোকে মিলিয়ে সালাহ্‌উদ্দিনকে বলছেন, ‘বউ-ভাগ্য’! আসলেই কি তাই-এমন প্রশ্নে অবশ্য ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো সায় দেওয়া দুটো শব্দ-‘হা হা’।

জীবনের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় ‘ছক্কা’ হাঁকালেও সালাহ্‌উদ্দিনের জীবনেও আছে ‘বড় বড়’ হতাশা। তুখোড় মেধাবী হয়েও এসএসসিতে পাননি জিপিএ-৫, মেডিকেলে ভর্তির স্বপ্ন থাকলেও সেটিও রয়ে যায় অধরা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রথমবার ভর্তির সুযোগ মেলেনি। তাই সালাহ্‌উদ্দিন যারা একটুতেই হতাশ হয়ে পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যান তাঁদের উদ্দেশে দিলেন পরামর্শ, ‘হতাশ হয়ে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যেতে নেই। লেগে থাকলে ভালো কিছু অবিশ্যম্ভাবী।’

নিজে সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগী। তাই সালাহ্‌উদ্দিন চান, তাঁর মতো কেউ এমন কিছুর শিকার না হোক। বললেন, ‘সাইবার অপরাধ ও হ্যাকিংমুক্ত বাংলাদেশ গড়াই আমার প্রধান লক্ষ্য। আমি যদি সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভের পর কোনোদিন সাইবার ক্রাইম সেলে দায়িত্ব পাই, তাহলে আমি আর কেউ যাতে নিগৃহীত না হোন, সর্বস্ব না হারান; সেই লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাব।’

আর স্বপ্ন দেখেন নিজের গ্রামের জন্য কিছু করার। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর সালাহ্‌উদ্দিনের বাড়িটি এখন হয়ে উঠেছে পুরো গ্রামের আবেগের উৎপত্তিস্থল। কেউ আসছেন মিষ্টি নিয়ে, কেউবা ফুলের তোড়া হাতে। উঠে গেছে অভিনন্দনের ছবি সংবলিত ব্যানারও। সেসব দেখে নতুন আরেকটি সংকল্পের বীজ বুকের ভেতর রোপণ করে নিলেন সালাহ্‌উদ্দিন, ‘আমার এত এত অর্জন সব এই মানুষগুলোর দোয়ার জন্য। বড় হয়ে এলাকার অসহায় মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে চাই। এটাই এখন আমার একজীবনের স্বপ্ন।’

আকাশ ছোঁয়ার পরও অহঙ্কারশূন্য সালাহ্‌উদ্দিন কাদেরকে দেখে এলাকার মানুষও তাই স্বপ্ন বুনছেন, ‘এভাবে মাটিতেই থেকো সবচেয়ে উঁচু তারা’!