‘জয়নুল মেলা’ যেন লোকায়ত জীবনের ছবি!
পৌষের অর্ধেক দিন চলে গেলেও রাজধানীতে নেই শীতের প্রকোপ। দুপুরের সূর্যটা মাথার উপরে থাকলেও তাপের প্রখরতা সহনীয়। এমন শান্ত আবহাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্রই চোখে পরবে বাংলার ও বাঙালির ঐতিহ্যের নানান শিল্পকর্মের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা।
যেখানে তারা বিক্রি হচ্ছে রাজশাহীর শখের হাড়ি আর টেপা পুতুল, মাগুরার শোলাশিল্প আর বিক্রমপুরের শীতলপাটি, সোনারগাঁওয়ের নকশিকাঁথা, হাতে বোনা চাদর, মাফলারসহ নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র। এখানে মিলবে এক চোখ বন্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে গানের তালে তালে বায়েস্কোপ দেখার সুযোগ। চারুকলা প্রাঙ্গণের এই দৃশ্য দেখেই মনে পড়ে যাবে গ্রামের মেলার কথা।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৯ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়োজন করা হয়েছে জয়নুল উৎসব। প্রতি বছরের মতো এ বছরও উৎসবে মেলার আয়োজন করা হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন চারুকলা শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার রূপকার। ১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট। পরে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ হিসেবে উন্নীত হয়।
মেলার মাধ্যমে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের চেতনাকে ধারণ করে বাংলার ঐতিহ্যকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বর্তমান আয়োজকরা।
মেলায় বংশ পরম্পরায় হস্তশিল্পের কাজ করা একবারে জাত শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন। যারা কিনা সবার চোখের সামনেই কাজগুলো করছেন।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে মৃৎশিল্পের নিদর্শন। একাধিক স্টলে ছিল টেপা পুতুল। রাজশাহীর সুবোধ কুমার বা কিশোরগঞ্জের সুনীল পালের টেপা পুতুল হাতে নিয়ে দেখছিল শহুরে প্রজন্ম। বিক্রিও বেশ তার।
গ্রামীণ কৃষিকর্মের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের জোরালো অংশগ্রহণের কথা আমরা জানি। পুতুলগুলো যেন সেইসব নারীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ কৃষক বা জেলেদের প্রতিকৃতি পুতুলে খুঁজে পাওয়া যায়।
সুবোধ প্রায় ৩০ বছর ধরে মৃৎশিল্পের কাজ করছেন। প্রতিটি পুতুল নিজ হাতে তৈরি করেন তিনি। ভবিষ্যতেও এই আদিকর্ম ধরে রেখে কাজ করে যাবেন বলে জানান সুবোধ।
শীতের আয়োজন জয়নুল মেলায় নকশি কাঁথা থাকবে না এটা কি করে হয়। দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য সম্মাননা পাওয়া সোনারগাও এর সুচিশিল্পী হোসনে আরা চোখ জুড়ানো আকর্ষণীয় সব কাঁথা নিয়ে এসেছেন। নিখুঁত কাজ।
রাজশাহীর বিখ্যাত শখের হাঁড়ি নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছেন সুশান্ত কুমার পাল। দুই ছেলে, ছেলের বউরাসহ পরিবারের ১৪ জন বর্তমানে শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ করেন।
স্টলে বসেই সুই সুতা দিয়ে নারায়ণগঞ্জের সন্ধ্যা রানী রঙিন পাখা তৈরি করছেন। এ কাজ তিনি তার মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন বলে জানান। এখন সন্তানদের শেখাচ্ছেন।
একই এলাকার ঐতিহ্যবাহী কাঠের পুতুল পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। একসময় কাঠের পুতুলগুলোকে প্রাচীন মিসরীয় মমির আদলে অলঙ্কৃত করা হতো। এটিই সোনারগাঁওয়ের কাঠের পুতুলের মূল বৈশিষ্ট্য।
এখনো একই নিয়মে কাঠের পুতুল তৈরি করছেন বীরেন্দ্র সূত্রধর। তার স্টল ভর্তি কাঠের পুতুলে। তবে স্টলে বসে থাকা তার ছেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার বাবার কাজ বাবা একাই করেন। তিনি কাজটা জানেন না।
শোলা শিল্পের নিদর্শন নিয়ে মেলায় এসেছেন নওগাঁর প্রবীণ শিল্পী গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
কাঁসাশিল্পের স্টলও আছে মেলায়।লোক ঐতিহ্যের খেলনাগুলোর মধ্যে রয়েছে টমটম গাড়ি। চরকি আছে। আরও কত কি! সব মিলিয়ে গ্রামীণ মেলার পরিবেশ।
মেলায় মৌলভীবাজারের অজিত কুমার প্রদর্শন করছেন শীতলপাটি। তার নরম পাটিতে বহুকাল ধরে প্রচলিত ফুল, পাখি ইত্যাদির ফর্ম। শীতলপাটি নয়, যেন অনবদ্য শিল্পকর্ম। ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা যায়।
এ শিল্পী জানান, তাদের এলাকায় আগে যত ঘরে কাজ হতো তার তুলনায় এখন অনেক কম হয়।
চারুকলা আনুষদের ৭৫ বছর পূর্তিতে তৃণমূলের লোক কারু ও হস্তশিল্পীদের পাশাপাশি মেলায় স্টল সাজিয়েছে চারুকলা অনুষদের কয়েকটি বিভাগ। এসব বিভাগের স্টলে চলছে ছাত্রছাত্রীদের গড়া শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। বিক্রিও হচ্ছে বেশ ভালো।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাসিমা হক মিতুর সাথে।
তিনি বলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তার চিন্তাভাবনা কাজে-কর্মে ছিল লোকশিল্প। তার ভাবনায় ছিল আধুনিকতার ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে হয়ত বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে পারে। তাই সবসময় তিনি চাইতেন লোকশিল্পেকে বাঁচিয়ে রাখাতে এবং এই শিল্পের প্রচারণায় তিনি যুগোপযোগী পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। জয়নুলের চেতনাকে ধারণ করে বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে জয়নুল উৎসব এবং জয়নুল মেলার আয়োজন করা হয়।
শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী 'জয়নুল মেলা' (৩১ ডিসেম্বর) রোববার রাত আটটা পর্যন্ত চলবে।