ব্রেন চিপ টেকনোলজি: ভবিষ্যৎ স্নায়ু বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ-সম্ভাবনা
মানব মস্তিষ্ক বিশ্ব তথা মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিল এবং শক্তিশালী কম্পিউটার। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) বদৌলতে এই মানব মস্তিষ্ককে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে। মানব মস্তিষ্ক আর এআইয়ের মেলবন্ধনে এক সুপার হিউম্যান ইন্টারফেস তৈরির প্রচেষ্টা বহুকাল ধরেই চলে আসছে, যেখানে এই দুইয়ের সমন্বয়ে ডিভাইস ছাড়াই মানব মস্তিষ্ক টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগের সক্ষমতা অর্জন করবে। যেখানে একটি সুপার কম্পিউটার ইতোমধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ২,০০,০০০ ট্রিলিয়ন গণনা করতে পারে, তাহলে ভাবুন যদি আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো সরাসরি মেশিনের সাথে সংযুক্ত হয়, তাহলে এটি মানুষের চিন্তার বিকাশকে কোথায় নিয়ে যাবে!
শুনতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো লাগলেও এটাই বাস্তব। 'দ্য ম্যাট্রিক্স' চলচ্চিত্র কিংবা 'রেডি প্লেয়ার ওয়ান' এবং 'নিউরোম্যান্সার' বইগুলোতে লেখা কল্পকাহিনীতে কম্পিউটারের সাথে মানুষের মস্তিষ্ককে সংযুক্ত করার যে ধারণা আমরা পড়ে এসেছি, তা নিছকই কল্পনা নয়। বলা হয়ে থাকে, আজকে যেটা কল্পনা, আগামীকাল সেটাই বাস্তব। আর তাই সিনেমা, বইয়ে লেখা গল্পই আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তি যা 'ব্রেন চিপ' টেকনোলজি নামেও পরিচিত। প্রযুক্তির বিকাশে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে এআই। সম্প্রতি, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মানব মস্তিষ্কে ব্রেন-চিপ স্থাপনে সফল হয়েছে ইলন মাস্কের কোম্পানি ইউরালিংক। তবে কি শিগগিরই আমরা আমাদের মন দিয়ে টাইপ করতে পারব কিংবা কোনো ডিভাইসকে কমান্ড অথবা কন্ট্রোল করতে পারবো! ঠিক তাই! বহুকাল আগে থেকে মানুষ এবং মেশিনের মধ্যে সেতুবন্ধনের যে মিশন শুরু হয়েছিল, তারই সফল বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে এবার। চলুন জেনে নেয়া যাক, এর ভবিষ্যৎ সফলতা সম্পর্কে।
ব্রেন চিপ প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্ক ও কম্পিউটারের মধ্যে সরাসরি একটি যোগাযোগের পথ তৈরি হবে। যারা তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ হারিয়েছেন, তাদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেক সহজ করে দেবে এই ডিভাইসটি। এটি শুধু চিন্তা দ্বারাই কোনোরকম ডিভাইস ছাড়া আপনার ফোন বা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এটা মস্তিস্কের ক্ষমতা বাড়িয়ে মানুষ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, যেখানে দুজনেই একসঙ্গে বড় ধরনের কিছু করতে পারবে।
মৃত্যুকে জয়ের যে স্বপ্ন বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে দেখে এসেছেন, তা এবার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যেভাবে দ্রুতগতিতে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস গবেষণা এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে আমরা এক স্নায়ু বিপ্লবের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। আর তার শুরু ইলন মাস্কের প্রথম নিউরালিংক স্থাপনের মাধ্যমে হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই প্রযুক্তি লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌছে যাবে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ২০৪০ সালের মধ্যে ইমপ্ল্যান্টগুলো পক্ষাঘাতগ্রস্তদের হাঁটতে সাহায্য করবে। এমনকী স্নায়ুর জটিল রোগও সারিয়ে তুলবে ধীরে ধীরে। আবার এটি মানুষকে টেলিপ্যাথিক করে তুলবে। এতে কোনোরকম শব্দ ব্যবহার না করেই শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে কথোপকথন করতে পারবে অর্থাৎ ভিজ্যুয়াল কল্পনাকে ডিজিটাল সিগন্যালে অনুবাদ করতে পারবে। সহজভাবে বলতে গেলে আপনি যে চিত্রটি ভাবছেন, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখতে পারবেন।
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে সফল ব্যবহার নিশ্চিত হবে সামরিক ক্ষেত্রে। ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড-এর ইউহিরো সেন্টার ফর প্র্যাক্টিক্যাল এথিকসের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. হান্না মাসলেন বলেছেন, এর মাধ্যমে সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে নীরব যোগাযোগ করতে পারবেন। এমনকী সরঞ্জামগুলোকে মনে মনে কমান্ড দিয়ে সক্রিয় করতে পারবেন।
গবেষকরা বলছেন, এই প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছে আগে পৌঁছাবে। তারা ধারণা করছেন, আগামী ১০ বছরে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিরা এই প্রযুক্তির গ্রাহক হবেন আর আগামী ২০ বছরের মধ্যে এটি নন-মেডিকেল মানুষদের কাছে পৌছে যাবে। এছাড়াও মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ড্রাইভিংয়ের কল্পনাও বাস্তবে পরিণত হবে। মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কের যোগাযোগ, উন্নত স্মৃতি এবং অসীম জ্ঞানভাণ্ডার মানব ইতিহাসে এক যুগান্তর সৃষ্টি করবে।
তবে এতসব সম্ভাবনার মাঝেও বিশেষজ্ঞরা এর চ্যালেঞ্জ নিয়েও বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। যুক্তরাজ্যের গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান রয়েল সোসাইটির এক প্রতিবেদনে এই ব্রেন ইমপ্ল্যান্টের সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একইসাথে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে নৈতিক সমস্যাগুলোকেও তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, ব্রেন চিপ ইমপ্ল্যান্ট ডিভাইসগুলো অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় ধনী দেশগুলোতে এটা বিলাসবহুল আইটেম হয়ে উঠতে পারে। এতে করে দরিদ্র দেশগুলো প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে। এছাড়া ডিভাইসগুলো সরাসরি মস্তিষ্কে প্লাগ করা হলে, মানুষের গোপন তথ্যগুলোর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বর্তমানে সাইবার ক্রাইম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে এর অপব্যবহারে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এছাড়াও ব্রেন চিপ ব্যবহারে মানব মস্তিষ্কে স্মৃতিশক্তির পরিমাণ ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাবে। ফলে সাধারণভাবে আমরা কোনো কিছু মনে করতে চাইলে যেমন মস্তিষ্কে চাপ অনুভূত হয়, তেমনি এত বিপুল পরিমাণ ডাটা থেকে কোনো কিছু রিকল করা বা স্মরণ করতে চাইলে তা কয়েকগুণ বেশি চাপের সৃষ্টি করবে, যা মানুষের শারীরিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মানবজীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটছে এবং আগামীতেও ঘটবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমরা এমন একটি যুগে চলে যাচ্ছি, যেখানে আমরা আর শতভাগ ১০০ মানুষ হিসেবে থাকবো না। মানুষ এবং মেশিনের সংমিশ্রণে এক সুপার হিউম্যান ইন্টারফেস এ পরিণত হবো। একইসাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং জিন-এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেকে ডিজাইন করবে।
(মার্কিন সামরিক বাহিনীর ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি) সম্প্রতি একজন ব্যক্তিকে চিপ করেছে, যাতে সে টেলিপ্যাথিকভাবে একাধিক ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটা তো কেবল শুরু! এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ব্রেন-চিপ টেকনোলজির সূত্র ধরে মানুষ বৈজ্ঞানিক কল্পরাজ্যের বাস্তব দ্রষ্টা হয়ে উঠবে। তবে এই সম্ভাবনার পেছনে যেসব চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলোও মোকাবিলা করতে হবে। প্রযুক্তির সফল ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই তা আগামী শতাব্দীর মানব ইতিহাসকে পাল্টে দিতে পারবে বলে আশা করা যায়।