তেতুলিয়ায় হিমালয়ের বুকে পাখি

  • অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তুলসিয়া বিলের উপরে কাঞ্চনজঙ্গার বুকে একঝাঁক উড়ন্ত ধূসর-টিটি

তুলসিয়া বিলের উপরে কাঞ্চনজঙ্গার বুকে একঝাঁক উড়ন্ত ধূসর-টিটি

বিশেষ দুটি লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর রাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের শেষ সীমায় অবস্থিত পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় সময়মতো তেতুলিয়া পৌঁছুতে পারলাম না। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। অগ্রগামী টিমের ছয়জন পক্ষী ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী আমাদের ছাড়াই তেতুলিয়ার শালবাহান ইউনিয়নে অবস্থিত তুলসিয়া বিলে পাখি দেখার উদ্দেশ্যে চলে গেল।

কী আর করা? আমরা বাস থেকে নেমে নাস্তা সেরে সোজা রেস্ট হাউজে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর পঞ্চগড়ের পাখি ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী ফিরোজ আল-সাবাহ এলে ওর সঙ্গে বাংলাবান্ধার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাংলাবান্ধা যাওয়ার পথে বহু প্রতিক্ষীত প্রথম লক্ষ্য হিমালয়ের একটি শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলল। আমার দু-চোখ যেন চকচক করে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তা প্রখর রোদের আলোয় জ্বলে গেল। ছবিগুলো মোটেও ভালো হলো না, কেমন যেন একটা জ্বলা জ্বলা ভাব। কাজেই প্রথম দেখাতেই কিছুটা হতাশ হলাম। তবে সাবাহ-এর পরার্মশমতো পরের দিন ভোরের অপেক্ষায় থাকলাম।

বিজ্ঞাপন

বাংলাবান্ধা যাওয়ার পথে জিরো পয়েন্টের কয়েক কিলোমিটার আগে আমাদের বহনকারী অটো হাতের ডানে মোড় নিয়ে আধাপাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পর তিরইনহাট ইউনিয়নের ধাইজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এসে পোঁছালাম। মাঠের পাশের ধানক্ষেতে বহু কাঙ্ক্ষিত কালো দোচরা (Red-naped Ibis) পাখিদের জন্য বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও দেখা মিলল না। কাজেই ফের বাংলাবান্ধার দিকে পা বাড়ালাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের দলের দু’জন ওদের মাথার উপর দিয়ে দুটো কালো দোচরাকে উড়ে যেতে দেখল। কিন্তু মোটর সাইকেলে থাকায় ছবি তুলতে ব্যর্থ হলো। 

তেতুলিয়া ডাকবাংলো থেকে ভোরের আলোয় হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্গা চূঁড়া 

যাইহোক, বাংলাবান্ধার কাছে দার্জিলিং রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে সেই অটোতেই প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরের শালবাহান ইউনিয়নের দিকে রওনা হলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর রোদেলা বিকেলে শালবাহান ইউনিয়নের তুলসিয়া বিলে পৌঁছুলাম। চমৎকার বিল। পাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ ও জলজ উদ্ভিদ। বিলের পানি ছেয়ে আছে পানিকলার সাদা ফুলে। অত্যন্ত সুন্দর লাগছে দেখতে। বিল ও ধানক্ষেত ছাড়িয়ে পেছনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ভারতের দার্জিলিংয়ের কার্সিয়াং পাহাড়। তারও পেছনে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে বরফময় শ্বেতশুভ্র হিমালয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিল এ জীবনে খুব কমই দেখেছি।

বিজ্ঞাপন

বিল ও ধানক্ষেতজুড়ে প্রচুর আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটেছে। বিলের এক প্রান্তে বড় একটি গাছে পানকৌড়ি ও সাদা বকের ঝাঁক বসে আছে। বিলের ঠিক সামনে কাঁটা-ঝোপের মধ্যে লালগলা চটক (Red-throated or Taiga Flycatcher) ও টুনটুনির (Common Tailor Bird) দেখা পেলাম। 

তেতুলিয়ায় নতুন আবিষ্কৃত দারুচিনি চড়ুইয়ের স্ত্রী পাখি 

ধানক্ষেতের ধারঘেষে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ’ পরিযায়ী লাঙ্গইল্লা টিটি বা ধূসরমাথা হট্টিটি (Grey-headed Lapwing)। বিলের পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে সরালিসহ তিন প্রজাতির হাঁস ও জলমুরগি। শাপলা পাতার উপর হেঁটে বেড়াচ্ছে সুদর্শন জলপিপি (Bronze-winged Jacana)। শিকারের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কানিবক (Indian Pond Heron)। মাঝে মাঝে তিলা (Western Spotted Dove) ও ধবল ঘুঘু (Eurasian Collared Dove) আসা-যাওয়া করছে। বিলের মধ্যে একটি উঁচুমতো জায়গায় খড়ের স্তূপ রাখা আছে। স্তুপের ঠিক উপরে নীল-খয়েরি-সাদা রঙের সাদাগলা মাছরাঙা (White-throated Kingfisher) পাখি বসে ছিল। হঠাৎই একই প্রজাতির আরেকটি পাখি এসে ওর পাশে বসল। মুহূর্তের মধ্যে কী হলো কে জানে? দুটির মধ্যে শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। দারুণ সে দৃশ্য! একটি আরেকটিকে এই ঠোঁকর মারছে তো আবার ধাওয়া করছে। অন্যটিও থেমে নেই, সমুচিত জবাব দিচ্ছে। লাঙ্গইল্লা টিটির ঝাঁকে সাবাজ টিটি (Northern Lapwing) খুঁজতে গিয়ে যুদ্ধের পুরো চিত্র ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে উপভোগ করলাম। আর শাটারে সমানে ক্লিক করে গেলাম। কিন্তু পেছনে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে ওড়া কোন পাখির ছবি তুলতে পারলাম না। এটাই ছিল আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য। 

শালবাহানের তুলসিয়া বিল; পেছনে দার্জিলিংয়ের কার্সিওং পাহাড় এবং তারও পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা 

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসায় তুলসিয়া বিল পিছনে ফেলে তেতুলিয়ায় শিক্ষা বিভাগের রেস্ট হাউজের দিকে পা বাড়ালাম। তেতুলিয়া সফরে বেশ কয়েকটি পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছি বিভিন্ন সময়। যেমন তেতুলিয়া ডাকবাংলো, বাংলাবান্ধা, তিরইনহাট, তুলসিয়া বিল, পঞ্চগড় সদর, ঠাকুরগাঁও সদরের টাঙ্গন বেরেজ এবং দেবীগঞ্জের তেলিপাড়া চর ও মারেয়া। একেক পয়েন্ট থেকে একেক রকমভাবে দেখেছি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। তবে প্রায় সব পয়েন্টেই কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে নানা প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি উড়তে দেখেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণ করতে পারিনি। যাহোক পরের দিন আমার লক্ষ্যগুলো পূরণ করার প্রত্যয় নিয়ে খুব ভোরে ওঠার তাগিদে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। 

তুলসিয়া বিলে উড়ন্ত ছোট সরালি 

এগারোই নভেম্বর খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ইঞ্জিনভ্যানে চড়ে তেতুলিয়ার ডাকবাংলোর সামনে পৌঁছুলাম। ডাকবাংলো এলাকা একেবারে নীরব, কেউ নেই, আমরাই প্রথম। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ডাকবাংলোর সামনের কনক্রিটের বেঞ্চিতে বসে হিমালয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্গার (৮,৫৮৬ মিটার) অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা শুরু করলাম। আবহাওয়া বেশ ভালো। তাই এই ভোরবেলাতেও চমৎকার ভিউ পাচ্ছি। কিন্তু অপেক্ষায় আছি সূর্যোদয়ে সূর্যের লাল আভা ওর সাদা দেহকে কতটা রাঙায় তা দেখব বলে। গত বছর দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত টাইগার হিলে গিয়েও মেঘের কারণে ওর টিকিটিরও দেখা পাইনি। অবশ্য ঠিক দুদিন পর কালিমপংয়ের লোলেগাঁও থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য ওর দেখা পেয়েছিলাম। তবে তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে বোনাস হিসেবে কুম্ভকর্ণ (৭,৭১১ মিটার), সিনিওলচু (৬,৮৮৮ মিটার) ও লামা আংডেন (৫,৮৬৮ মিটার) পর্বতশৃঙ্গও দেখতে পাচ্ছি। যাক, ঘড়িতে ঠিক ছয়টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সূর্যি মামা উঁকি দিতে শুরু করল, আর মামার লাল আভা কাঞ্চনজঙ্গাকেও রাঙাতে থাকল। প্রায় বিশ মিনিট ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে রাঙিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যি মামা উপরে ওঠে গেল। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার লালচেভাবও আস্তে আস্তে কেটে গেল। 

তুলসিয়া বিলে যাওয়ার পথে নতুন আবিষ্কৃত দারুচিনি চড়ুইয়ের পুরুষ পাখি 

আমার প্রথম লক্ষ্য চমৎকারভাবে উপভোগ শেষে ভ্যানে আবার ছুটলাম তেতুলিয়া থেকে দশ কিলোমিটার দূরের শালবাহান ইউনিয়নের তুলসিয়া বিলের দিকে দ্বিতীয় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। কিছুদূর যাওয়ার পর সরু খালের মতো গোবরা নদী যেখানে রাস্তা স্পর্শ করেছে সেখানকার মনোরম দৃশ্য দেখে ভ্যান থেকে নামলাম। চমৎকার আবহাওয়া, তবে রোদের তেজ একটু বেশি। নদীর আশপাশটা ঘুরে একসময় উল্টোদিকের আঁখ ক্ষেতের দিকে চোখ পড়তেই একঝাাঁক চড়ুইকে আঁখ ফুলের বীচি খেতে দেখলাম। যদিও ঘর চড়ুই (House Sparrow) থেকে কিছুটা ভিন্ন দেখাচ্ছিল, কিন্তু তীর্যকভাবে রোদ পড়ায় ও পাখিগুলো সূর্যের দিকে থাকায় পালকের রং ভালোভাবে বোঝা গেল না। 

তুলসিয়া বিলে যুদ্ধরত দুটি সাদাবুক মাছরাঙা 

দ্রুত তুলসিয়া বিলের দিকে চলে যাওয়ায় গোবরা নদীর পাড়ের পাখিগুলো নিয়ে চিন্তা করার কথা ভুলেই গেলাম। এদেশের পক্ষীতালিকায় চড়ুইটির নাম না থাকায় বিষয়টি চিন্তা করিনি। যাহোক, এরও প্রায় তিন বছর পর একটি পাখি শনাক্ত করতে গিয়ে তেতুলিয়ার ফোল্ডারটি খুলতেই চড়ুইগুলো চোখে পড়ল। এরপর ঘণ্টা দু’য়েক নানা পরীক্ষা, উত্তেজনা ও পক্ষী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার পর দেশের পক্ষীতালিকায় নতুন একটি পাখি যোগ করতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। আর সেই সঙ্গে দেশের চড়ুইয়ের প্রজাতি দুটি থেকে বেড়ে হলো তিনটি। নতুন আবিষ্কৃত এই চড়ুইটির ইংরেজি নাম Russet or Cinnamon Sparrow। এর কোনো বাংলা নাম না থাকায় ইংরেজি শব্দের আভিধানিক অর্থ বিবেচনায় এর নাম দারুচিনি চড়ুই বলা যায়।

যাইহোক, আগের কথায় ফিরে আসা যাক। দেশের জন্য নতুন প্রজাতির দারুচিনি চড়ুই (যদিও তখন পর্যন্ত জানা ছিল না) পাখির ছবি তুলে সকাল আটটা নাগাদ তুলসিয়া বিলে পৌঁছুলাম। কাঞ্চনজঙ্গার এত ভালো ভিউ এখানে ছাড়া অন্য কোথা থেকেও দেখিনি! তুলসিয়া বিলে বহু প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির যেন মেলা বসেছে! বিভিন্ন প্রজাতির বক, জলপিপি, সরালি (Lesser Whistling Duck), পাতারি হাঁস (Common Teal), মরচে রঙ ভূতিহাঁস (Ferruginous Duck), হট্টিটি, ডুবালু (Little Grebe) ও জলজ পাখিতে বিলটি যেন ভরে আছে। এদের কলকাকলী ও ওড়াউড়িতে বিলের মধ্যে যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সরালি ও হট্টিটি একবার পানিতে ভাসছে তো পরক্ষণেই আকাশে উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ওরা কাঞ্চনজঙ্গার বুকেই উড়ে বেড়াচ্ছে। অথচ তুলসিয়া বিল থেকে নেপাল ও সিকিম সীমান্তে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব কম করে হলেও ১৮০ কিলোমিটার। কাঞ্চনজঙ্গার সামনে বিশাল যে পাহাড়টি দেখা যাচ্ছে তা হলো দার্জিলিংয়ের কার্সিওং পাহাড়, তুলসিয়া বিল থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৬১ কিলোমিটার। 

ধাইজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে অন্যান্য পক্ষী আলোকচিত্রীর সঙ্গে লেখক 

যাহোক, আমি বহুবার চেষ্টা করে শেষমেষ কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে পরিযায়ী লাঙ্গইল্লা টিটির ছবি তুলতে সমর্থ হলাম। আমার দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি সফল হলো। তবে, এই দুটো উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে বোনাস হিসেবে যা পেলাম তা হলো দেশের জন্য একটি নতুন পাখি, দারুচিনি চড়ুই।

E-mail: [email protected] , [email protected]