তেতুলিয়ায় হিমালয়ের বুকে পাখি



অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ
তুলসিয়া বিলের উপরে কাঞ্চনজঙ্গার বুকে একঝাঁক উড়ন্ত ধূসর-টিটি

তুলসিয়া বিলের উপরে কাঞ্চনজঙ্গার বুকে একঝাঁক উড়ন্ত ধূসর-টিটি

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশেষ দুটি লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর রাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের শেষ সীমায় অবস্থিত পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় সময়মতো তেতুলিয়া পৌঁছুতে পারলাম না। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। অগ্রগামী টিমের ছয়জন পক্ষী ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী আমাদের ছাড়াই তেতুলিয়ার শালবাহান ইউনিয়নে অবস্থিত তুলসিয়া বিলে পাখি দেখার উদ্দেশ্যে চলে গেল।

কী আর করা? আমরা বাস থেকে নেমে নাস্তা সেরে সোজা রেস্ট হাউজে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর পঞ্চগড়ের পাখি ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী ফিরোজ আল-সাবাহ এলে ওর সঙ্গে বাংলাবান্ধার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাংলাবান্ধা যাওয়ার পথে বহু প্রতিক্ষীত প্রথম লক্ষ্য হিমালয়ের একটি শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলল। আমার দু-চোখ যেন চকচক করে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তা প্রখর রোদের আলোয় জ্বলে গেল। ছবিগুলো মোটেও ভালো হলো না, কেমন যেন একটা জ্বলা জ্বলা ভাব। কাজেই প্রথম দেখাতেই কিছুটা হতাশ হলাম। তবে সাবাহ-এর পরার্মশমতো পরের দিন ভোরের অপেক্ষায় থাকলাম।

বাংলাবান্ধা যাওয়ার পথে জিরো পয়েন্টের কয়েক কিলোমিটার আগে আমাদের বহনকারী অটো হাতের ডানে মোড় নিয়ে আধাপাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পর তিরইনহাট ইউনিয়নের ধাইজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এসে পোঁছালাম। মাঠের পাশের ধানক্ষেতে বহু কাঙ্ক্ষিত কালো দোচরা (Red-naped Ibis) পাখিদের জন্য বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও দেখা মিলল না। কাজেই ফের বাংলাবান্ধার দিকে পা বাড়ালাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের দলের দু’জন ওদের মাথার উপর দিয়ে দুটো কালো দোচরাকে উড়ে যেতে দেখল। কিন্তু মোটর সাইকেলে থাকায় ছবি তুলতে ব্যর্থ হলো। 

তেতুলিয়া ডাকবাংলো থেকে ভোরের আলোয় হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্গা চূঁড়া 

যাইহোক, বাংলাবান্ধার কাছে দার্জিলিং রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে সেই অটোতেই প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরের শালবাহান ইউনিয়নের দিকে রওনা হলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর রোদেলা বিকেলে শালবাহান ইউনিয়নের তুলসিয়া বিলে পৌঁছুলাম। চমৎকার বিল। পাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ ও জলজ উদ্ভিদ। বিলের পানি ছেয়ে আছে পানিকলার সাদা ফুলে। অত্যন্ত সুন্দর লাগছে দেখতে। বিল ও ধানক্ষেত ছাড়িয়ে পেছনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ভারতের দার্জিলিংয়ের কার্সিয়াং পাহাড়। তারও পেছনে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে বরফময় শ্বেতশুভ্র হিমালয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিল এ জীবনে খুব কমই দেখেছি।

বিল ও ধানক্ষেতজুড়ে প্রচুর আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটেছে। বিলের এক প্রান্তে বড় একটি গাছে পানকৌড়ি ও সাদা বকের ঝাঁক বসে আছে। বিলের ঠিক সামনে কাঁটা-ঝোপের মধ্যে লালগলা চটক (Red-throated or Taiga Flycatcher) ও টুনটুনির (Common Tailor Bird) দেখা পেলাম। 

তেতুলিয়ায় নতুন আবিষ্কৃত দারুচিনি চড়ুইয়ের স্ত্রী পাখি 

ধানক্ষেতের ধারঘেষে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ’ পরিযায়ী লাঙ্গইল্লা টিটি বা ধূসরমাথা হট্টিটি (Grey-headed Lapwing)। বিলের পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে সরালিসহ তিন প্রজাতির হাঁস ও জলমুরগি। শাপলা পাতার উপর হেঁটে বেড়াচ্ছে সুদর্শন জলপিপি (Bronze-winged Jacana)। শিকারের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কানিবক (Indian Pond Heron)। মাঝে মাঝে তিলা (Western Spotted Dove) ও ধবল ঘুঘু (Eurasian Collared Dove) আসা-যাওয়া করছে। বিলের মধ্যে একটি উঁচুমতো জায়গায় খড়ের স্তূপ রাখা আছে। স্তুপের ঠিক উপরে নীল-খয়েরি-সাদা রঙের সাদাগলা মাছরাঙা (White-throated Kingfisher) পাখি বসে ছিল। হঠাৎই একই প্রজাতির আরেকটি পাখি এসে ওর পাশে বসল। মুহূর্তের মধ্যে কী হলো কে জানে? দুটির মধ্যে শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। দারুণ সে দৃশ্য! একটি আরেকটিকে এই ঠোঁকর মারছে তো আবার ধাওয়া করছে। অন্যটিও থেমে নেই, সমুচিত জবাব দিচ্ছে। লাঙ্গইল্লা টিটির ঝাঁকে সাবাজ টিটি (Northern Lapwing) খুঁজতে গিয়ে যুদ্ধের পুরো চিত্র ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে উপভোগ করলাম। আর শাটারে সমানে ক্লিক করে গেলাম। কিন্তু পেছনে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে ওড়া কোন পাখির ছবি তুলতে পারলাম না। এটাই ছিল আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য। 

শালবাহানের তুলসিয়া বিল; পেছনে দার্জিলিংয়ের কার্সিওং পাহাড় এবং তারও পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা 

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসায় তুলসিয়া বিল পিছনে ফেলে তেতুলিয়ায় শিক্ষা বিভাগের রেস্ট হাউজের দিকে পা বাড়ালাম। তেতুলিয়া সফরে বেশ কয়েকটি পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছি বিভিন্ন সময়। যেমন তেতুলিয়া ডাকবাংলো, বাংলাবান্ধা, তিরইনহাট, তুলসিয়া বিল, পঞ্চগড় সদর, ঠাকুরগাঁও সদরের টাঙ্গন বেরেজ এবং দেবীগঞ্জের তেলিপাড়া চর ও মারেয়া। একেক পয়েন্ট থেকে একেক রকমভাবে দেখেছি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। তবে প্রায় সব পয়েন্টেই কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে নানা প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি উড়তে দেখেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণ করতে পারিনি। যাহোক পরের দিন আমার লক্ষ্যগুলো পূরণ করার প্রত্যয় নিয়ে খুব ভোরে ওঠার তাগিদে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। 

তুলসিয়া বিলে উড়ন্ত ছোট সরালি 

এগারোই নভেম্বর খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে আগে থেকে ঠিক করে রাখা ইঞ্জিনভ্যানে চড়ে তেতুলিয়ার ডাকবাংলোর সামনে পৌঁছুলাম। ডাকবাংলো এলাকা একেবারে নীরব, কেউ নেই, আমরাই প্রথম। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ডাকবাংলোর সামনের কনক্রিটের বেঞ্চিতে বসে হিমালয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্গার (৮,৫৮৬ মিটার) অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা শুরু করলাম। আবহাওয়া বেশ ভালো। তাই এই ভোরবেলাতেও চমৎকার ভিউ পাচ্ছি। কিন্তু অপেক্ষায় আছি সূর্যোদয়ে সূর্যের লাল আভা ওর সাদা দেহকে কতটা রাঙায় তা দেখব বলে। গত বছর দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত টাইগার হিলে গিয়েও মেঘের কারণে ওর টিকিটিরও দেখা পাইনি। অবশ্য ঠিক দুদিন পর কালিমপংয়ের লোলেগাঁও থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটায় মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য ওর দেখা পেয়েছিলাম। তবে তেতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে বোনাস হিসেবে কুম্ভকর্ণ (৭,৭১১ মিটার), সিনিওলচু (৬,৮৮৮ মিটার) ও লামা আংডেন (৫,৮৬৮ মিটার) পর্বতশৃঙ্গও দেখতে পাচ্ছি। যাক, ঘড়িতে ঠিক ছয়টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সূর্যি মামা উঁকি দিতে শুরু করল, আর মামার লাল আভা কাঞ্চনজঙ্গাকেও রাঙাতে থাকল। প্রায় বিশ মিনিট ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে রাঙিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যি মামা উপরে ওঠে গেল। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার লালচেভাবও আস্তে আস্তে কেটে গেল। 

তুলসিয়া বিলে যাওয়ার পথে নতুন আবিষ্কৃত দারুচিনি চড়ুইয়ের পুরুষ পাখি 

আমার প্রথম লক্ষ্য চমৎকারভাবে উপভোগ শেষে ভ্যানে আবার ছুটলাম তেতুলিয়া থেকে দশ কিলোমিটার দূরের শালবাহান ইউনিয়নের তুলসিয়া বিলের দিকে দ্বিতীয় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। কিছুদূর যাওয়ার পর সরু খালের মতো গোবরা নদী যেখানে রাস্তা স্পর্শ করেছে সেখানকার মনোরম দৃশ্য দেখে ভ্যান থেকে নামলাম। চমৎকার আবহাওয়া, তবে রোদের তেজ একটু বেশি। নদীর আশপাশটা ঘুরে একসময় উল্টোদিকের আঁখ ক্ষেতের দিকে চোখ পড়তেই একঝাাঁক চড়ুইকে আঁখ ফুলের বীচি খেতে দেখলাম। যদিও ঘর চড়ুই (House Sparrow) থেকে কিছুটা ভিন্ন দেখাচ্ছিল, কিন্তু তীর্যকভাবে রোদ পড়ায় ও পাখিগুলো সূর্যের দিকে থাকায় পালকের রং ভালোভাবে বোঝা গেল না। 

তুলসিয়া বিলে যুদ্ধরত দুটি সাদাবুক মাছরাঙা 

দ্রুত তুলসিয়া বিলের দিকে চলে যাওয়ায় গোবরা নদীর পাড়ের পাখিগুলো নিয়ে চিন্তা করার কথা ভুলেই গেলাম। এদেশের পক্ষীতালিকায় চড়ুইটির নাম না থাকায় বিষয়টি চিন্তা করিনি। যাহোক, এরও প্রায় তিন বছর পর একটি পাখি শনাক্ত করতে গিয়ে তেতুলিয়ার ফোল্ডারটি খুলতেই চড়ুইগুলো চোখে পড়ল। এরপর ঘণ্টা দু’য়েক নানা পরীক্ষা, উত্তেজনা ও পক্ষী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার পর দেশের পক্ষীতালিকায় নতুন একটি পাখি যোগ করতে পেরে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। আর সেই সঙ্গে দেশের চড়ুইয়ের প্রজাতি দুটি থেকে বেড়ে হলো তিনটি। নতুন আবিষ্কৃত এই চড়ুইটির ইংরেজি নাম Russet or Cinnamon Sparrow। এর কোনো বাংলা নাম না থাকায় ইংরেজি শব্দের আভিধানিক অর্থ বিবেচনায় এর নাম দারুচিনি চড়ুই বলা যায়।

যাইহোক, আগের কথায় ফিরে আসা যাক। দেশের জন্য নতুন প্রজাতির দারুচিনি চড়ুই (যদিও তখন পর্যন্ত জানা ছিল না) পাখির ছবি তুলে সকাল আটটা নাগাদ তুলসিয়া বিলে পৌঁছুলাম। কাঞ্চনজঙ্গার এত ভালো ভিউ এখানে ছাড়া অন্য কোথা থেকেও দেখিনি! তুলসিয়া বিলে বহু প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখির যেন মেলা বসেছে! বিভিন্ন প্রজাতির বক, জলপিপি, সরালি (Lesser Whistling Duck), পাতারি হাঁস (Common Teal), মরচে রঙ ভূতিহাঁস (Ferruginous Duck), হট্টিটি, ডুবালু (Little Grebe) ও জলজ পাখিতে বিলটি যেন ভরে আছে। এদের কলকাকলী ও ওড়াউড়িতে বিলের মধ্যে যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সরালি ও হট্টিটি একবার পানিতে ভাসছে তো পরক্ষণেই আকাশে উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ওরা কাঞ্চনজঙ্গার বুকেই উড়ে বেড়াচ্ছে। অথচ তুলসিয়া বিল থেকে নেপাল ও সিকিম সীমান্তে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব কম করে হলেও ১৮০ কিলোমিটার। কাঞ্চনজঙ্গার সামনে বিশাল যে পাহাড়টি দেখা যাচ্ছে তা হলো দার্জিলিংয়ের কার্সিওং পাহাড়, তুলসিয়া বিল থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৬১ কিলোমিটার। 

ধাইজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে অন্যান্য পক্ষী আলোকচিত্রীর সঙ্গে লেখক 

যাহোক, আমি বহুবার চেষ্টা করে শেষমেষ কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে পরিযায়ী লাঙ্গইল্লা টিটির ছবি তুলতে সমর্থ হলাম। আমার দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি সফল হলো। তবে, এই দুটো উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে বোনাস হিসেবে যা পেলাম তা হলো দেশের জন্য একটি নতুন পাখি, দারুচিনি চড়ুই।

E-mail: [email protected] , [email protected]

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;