হলুদের বিষক্রিয়া দূরীকরণে বাংলাদেশের সাফল্য

  • ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সীসার বিষক্রিয়ার হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৯  সালে এই অঞ্চলে কমপক্ষে ১৪ লাখ মানুষ সীসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই বছরই একই কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের  (জিডিপি) প্রায় ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে অনুমান করা হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বিশ্বে সীসার বিষক্রিয়ার হার সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ এশিয়ায়।

হলুদ হলো আদা প্রজাতির একটি উদ্ভিদ। দীর্ঘকাল ধরে এর প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধে এবং এশীয় রান্নায় ব্যবহৃত হয় হলুদ। এর সুগন্ধ এবং প্রাণবন্ত রঙ মূলত বেশি আকর্ষনীয় ও মূল্যবান। হলুদ কখনও  মশলা আবার কখনও রূপচর্চার উপকরণ। হলুদের সোনালি রঙের বেশি ভক্ত এই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলেই।

বিজ্ঞাপন

হলুদ যেভাবে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়

দক্ষিণ এশিয়ায় তরকারিতে স্বাদ, গন্ধ আর রং বাড়িয়ে তুলতে হলুদের যেন কোনো বিকল্প নেই। তরকারিটা একটু ভালোমতো রান্না করতে হলে হলুদের দরকার।  অনেকেই মনে করেন হলুদ খাওয়া, এমনকি হলুদ মেখে গোসল করাও শরীরের জন্য উপকারী। যেকোনো দক্ষিণ এশীয়ই বিশ্বাস করেন যে, হলুদ রূপচর্চায় ভীষণ সহায়ক উপাদান। তবে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক স্থানে হলুদের জন্যই মানুষকে ভয়াবহ পরিণতির শিকার হতে হচ্ছে। কারণ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হওয়া এসব হলুদে রং বাড়াতে নিয়মিত মেশানো হয় সিসা (লেড ক্রোমেট)। হলুদের রং আরেকটু ধারালো করতে মিশ্রিত এ ভেজাল প্রাণনাশের কারণ হচ্ছে অনেকের।

বিজ্ঞাপন

সিসা বা লেড ক্রোমেট হলো এক ধরনের নিউরোটক্সিন যা হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। খাবারে সিসার উপস্থিতি থাকলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপদের ঝুঁকিতে পড়ে। ভয়াবহ এই ভেজাল সিসা শিশুদের অবধারণগত বিকাশকে প্রতিহত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর শিশুদের তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের ২০ শতাংশ লার্নিং গ্যাপ রয়েছে। এই লার্নিং গ্যাপের পেছনে বিষাক্ত সিসার সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাজারজাত এসব সিসা মিশ্রিত হলুদ সেবনে বা ব্যবহারে শিশুদের এই সমস্যা হয় বলে প্রমাণ করেন গবেষকরা।

ল্যান্সেট প্ল্যানেটারি হেলথ-এ প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের রক্তে সিসার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে রান্নার বাসনকোসন থেকে শুরু করে প্রসাধনী সবকিছুতেই ধাতুর ছড়াছড়ি বলে এত ধাতুর উৎসকে সুনির্দিষ্ট করে শনাক্ত করাও দুরূহ।

হলুদে রং বাড়াতে নিয়মিত মেশানো হয় সিসা (লেড ক্রোমেট)

হলুদ থেকে বিষাক্ত সিসা দূরীকরণে বাংলাদেশের সাফল্য, শেখার আছে প্রতিবেশী দেশগুলোরও

২০১৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্স, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি)-এর একদল গবেষক হলুদের ভেজাল এবং হলুদ থেকে বিষাক্ত সিসা দূর করার বিষয়ে মনোযোগ গবেষণা শুরু করেন। তখন হলুদে সিসার ব্যবহার সমূলে উচ্ছেদ করতে দেশজুড়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেছিল খাদ্য-নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদরা। এসময়ে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং দ্রুত নীতি বাস্তবায়নের লাগাতার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন গবেষকরা।

এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশের এ হলুদ থেকে বিষাক্ত সিসা দূরীকরণ উদ্যোগ দারুণভাবে সফল হয়েছে। স্বাস্থ্যের ওপর এই পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে। হলুদ কারখানার শ্রমিকদের রক্তে সিসার পরিমাণ গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অন্যদিকে মাত্র দুই বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের বাজারে সিসাযুক্ত হলুদের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ থেকে কমে শূন্য শতাংশে নেমে আসে।

নিউইয়র্কভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক এনজিও পিউর আর্থ-এর এক প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মাত্র এক ডলার খরচেই জনসাধারণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে। সেইসাথে বাড়ছে গড় আয়ুও। তবে সরাসরি আর্থিকভাবে একই সাফল্য পেতে হলে আনুমানিক ৮৩৬ ডলার খরচ করতে হতো। ক্যাম্পেইন কার্যক্রমের এমন সফলতা এবং সাশ্রয়ী দি যেকোনো দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো হলুদের সীসা দূর করা এই উদ্যোগ যত দ্রুত সম্ভব গ্রহণ করা প্রয়োজন।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনা ফরসিথ বলেন, নীতিনির্ধারকদের কাছে সমস্যাটি বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে ব্যাখ্যা করার কারণেই তাদের কাছ থেকে সহজেই সমর্থন আদায় করা গেছে। বাংলাদেশের দ্রুত নীতি বাস্তবায়নের এ সাফল্য সত্যিই আশ্চর্যজনক।

২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের দিকে ফরসিথ ও তার সহকর্মীরা বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় গর্ভবতী নারীদের মধ্যে সিসার উচ্চ উপস্থিতি ও হলুদ খাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দেখাতে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন। এ গবেষণার ফলাফল দেখিয়েই বাংলাদেশের খাদ্য-নিরাপত্তা বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পর্যন্ত রাজি করাতে পেরেছিলেন তারা।

তবে অর্থায়ন ছাড়াও ক্যাম্পেইন সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল গণমাধ্যমেও প্রচারণা। এসব প্রচারণায় সিসা মেশানো হলুদের ভয়াবহতা নিয়ে গ্রাফিক আধেয় (কনটেন্ট) প্রদর্শনের মাধ্যমে দর্শকদের সতর্ক করা হয়েছিল। সমস্যাটির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জাতীয় টেলিভিশনে কথাও বলেছিলেন শেখ হাসিনা। বাজার ও পাবলিক এলাকাগুলোতে হলুদে সিসার উপস্থিতি ও বিষক্রিয়া নিয়ে প্রায় ৫০ হাজার বিজ্ঞপ্তি লাগানো হয়েছিল। সবথেকে বেশি পরিমাণ মানুষকে সিসার ভয়াবহতা সংশ্লিষ্ট এসব তথ্য পৌঁছে দিতে কার্যকর সকল ক্যাম্পেইন কৌশলই অবলম্বন করেছিলেন গবেষকরা।

তাদের কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল শ্রমিকদের রক্তে সিসার বিষক্রিয়ার প্রমাণ প্রদর্শন করা। এক্ষেত্রে কারখানা থেকে শ্রমিকদের রক্ত সংগ্রহ করে, শ্রমিকদের দেহের বিভিন্ন রোগের সঙ্গে সিসার সম্পর্ক দেখিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করেন গবেষকেরা।

সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে গবেষকদের সহায়তা করেছে সরকার এবং রাজনীতিবিদরাও। ক্যাম্পেইন চলাকালীন সময়েই হলুদে ভেজাল মেশানো অপরাধ বলে ঘোষণা করে সরকার। বড় একটি হলুদ প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরকারি অভিযান পরিচালনা শুরু হয়। দেশের সর্বত্র পরিচালিত এসব অভিযান জনসচেতনতার লক্ষ্যে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। ভেজালমিশ্রিত হলুদ বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই পাইকারি ব্যবসায়ীকে দণ্ডও দেওয়া হয়েছিল।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও একই ধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করতে পারবেন বলে প্রত্যাশা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের। বাংলাদেশে হলুদে ব্যবহার করা বিষাক্ত সিসার বেশিরভাগই আমদানি হয়েছিল ভারত থেকে। তাই ভারতেই হলুদে ভেজালের হার সবচেয়ে বেশি এবং এ সমস্যা বাংলাদেশের চেয়েও তুলনামূলক গভীরে প্রোথিত বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে হলুদের সরবরাহ শিখলও বড়। ভারতে অল্পকিছু পাইকারি বিক্রেতা পুরো দেশে হলুদ সরবরাহ করে বলে প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল। তবুও বাংলাদেশে পরিচালিত ক্যাম্পেইনটির অভিজ্ঞতা ভারত বা পাকিস্তানের সব ধরনের নীতিগত সমস্যায় প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করেন গবেষকরা।

সূত্র: দ্য ইকোনোমিস্ট, অনুবাদক: আসমা ইসলাম