গৌরবের দীপশিখা হয়ে ফিরছেন খাসিয়া বীর

  • আশরাফুল ইসলাম, ইতিহাস গবেষক ও পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বনাঞ্চল ও পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত উপমহাদেশের বহু জনপদে মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন করেন যেই আদিবাসীরা, সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় তারাই ছিটকে পড়েন সবার আগে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের পথ ধরে বহু প্রাণের বিনিময়ে আসে কাঙ্খিত যে স্বাধীনতা সেখানে গৌরবের বরমাল্যে তাদের আমরা ভূষিত করিনি। যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতেই পারেনি আমাদের উপভোগ করা স্বাধীনতার চড়া মূল্য আসলে কারা পরিশোধ করে গেছেন! প্রকৃত বীরদের পশ্চাতে রেখে কপটতা আর চাতুর্যের দৌলতে অনেকেই মেকি বীরের ভেক ধরেছেন যুগে যুগে। কিন্তু অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ পটভূমিকায় যে অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমরা ভুলে গেছি, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ তাতে আরও ছায়া ফেলেছে।

ইউ তিরৎ সিং তেমনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাকে আমরা আমরা ভুলে গেছি। বর্তমান ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় অঞ্চলের রাজা তিরৎ সিং নিজ রাজ্যকে রক্ষায় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে চার বছরব্যাপী এক রক্তাক্ত সংগ্রামে পরাজিত ও আহত অবস্থায় আটক হয়ে ঢাকাতে কারাবন্দি হন। এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে-১৮৩৫ সালের ১৭ জুলাই ঢাকায় কারাবন্দি অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। খণ্ডিত স্বদেশে ম্রিয়মান স্বাধীনতার চেতনায় ‘খাসিয়া বীর’ ইউ তিরৎ সিং নামটি প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল! সাম্প্রতিক দশকে মেঘালয়-আসামের প্রজন্মের কাছে তিরৎ সিংয়ের বীরোচিত উপাখ্যান প্রেরণা ও জাগরণের বিষয় হয়ে ফের ধরা দিয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের আনুকূল্যে তা হয়ে উঠে সার্বজনীন আগ্রহ ও আবেগের বিষয়। গড়ে ইউ তিরৎ সিংহের নামে সৌধসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো। আঞ্চলিক সাহিত্য ও সঙ্গীতেও উৎকীর্ণ হয়েছে তার বীরত্বগাঁথা।

বিজ্ঞাপন

সেই সঙ্গে দাবি উঠে, অকুতোভয় এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনের শেষ দিনগুলির স্মৃতিবিজড়িত ঢাকায় তার স্মৃতি রক্ষায় কিছু প্রচেষ্টা নেওয়ার। জনাকাঙ্ক্ষার সেই প্রতিফলনও অবশেষে বাস্তব হতে চলেছে। আমরা জানতে পেরেছি, মেঘালয় সরকারের আগ্রহে এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ও আনুকূল্যে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ব্যবস্থাপনায় ধানমন্ডিতে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে স্থাপিত হয়েছে খাসিয়া বীর ইউ তিরৎ সিংয়ের পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য। আরও আনন্দের খবর যে, মেঘালয়ের উপমুখ্যমন্ত্রী স্নিয়াভলং ধরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তিরৎ সিংয়ের ভাস্কর্য উন্মোচনে ঢাকায় আসছেন। তাদের এই সফর যেমন খাসিয়া জনগোষ্ঠীর আবেগকে স্পর্শ করবে তেমনি বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে। কেননা মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী জনপদে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসী ও ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে যে অকৃত্রিম সাহায্য ও সহযোগীতা করা হয়েছে তা আজও মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এই সফর নাগরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিকে আরও নিবিড় করে তুলতে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করা যায়।

সফরকালে মেঘালয়ের প্রতিনিধি দলের পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কে অবস্থিত পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার (যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তর করার কাজ চলমান) পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের গৌরবের নাম তিরৎ সিংয়ের বন্দিদশার বেদনাবিদূর স্মৃতিকে ছুঁয়ে দেখার ব্যাকুলতা নিয়ে আসা মেঘালয়ের প্রতিনিধিরা হয়ত দেখার মতো কোন স্মৃতিই আজ আর অবশিষ্ট পাবেন না। কেননা শাসনতান্ত্রিক পালাবদলে প্রায় দুশো বছরের পুরনো সেই ঘটনার কিছুই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি পরবর্তীতে। কিন্তু আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ ইউ তিরৎ সিংহের স্মৃতিকে ধরে রাখতে কারা জাদুঘর হিসেবে উন্মোচিত হতে চলা জাদুঘরে তার একটি ভাস্কর্য লিখিত ইতিহাসসহ স্থাপনের দাবি জানাতেই পারি।

বিজ্ঞাপন

কেবল তিরৎ সিং নন, এই কারাগারে অন্তরীণ থাকা ও ফাঁসি কার্যকর হওয়া ব্রিটিশবিরোধী অন্য সকল স্বাধীনতা সংগ্রামীর সচিত্র বিবরণ উৎকীর্ণ করারও দাবি জানাব। আমরা জানি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাকিস্তান শাসনামলে বহু বরেণ্য রাজনীতিক অন্তরীণ ছিলেন; আমরা এও জানি এই কারাগারেই জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সকল বীরদের আত্মত্যাগের মহিমা ভাস্বর হয়ে উঠুক সংস্কারাধীন এই কারা জাদুঘরে, এটি আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা। 

সাম্প্রতিক বছরে দেখে এসেছি, কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গৌরবদীপ্ত ও বেদনাসিক্ত আখ্যান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কিভাবে মূর্ত করে তোলা হয়েছে।  গেল বছর আরও দেখে এসেছি পশ্চিমবঙ্গের খড়কপুরে হিজলী বন্দিশালা, যা বর্তমানে আইআইটি, খড়কপুরের অভ্যন্তরে অবস্থিত। সেখানে বন্দিশালায় স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত মেরে ফেলার সেই নিষ্ঠুর কারাকুঠুরি! নূন্যতম আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ না রেখে কিভাবে তথাকথিত ‘সভ্য জাতি’ ব্রিটিশরা স্বাধীনতার আকাঙ্খা পোষণের ‘অপরাধে’ এমন নিষ্ঠুর কারাপ্রকোষ্ঠ বানাতে পারেন দূরকল্পনাকেও হার মানাবে। 

গেল ২৩ জানুয়ারি (২০২৪) ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশের জামশেদপুরের আদিত্যপুরে গিয়েছিলাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মোৎসবের এক মহা আয়োজনে যোগ দিতে। সেই আয়োজনের পুরোধা দেশভক্ত ও বিপ্লবীদের অনুরাগী পি কে নন্দী অরণ্যবেষ্টিত ঝাড়খ-ে অরণ্যচারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্বর ব্রিটিশ বাহিনীর অন্যায় করারোপের প্রতিবাদে রুষে উঠার আখ্যান মেলে ধরেছিলেন তাদের স্থানীয় ‘ছৌনাচ’ এর মাধ্যমে। যেখানে আমরা জানতে পারি, পশ্চাদপদ জনপদের আদিবাসীরাও কিভাবে প্রাণপণে লড়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য, তাদের স্বাধীকারের জন্য। সেখানকার মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর বীরযোদ্ধা বিরসা মুণ্ডা তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিরসা মুণ্ডার সেই বীরোচিত আখ্যান আজ নানা লোকজ সাংস্কৃতিক মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বিরসা মুণ্ডা আজ এক শক্তি ও প্রেরণার নাম।

পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর ক্রমান্তরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ ব্রিটিশশাসনের করতলে আসতে থাকে। আসামসহ ও উত্তর-পূর্ব ভারত অধিকারে আনতে তৎপর ব্রিটিশ বাহিনী সিলেট থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত দুর্গম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণে খাসিয়া রাজা ইউ তিরৎ সিংয়ের শরণাপন্ন হন। ১৮২৭ সালে সড়ক নির্মাণের জন্য ব্রিটিশদের অনুমতি দিলেও অচিরেই তাদের অভিসন্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই অনুমতি যে খাসিয়াদের শোষণের হাতিয়ার হতে চলেছে, তিরৎ সিং তা বুঝতে পারেন এবং সড়ক নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেন।

যদিও ইংরেজরা তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলশ্রুতিতে নিজস্ব স্থানীয় সমরশক্তি ও খাসিয়া অধিবাসীদের অপরিসীম মনোবল সঙ্গী করে তিরৎ সিং ১৮২৯ সালের ৪ এপ্রিল ইংরেজদের হটাতে প্রবল আক্রমণ শুরু করেন। এতে বহু ইংরেজ সেনাদের সঙ্গে প্রাণ হারান দুই ইংরেজ সেনাকর্তা লেফট্যানেন্ট বার্লটন ও লেফট্যানেন্ট বেডিংফিল্ড। রক্তাক্ত এই যুদ্ধ চলে চার বছর ধরে। কিন্তু ইংরেজদের আধুনিক সমরাস্ত্র ও সমরকৌশলে এক পর্যায়ে খাসিয়াদের পরাস্ত হতে হয়, যদিও খাসিয়া যোদ্ধাদের গেরিলা সমরকৌশলে নাস্তানাবুদ হওয়া ব্রিটিশ বাহিনীকে অনেক মূল্য দিতে হয় এই খন্ড যুদ্ধে। আহত খাসিয়া রাজা তিরৎ সিং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেও বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ৯ জানুয়ারি ১৮৩৩ সালে ধৃত হন।

মেঘালয়ের সরকারি নথিপত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, রাজা ইউ তিরৎ সিংকে গুয়াহাটি নিয়ে বিচারের প্রহসন সাজিয়ে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। বন্দিদশায় অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতো এই খাসিয়া বীরকেও কি ধরণের বর্বরতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। ঢাকায় বন্দিদশায় আরও ২ বছর বেঁচে ছিলেন তিরৎ সিং। ১৮৩৫ সালের ১৭ জুলাই মাত্র ৩৩ বছর বয়েসে মৃত্যু হয় এই অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামীর। গবেষক হারুন হাবিবের লেখায় আমরা জানতে পারছি, প্রথমে ঢাকা কারাগারে অন্তরীন করা হলেও পরবর্তীতে ঢাকার  কোতোয়ালিতে বরকন্দাজের প্রহরায় একটি বাড়িতে বন্দি রাখা হয় তিরৎ সিংকে, বাড়িটির অবস্থায় পুরান ঢাকার গীরদকিল্লায় বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। যা বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরির পাশে।

পরবর্তী সময়গুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মাটিচাপা দেওয়ার যে প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি তাতে ইউ তিরৎ সিংয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, মেঘালয়ের সরকার ও জনগণ যেভাবে তাদের হৃতগৌরকে উচ্চে তুলে ধরতে তৎপর হয়েছে তা খণ্ডিত স্বদেশের অপরাপর অংশকেও জাগিয়ে তুলুক। কেননা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের যে গৌরব এই অঞ্চলের রয়েছে তা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত। গৌরবের পরম্পরাকে এগিয়ে নিতে ব্রাত্য করে রাখা ইতিহাসের চর্চা খুবই জরুরি।