খাঁচায় জন্ম, খাঁচায় মৃত্যু যে পাখির
বাজরিগর শব্দটি শুনলেই মনে হবে কোন শিকারি কিংবা সাহসী কোন ব্যক্তি বা পশু। নামে ক্ষিপ্রতার আবেশ থাকলেও বাস্তবে শান্ত-সৌন্দর্যের এক ছোট পাখির নাম বাজরিগর।
বাঁকা ঠোঁট। হলুদ, নীল, সাদা বা মিশ্র রঙের গায়ের বরণ। কখনো রঙধনুর সব রঙ নিয়ে জন্ম নেয় পৃথিবীতে। যদিও গায়ের রঙ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি আছে এই পাখির। তবে রঙ যাই হোক বুদ্ধিমত্তায় অতুলনীয় ছোট পাখিটি। সঙ্গীকে আপন করে নিয়ে আলতো ছোঁয়াতে কখনো ঠোঁটে ঠোঁট, কখনো দায়িত্ববান প্রিয়জন হয়ে সঙ্গীর মাথায় আলতো ছুঁয়ে ভালোবাসার জানান দেওয়ার অনন্য গুণ আছে এই পাখির।
এত সব গুণ আর খুব সহজে পোষ মানতে বাধ্য বাজরিগর পাখিপ্রেমীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে। শারীরিক কসরতে কারণে না চাইলেও মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পটু বাজরিগর পাখি। তাই তো বাজরিগরকে খাঁচায় বন্দি করে পোষ মানাতে মরিয়া থাকে পাখিপ্রেমীরা। মানুষের চাহিদাকে পুঁজি করে বাণিজ্যিক খামারও গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু দেশের পরিবেশ বাজরিগর পাখির জন্য অনুকূল না হওয়ায় খোলা আকাশে এই পাখি পালন সম্ভব নয়। তাই সময়ের সাথে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চলগুলোর বনাঞ্চলের বাজরিগরের বর্তমান সারসংক্ষেপ খাঁচায় জন্ম, খাঁচায় মৃত্যু।
বাজরিগর পাখি পরিচিত একটি পোষা পাখি হলেও স্থান ও অঞ্চল ভেদে এর পরিচিতি আছে ভিন্ন নামে। আমেরিকায় বাজরিগর লিট্টল প্যারাকিট নামে পরিচিত। এছাড়াও এই পাখি বাজি বা শেল প্যারাকিট, ক্যানারি প্যারট, জেব্রা প্যারট, কমন পেট প্যারাকিট, আন্ডুলেটেড প্যারাকিট বাজরিগর এবং বদরী নামেও পরিচিত।
সাধারণত বন্য বাজরিগর লম্বায় প্রায় ৬.৫–৭ ইঞ্চি এবং খাঁচায় প্রায় ৭–৮ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এছাড়া বন্য বাজরিগর ২৫–৩৫ গ্রাম এবং খাঁচায় পালন করা বাজরিগর ৩৫–৪০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বাজরিগরের নাকের ছিদ্রের চারপাশে নীল রঙের ঝিল্লি থাকে। এই ঝিল্লি কপাল ও ঠোঁটের মাঝে নাকের ছিদ্রসহ বিস্তৃত। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী বাজরিগরের নাকের ছিদ্রের চারপাশে বাদামি রঙের ঝিল্লি দিয়ে ঘেরা থাকে। এই ঝিল্লি কপাল ও ঠোঁটের মাঝে নাকের ছিদ্রসহ বিস্তৃত।
৮-৯ মাস বয়সে বাজরিগর প্রাপ্তবয়স্ক হয়। এক সাথে ৮-১৩টি ডিম দিতে সক্ষম বাজরিগর পাখি। আর ডিম দেওয়ার সময়ে বাজরিগর পাখির নির্জন জায়গারও প্রয়োজন হয়। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে ১৮ দিন সময় লাগে। বাজরিগর পাখির গড় আয়ু ৪-৫ বছর, তবে খাঁচায় ১০-১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
ছোট প্রজাতির এ পাখিটি এর বুদ্ধিমত্তার জন্যও বেশ জনপ্রিয়। শ্রবণ ক্ষমতাও অনেক ভাল। খুব সহজে বড় শব্দ বা বাক্য মনে রাখতে পারে। বাজরিগর তার মালিকের থেকে কোন শব্দ শোনামাত্র এরা মনে রাখতে পারে এবং বার বার তা বলতে থাকে। তাই পাখিপ্রেমীদের আকর্ষণ ও বেশি বাজরিগরে।
বিদেশি পাখি হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায় বাজরিগর পাখি। এছাড়া রাজধানীর কাঁটাবন এলাকার ইউনিভার্সিটি মার্কেটে প্রতিদিনই মেলা বসে বাজরিগর পাখির। উপকূল অঞ্চল এই পাখির আদিস্থল হলেও খাঁচায় এক বা একাধিক সঙ্গী তাদের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে ইউনিভার্সিটি মার্কেটে খাঁচায় পাখির পরিবার সাজিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পুরুষ ও নারী বাজরিগরের মিলন ঘটিয়ে বয়স ভেদে জুটি করার চেষ্টা করেছেন তারা। এক সাথে অনেক বাজরিগর পাখি থাকায় কিচিরমিচির আর সৌন্দর্য কাছে টানে পথচারীদের।
নিউ বার্ড প্যারাডাইসের ম্যানেজার মো. নূর হোসেন বলেন, সৌন্দর্য ও নমনীয় হওয়ায় পাখিপ্রেমীদের পছন্দের শীর্ষে বাজরিগর। আমরা আগে বিদেশ থেকে আনলেও এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজরিগর পাখির খামার গড়ে উঠেছে । ৫০০-১০০০ টাকায় খাঁচাসহ পাখি মিলছে । আমরা পাখির খাবার সাথে পরিচর্যার সকল বিষয় জানিয়ে দেওয়ায় খুব সহজে পাখিটি পালন করতে পারে যে কেউ।
এদিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে বাজরিগর পাখির খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। তাদের মধ্যে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ইমরান হোসেন। মাত্র ১৩ হাজার টাকা দিয়ে এ পাখির বাণিজ্যিক খামার গড়ে তুলে তিনি এখন স্বাবলম্বী। বর্তমানে তার খামারে প্রায় ৩ লাখ টাকার পাখি আছে। এবং বাজরিগর পাখি বিক্রি করেই এখন ইমরানের মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। দীর্ঘদিন বাজরিগর পাখি পালনে বেশ অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন তিনি।
ইমরান হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের দেশের যে পরিবেশ তাতে খোলা আকাশে বাজরিগর পাঁচ মিনিটও বেঁচে থাকতে পারবে না। অন্য পাখির আক্রমণ ও মাটিতে সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর ও ছোট পশুর আক্রমণ থেকে পালাতেও পারবে না। ফলে দেশে এ পাখি খাঁচা বা ছোট ঘরে পালনই উত্তম।
বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে প্রবাদ থাকলেও প্রকৃতি ও পরিবেশ কখনো কখনো তার ব্যতিক্রম চায়। আর তাই তো সৌন্দর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে খাঁচায় জন্ম খাঁচায় মৃত্যু বাজরিগর পাখির এখন বড় পরিচয়।