হারিয়ে যাচ্ছে বিহারি ঐতিহ্যের কারচুপি-জারদৌসি শিল্প
চট্টগ্রামের বিহারিপল্লীতে একসময় কারচুপি ও জারদৌসি কারিগরদের বেশ হাঁকডাক ছিল। কোনো যন্ত্র ছাড়াই সুঁই-সুতায় নিপুণ হাতের কারুকাজে রঙ-বেরঙের পোশাকে বাহারি নকশা তোলায় তাদের দক্ষতার সুনাম ছিল জগত জুড়ে।
বিশেষ করে কারচুপি ও জারদৌসি কাজে রয়েছে, বিশেষ খ্যাতি। তবে হাতে তৈরি এ শিল্পটি এখন ভেঙে পড়েছে প্রায়! দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বিদেশি পোশাকের আমদানি ও সরকারি বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারিগর ও মালিক এই পেশা ছেড়েছেন। আবার অনেকেই শত বছরের পুরোনো এই শিল্পকে নানাভাবে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
কারিগররা জানিয়েছেন, জরি, সুতা, পুঁতি, চুমকি, পাথর দিয়ে মূলত বিভিন্ন পোশাকে নকশায় কারচুপি ও জারদৌসি কাজ হয়ে থাকে। এখানকার বাহারি নকশার পোশাক চলে যেতো চট্টগ্রামের বিভিন্ন শপিংমলে।
তবে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডিজাইনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিদেশি কাপড়ের আধিপত্য বাড়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প। গত কয়েক বছরে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আবার অনেকেই কারখানা ছোট করে কোনোরকমে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের দাবি, সরকারি বিনিয়োগ পেলে এই শিল্প থেকে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন সম্ভব।
বিহারিপল্লীর কয়েকটি কারখানায় এখনও হাতেগোনা কারচুপি-জারদৌসি কারিগরের দেখা পাওয়া যায়। তবে নেই আধুনিকতার ছোঁয়া! ঝাউতলার এই বিহারিপল্লীর একটি গলির ভেতর ঢুকে সামান্য হাঁটলে দোতলাবিশিষ্ট একটি কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়।
সেখানে কথা হয়, পাপ্পু বুটিকস হাউজের মোহাম্মদ আসিফ নামের একজন কারিগরের সঙ্গে।
তিনি বলেন, এখানে পাঞ্জাবি, কামিজ, থ্রি-পিস, শাড়ি, আবায়া ও বোরকাসহ বিভিন্ন পোশাকে ডিজাইন তৈরি করে দেওয়া হয়। কারচুপি ও জারদৌসি এ দুটো সম্পূর্ণই হাতের কাজ, যা মেশিন দিয়ে কখনোই সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, এ কাজগুলো কাঠের ফ্রেমে নকশা আঁকা কাপড় রেখে পাথর ও বিভিন্ন সুতা দিয়ে করা হয়। সাধারণত, মোগল স্থাপত্যরীতির একটা ছাপ স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে এতে। মোগল আমলের মিনার-কলকি জারদৌসি কাজের মূল বৈশিষ্ট্য। সিল্ক, মসলিন, জর্জেট ও ভেলভেটের কাপড়ে জারদৌসি পূর্ণরূপে ফুটে ওঠে। জরি, সুতা, পুঁতি, চুমকি, পাথর ইত্যাদি কারচুপি ও জারদৌসির মূল কাঁচামাল। মূলত ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এসবের দাম এখন অনেক বেড়ে গেছে।
আড়ি, রেশম, চুমকি, জরির সংমিশ্রণে জারদৌসির কাজে মোগল মোটিফ তুলে ধরা হয় বলে জানিয়ে মোহাম্মদ আসিফ বলেন, পোশাকে উৎসব এবং আভিজাত্য, এই দুইয়ের প্রতীক হিসেবে ধরা হয় ‘জারদৌসি’কে। নকশা করার সময় এর সঙ্গে আরো যুক্ত হয় মুক্তা, মিনা আর কুন্দন।
তিনি বলেন, নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে হাতের কৌশলের সমন্বয় করে একজন কারিগর সম্পন্ন করেন একেকটি জারদৌসির কাজ। তবে কারচুপির কাজটা একটু ভিন্ন। এখানে জারদৌসির চেয়ে পরিশ্রম কিছুটা কম। তবে এই দুটি নকশা যেন সহোদর! একটি ছাড়া আরেকটি নকশা সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না!
যেকোনো কাপড়েই জারদৌসি-কারচুপির কাজ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। সেজন্য চাই, মানানসই কাপড়। ওড়নার চারদিকে জরির পাড় বসাতে বসাতে একই পল্লীর কারিগর মোক্তার বললেন, পিওর সিল্ক, মসলিন, জর্জেট ও ভেলভেটের কাপড়ে জারদৌসি ফুটে ওঠে পূর্ণরূপে।
পাশাপাশি ওড়না ও সালোয়ারের দিকেও দিতে হয় বিশেষ নজর। কামিজের ছাঁটটা সোজা হলে এর সঙ্গে মানায় সোজা বা স্ট্রেইট কাটের একটু পা উঁচু সালোয়ার। হালকা ঢোলা কামিজের সঙ্গে ঘারারা সালোয়ারও মানাবে বেশি। এ ধরনের সালোয়ারের নিচে থাকতে পারে জারদৌসির নকশা। তবে সালোয়ার, কামিজের কাটছাঁট যেমনই হোক না কেন, ওড়নাটা একটু বড় হওয়া চাই। আর ওড়নার চারদিকে জরির পাড় বসিয়ে নিলে পুরো পোশাকটিই হয়ে ওঠে আভিজাত্যের প্রতীক।
পাপ্পু বুটিকস হাউজের মালিক মো. খালিদ জাফর পাপ্পু বলেন, ‘এই কাজটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ঢাকা আর উত্তরবঙ্গে হয়। আমি করছি, প্রায় ২৬ বছর ধরে। আমাদের কাজ কম-বেশি পুরো বছরই থাকে। তবে, ঈদে একটু চাপ বাড়ে। অর্ডার অনুযায়ী, মাসে ৩০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। দেশ ও দেশের বাইরে এ কাজের ব্যাপক চাহিদা। তবে, দেশে এ শিল্প এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারিগররাও চলে যাচ্ছেন অন্য কাজে। আগে এখানে প্রায় দু’শ কারখানা ছিল। কিন্তু এখন আছে মাত্র, ১০ থেকে ১৫টা। সরকার যদি আমাদের এই কাজটার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়, তাহলে আমরা কাজটাকে আরো ছড়িয়ে দিতে পারতাম’!
পাপ্পুর বড় মেয়ে ওয়ারলেস ঝাউতলা কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ে। পড়ালেখার পাশাপাশি সেও তার বাবার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কারচুপি-জারদৌসির কাজ করে। তার ইচ্ছে, ভবিষ্যতে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ে এই শিল্পটা নিয়ে কাজ করা।
ওয়ারলেস ঝাউতলা কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী বার্তা২৪.কমকে বলে, ‘আমার জারদৌসির কাজ করতে অনেক ভালো লাগে! পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে এ কাজটা আমি করি'।
বাংলাদেশের এই কাজ জগদ্বিখ্যাত! এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি সম্ভব। শুধু কারিগরের অভাব। ভবিষ্যতে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ালেখা করার ইচ্ছা আমার। কারণ, এ শিল্পটাকে আমি দেশ এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে চাই।
এটা এমন এক শিল্প, যেটি ঘরে বসেও মেয়েরা করতে পারবে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারবে, যার কারণে সরকারের উচিত মেয়েদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে এ শিল্পে বিনিয়োগ করা!’
ঝাউতলার একটি গলির ভেতর ঢুকে সামান্য হাঁটলে সেমিপাকা ভবনে একটি কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে কথা হয়, ঊর্দুভাষী মো. ইমরান হোসেনের সঙ্গে।
হারিয়ে যাচ্ছে বিহারি ঐতিহ্যের কারচুপি-জারদৌসি শিল্প (ভিডিও)
বার্তা২৪.কমকে ইমরান বলেন, ‘সবাই এ কাজটা ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের এখানে কাজের চাহিদা আগের চাইতে বেশি। কেবল কারিগরের সংখ্যা কম। আমাদের এ কারখানায় পাঁচ বছর আগেও প্রতিদিন ১০ জন কারিগর কাজ করতেন। কিন্তু এখন মাত্র দুইজন। কারিগর খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘শুধু এখানেই নয়, সব কারখানাতেই এখন কারিগর সংকট। কাজের অনেক চাহিদা, কিন্তু কারিগর না থাকার কারণে কাজ কম হচ্ছে। এ কাজে টাকা কম। তাই, কারিগররা এ কাজ ছাড়ছেন’।
ইমরান আরো বলেন, ‘আমাদের এ কাজটা নিয়ে সরকার যদি আগাতো, তাহলে অনেক ভালো হতো। এদিকে, বাংলাদেশে অনেক শিল্প বাড়তো। অনেক লাভবান হতো। কেননা, ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন আরব দেশগুলোতে এ কাজের প্রচুর চাহিদা। বিশেষ করে বোরকা ও আবায়ার চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু সবকিছুর দাম বাড়চ্ছে, যার কারণে লাভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এ কাজটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে’।