যে টিলায় ‘আগুন-পানি’র বন্ধুত্ব দেখতে ছুটে যান পর্যটকরা

  • মশাহিদ আলী,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম, সিলেট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

টিলার মধ্যে ছোট ছোট গর্তে প্রতিনিয়ত জ্বলতে দেখা যায় আগুন/ছবি: নূর এ আলম

টিলার মধ্যে ছোট ছোট গর্তে প্রতিনিয়ত জ্বলতে দেখা যায় আগুন/ছবি: নূর এ আলম

আগুন আর পানি চির শত্রু। আগুন ধরলে পানি ঢেলে দিলে তা নেভে যায়। কিন্তু পানির মধ্যে যখন আগুন ধরে তখন কিভাবে নেভাবেন? বিষয়টি শুনে অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য। দুই চির শত্রু এখানে মিত্রতে পরিণত হয়েছে। মাটি কিংবা বালু যেখানে চোখ যাবে সেখানে দেখা যায় আগুন। কখনো এপাশ কখনো বা অন্যপাশ। এক কিংবা দুই নয়, ৬৯ বছর ধরে জ্বলছে এই আগুন। গ্রামের রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি টিলা। সেই টিলার নাম হলো আগুন টিলা বা জ্বলা টিলা। স্থানীয়দের কাছে এটি জ্বলা টিলা হিসেবে পরিচিত।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট। সেই সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের উৎলারপার গ্রামে জ্বলা টিলার অবস্থান। সুউচ্চ টিলায় বছর পর বছর জ্বলছে আগুন। রোদ-বৃষ্টি কোনো কিছুতেই থেমে নেই আগুন। টিলার মধ্যে ছোট ছোট গর্তে প্রতিনিয়ত জ্বলতে দেখা যায় আগুন। এমন দৃশ্য দেখতে বিভিন্ন দিবসে ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা। ছুটে আসা পর্যটকরা টিলার গর্তের ফাটলে হাতে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দেন। আর তাতে জ্বলে উঠে আগুনের শিখা।

বিজ্ঞাপন

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের উৎলারপার গ্রামে আগুন টিলার অবস্থান/ছবি: নূর এ আলম


খালি চোখে উৎলার পাড় রহস্যময়। কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে মামুলি। বাংলাদেশে প্রথম গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায় হরিপুরে। এখানকার মাটি গ্যাসে পূর্ণ।

জানা যায়, ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পায় তৎকালীন পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল)। গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যে ওই বছরেই কূপ খননের কাজ শুরু করে তারা। কিন্তু গ্যাসের অতিরিক্ত উচ্চচাপের কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কারণে অনুসন্ধানে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও নির্মিত ভবন ভূগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ভূমিধসে ওই স্থানে পুকুরের মতো গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে এই গর্তের পানিতে সর্বদা বুদবুদ দেখা যায়। সেখানে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালেই পানিতে আগুন ধরে যায়। পুকুরের পাশে অবস্থিত একটি টিলাও পোড়ামাটির আকার ধারণ করে আছে।

বিজ্ঞাপন

৬৯ বছর ধরে টিলায় জ্বলছে আগুন/ছবি: নূর এ আলম


স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, উৎলার পার আর আহমদ আলী শাহ ইতিহাসকে এক সূত্রে গাঁথা। এলাকায় শাহ আহমদ আলী নামের একজন কামেল পীরের মাজার রয়েছে। তৎকালীন সময়ে গ্যাস কূপ খননের সময় তিনি নিষেধ করেন এবং অন্য স্থান থেকে গ্যাস উত্তোলন করার জন্য বলেন। নতুবা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। গ্যাস সংশ্লিষ্টরা তার কথা না শুনে কূপ খনন করায় সময় বিস্ফোরণ ঘটে। বিষ্ফোরণে খনন কাজে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও নির্মিত ভবন ভূগর্ভে চলে যায় এবং ভূমির মাটি উড়ে গিয়ে ও মাটি ধসে পুকুর আকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়। এই পুকুরের গভীরতা আজও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। বিস্ফোরণের পর বেশ কিছুদিন পুরো এলাকায় আগুন জ্বলতে থাকে। কোনোভাবেই সে আগুন নেভাতে না পেরে সেই কামেল পীরের দ্বারস্থ হয় গ্যাস কর্তৃপক্ষ। কামেল পীরের ‘ফু’ দোয়া বালু ছিটানো হলে না কি জ্বলন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে আর নিভে যায়। বিস্ফোরণের পর থেকে গর্তে বুদবুদ দেখা দেওয়ায় ওই গ্রামের নামকরণ করা হয় উৎলারপাড়। পানি থেকে গ্যাস উৎলে ওঠার কারণে এই নামকরণ করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

আগুন টিলা দেখতে বিভিন্ন দিবসে ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা/ছবি: নূর এ আলম


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উৎলারপার গ্রামে হরিপুর গ্যাস ফিল্ডের ৭ নং কূপ এরিয়ায় টিলা ও পুকুরে গ্যাস বের হচ্ছে । টিলার মধ্যে গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধ । পাশে দাঁড়ালে গায়ে অনুতপ্ত হবে গরম হাওয়া। দিনের বেলা গ্যাসে আগুন জ্বললেও খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু রাতের বেলায় আগুন দেখা যায়। টিলা সামনের দিকে কয়েক মিনিট পায়ে হাঁটলে পাওয়া যায় পুকুর। সেই পুকুরটিতে উৎলা উঠতে দেখা যায়। বুদ বুদকে স্থানীয়রা উৎলা বলে থাকেন। পানির বুদ বুদ শব্দ কেউ শুনলে মনে জুড়ে যায়। পানির মধ্যে বুদবুদ জমা হলে সেখানে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলে আগুন ধরে। টিলার এক পাশে রয়েছে বসতবাড়ি।ঝুঁকি নিয়ে টিলার পাদদেশে বসবাস করছে বেশ কয়েকটি পরিবার। টিলার গর্তে আগুনের দৃশ্য ও বুদবুদ ওঠা সেই পুকুরের পানিতেও আগুন জ্বালিয়ে আনন্দ উপভোগ করেন পর্যটকরা। তাই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুরতে আসেন পর্যটকরা।

রোদ-বৃষ্টি কোনো কিছুতেই থেমে নেই আগুন/ছবি: নূর এ আলম


যদিও গ্যাস কর্তৃপক্ষ- টিলা ও পুকুর এলাকায় আগুন ব্যবহার না করতে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখলেও পর্যটকরা এসবের তোয়াক্কা করছেন না।

স্থানীয় ‍যুবক আহমদ সাকিব বলেন, প্রচারণার অভাবে এখানে তুলনা মূলক পর্যটক কম আসেন।কিন্তু বিভিন্ন দিবসে সিলেটের জাফলং ও লালাখাল দেখতে আসা পর্যটকদের অনেকেই বিকেলে ঘুরতে আসেন।

হরিপুর গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ মো.রায়হান আহমদ বলেন, টিলার কিছু অংশ দিয়ে ফাটল দেখা যায়। সেই ফাটল দিয়ে গ্যাস নির্গমনের কারণে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলে আগুনের শিখা দেখা যায়। গ্যাস নির্গমনের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে না। তারপরও ঝুঁকি এড়াতে আগুন না জ্বালানোর জন্য সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে। তিনি আগত পর্যটকদের এ ব্যাপারে সর্তক হওয়ার আহ্বান জানান। এছাড়া এটি সংরক্ষিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।

টিলার পাশে পুকুরে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই তাতে জ্বলে উঠে আগুনের শিখা/ছবি: নূর এ আলম


যেভাবে যাবেন আগুন টিলায়-সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট বা ধোপাদীঘির পাড় থেকে পাওয়া বাস, অটোরিকশা ও লেগুনায় চড়ে যেতে সময় লাগে ৪০-৪৫ মিনিট। বাসে হরিপুর বাজারে যেতে জনপ্রতি ৩০ টাকা লাগবে আর সেখান থেকে অটোরিকশায় আরও ১০ টাকা খরচ করতে হবে। কেউ লেগুনায় গেলেও একই টাকা খরচ হবে। সিএনজি অটোরিশায় জনপ্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। রিজার্ভ নিলে ভাড়া পড়বে ৩০০-৩৫০ টাকা।