মুক্তিযুদ্ধে সত্যিকারের দূর্গ হয়ে উঠেছিল যে বাড়ি
চট্টগ্রাম থেকে মীরেরসরাইয়ের শান্ত নয়নাভিরাম এক জনপদ পশ্চিম আলিনগর। বর্তমানে যোগাযোগের প্রভূত উন্নতি হওয়ায় এক ঘন্টায় পৌছে যাওয়া যায়। কাছেই সুনির্মল স্রোতস্বিনী ফেনী নদী প্রবাহমান। গ্রামীণ জনপদ যে ঐশ্বর্য আর মোহময়তা নিয়ে আবহমানকাল ধরে আমাদের মুগ্ধ করে আসছে, অলিনগরও তার ব্যতিক্রম নয়।
সীমান্তগ্রাম হিসেবে এর বাড়তি গুরুত্ব ছিল দেশভাগের পর থেকেই। পৃথক রাজনৈতিক মানচিত্র থাকলেও ঐতিহাসিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক অভিন্নতার কারণে দুই প্রান্তের মানুষেরা ফেনী নদী পেরিয়ে পরস্পরের কাছে আসতেন সৌহার্দ্য বিনিময় করতে। গোত্র-সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে অধুনা পূর্ববঙ্গে সম্প্রীতি তখনও বিরাজমান আলিনগরে।
প্রীতির বন্ধনে জড়ানো মানুষদের এই গ্রামে একাত্তর এক নতুন বীভিষিকা হয়ে আসে, যেমন এসেছিল দেশের অন্যান্য জনপদেও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলো।’ বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান পৌছেছিল অলিনগর গ্রামেও। এই গ্রামের একটি বাড়ি সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের এক দুর্জয় দূর্গ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এ বাড়িটিতেই নিরাপদে আশ্রয় নেন মুক্তিযোদ্ধা সহ অন্যান্য মানুষেরা।
অকাল প্রয়াত খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহমদ মমতাজের পৈত্রিক বাড়িটিই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দূর্জয় ঘাঁটি। যুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বরতার মাঝে দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষদের কাছে এই বাড়ি ছিল নির্ভরতার জায়গা। যেখানে এক হাড়িতে রান্না হতো হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য। যাদের অসুবিধা হতো তাদের জন্যও ছিল পৃথক ব্যবস্থাও।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রামগড় হয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীরা এই বাড়িটিতে ঠাঁই পেতেন। বাড়িতে বসতঘর ছাড়াও বড় কাচারিঘর, ঢেকিঘর সহ বেশ কয়েকটি ঘর ছিল, যা সব অবারিত থাকতো আগত আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য। আশ্রয়প্রার্থী বেড়ে যাওয়ায় অগত্যা গোয়াল ঘরে মাটি ফেলে বসবাসের উপযোগী করে দিতেও কুণ্ঠিত ছিলেন না আহমদ মমতাজের বাবা আবদুল বারিক সওদাগর।
আশ্রয়প্রার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা কার্যে বাবার সার্বক্ষণিক পাশে থাকতেন পুত্র আহমদ মমতাজ। তাঁর মমতাময়ী মা আমেনা খাতুনকেও কম ধকল নিতে হয়নি এর জন্য।
আহমদ মমতাজের সহধর্মিনী লেখক-গবেষক রাইয়ান নাসরিন বলেন, ‘মমতাজের বাবা নৌকার ব্যবস্থা করে নিরাপদে আশ্রয়ে থাকা মানুষদেরকে নদীর ওপারে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার ব্যাবসায়ী হওয়ার সুবাধে ভারতেও অনেক ব্যবসায়ী বন্ধু ছিল। তাদের মাধ্যমে তিনি এপার থেকে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন।’
‘যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি আর্মি বাড়িটা দখল করে নেয়। নিজেদের শেল্টারের জন্য ঘরের সব তছনছ করে প্রতিটি ঘরে বাংকার তৈরি করে। যার কারণে বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া থেকে বেঁচে যায়’-বলেন রাইয়ান নাসরিন।
স্বামীর প্রয়াণের পর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য এই বাড়িটিকে আগলে রাখা রাইয়ান মমতাজ বলেন, ‘আহমদ মমতাজ সারা জীবন বাড়িটাকে অপরিবর্তিত রেখেছেন। বাড়িটা তাঁর পিতার হাতে নির্মিত। বাড়িটির বয়স প্রায় ৮০ বছর। যুদ্ধকালীন সময়ের এ ধরনের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি সারাদেশে অবিকৃত ভাবে খুব বেশি নেই। আহমদ মমতাজের নিজে হাতে সংরক্ষণ করে রাখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই অমূল্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বাড়িটিকে স্থায়ী ভাবে সংরক্ষণের ব্যাবস্থা করা প্রয়োজন।’ এই কর্মযজ্ঞে তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতাও কামনা করেন।
আহমদ মমতাজের এই বাড়ি ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের অকথিত ইতিহাসকে অমরত্ব দিতে একটি ট্রাস্ট গঠনের আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই প্রকৃত জনযুদ্ধ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধ কত মানুষের আত্মত্যাগে চূড়ান্ত বিজয়ে পৌছেছিল তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। আহমদ মমতাজের এই বাড়িটিকে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিবাহী স্থান হিসেবে একটি সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগারে রূপ দিতে চাই আমরা। এজন্য শিগগির আমরা একটি ট্রাস্ট গঠনের দিকেও যেতে চাই। যাতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং পরবর্তীতে আহমদ মমতাজের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাগুলো হারিয়ে না যায়।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালযের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনায় ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ ধরণের বাড়ি সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্মৃতি সংরক্ষণার্তে বাড়িটিকে ঘিরে একটা দারুন বসত মিউজিয়াম হতে পারে। যা ভবিষ্যত জেনারেশনকে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের সীমানায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আশ্রয়স্থলের প্রেক্ষাপটকে বুঝতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’