মুক্তিযুদ্ধে সত্যিকারের দূর্গ হয়ে উঠেছিল যে বাড়ি



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
আহমদ মমতাজের সেই পৈত্রিক বাড়ি যা মুক্তিযুদ্ধের শেল্টার সেন্টার হিসেবে রক্ষা করেছিল অগণিত মানুষকে

আহমদ মমতাজের সেই পৈত্রিক বাড়ি যা মুক্তিযুদ্ধের শেল্টার সেন্টার হিসেবে রক্ষা করেছিল অগণিত মানুষকে

  • Font increase
  • Font Decrease

চট্টগ্রাম থেকে মীরেরসরাইয়ের শান্ত নয়নাভিরাম এক জনপদ পশ্চিম আলিনগর। বর্তমানে যোগাযোগের প্রভূত উন্নতি হওয়ায় এক ঘন্টায় পৌছে যাওয়া যায়। কাছেই সুনির্মল স্রোতস্বিনী ফেনী নদী প্রবাহমান। গ্রামীণ জনপদ যে ঐশ্বর্য আর মোহময়তা নিয়ে আবহমানকাল ধরে আমাদের মুগ্ধ করে আসছে, অলিনগরও তার ব্যতিক্রম নয়।

সীমান্তগ্রাম হিসেবে এর বাড়তি গুরুত্ব ছিল দেশভাগের পর থেকেই। পৃথক রাজনৈতিক মানচিত্র থাকলেও ঐতিহাসিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক অভিন্নতার কারণে দুই প্রান্তের মানুষেরা ফেনী নদী পেরিয়ে পরস্পরের কাছে আসতেন সৌহার্দ্য বিনিময় করতে। গোত্র-সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে অধুনা পূর্ববঙ্গে সম্প্রীতি তখনও বিরাজমান আলিনগরে।

প্রীতির বন্ধনে জড়ানো মানুষদের এই গ্রামে একাত্তর এক নতুন বীভিষিকা হয়ে আসে, যেমন এসেছিল দেশের অন্যান্য জনপদেও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলো।’ বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান পৌছেছিল অলিনগর গ্রামেও। এই গ্রামের একটি বাড়ি সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের এক দুর্জয় দূর্গ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এ বাড়িটিতেই নিরাপদে আশ্রয় নেন মুক্তিযোদ্ধা সহ অন্যান্য মানুষেরা।

গবেষক রাইয়ান মমতাজ ঢাকা বাস করলেও প্রাণের টানে প্রায়ই ফিরে যান স্বামীর বাড়িতে। সেখানে স্থানীয়দের তিনি শোনান মুক্তিযুদ্ধের গল্প

অকাল প্রয়াত খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহমদ মমতাজের পৈত্রিক বাড়িটিই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দূর্জয় ঘাঁটি। যুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বরতার মাঝে দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষদের কাছে এই বাড়ি ছিল নির্ভরতার জায়গা। যেখানে এক হাড়িতে রান্না হতো হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য। যাদের অসুবিধা হতো তাদের জন্যও ছিল পৃথক ব্যবস্থাও।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রামগড় হয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীরা এই বাড়িটিতে ঠাঁই পেতেন। বাড়িতে বসতঘর ছাড়াও বড় কাচারিঘর, ঢেকিঘর সহ বেশ কয়েকটি ঘর ছিল, যা সব অবারিত থাকতো আগত আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য। আশ্রয়প্রার্থী বেড়ে যাওয়ায় অগত্যা গোয়াল ঘরে মাটি ফেলে বসবাসের উপযোগী করে দিতেও কুণ্ঠিত ছিলেন না আহমদ মমতাজের বাবা আবদুল বারিক সওদাগর।

আশ্রয়প্রার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা কার্যে বাবার সার্বক্ষণিক পাশে থাকতেন পুত্র আহমদ মমতাজ। তাঁর মমতাময়ী মা আমেনা খাতুনকেও কম ধকল নিতে হয়নি এর জন্য।

ফেনী নদীর এই পথেই ওপারে ভারতে আশ্রয় নিতো শরণার্থীরা

আহমদ মমতাজের সহধর্মিনী লেখক-গবেষক রাইয়ান নাসরিন বলেন, ‘মমতাজের বাবা নৌকার ব্যবস্থা করে নিরাপদে আশ্রয়ে থাকা মানুষদেরকে নদীর ওপারে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার ব্যাবসায়ী হওয়ার সুবাধে ভারতেও অনেক ব্যবসায়ী বন্ধু ছিল। তাদের মাধ্যমে তিনি এপার থেকে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন।’

‘যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি আর্মি বাড়িটা দখল করে নেয়। নিজেদের শেল্টারের জন্য ঘরের সব তছনছ করে প্রতিটি ঘরে বাংকার তৈরি করে। যার কারণে বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া থেকে বেঁচে যায়’-বলেন রাইয়ান নাসরিন।

স্বামীর প্রয়াণের পর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য এই বাড়িটিকে আগলে রাখা রাইয়ান মমতাজ বলেন, ‘আহমদ মমতাজ সারা জীবন বাড়িটাকে অপরিবর্তিত রেখেছেন। বাড়িটা তাঁর পিতার হাতে নির্মিত। বাড়িটির বয়স প্রায় ৮০ বছর। যুদ্ধকালীন সময়ের এ ধরনের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি সারাদেশে অবিকৃত ভাবে খুব বেশি নেই। আহমদ মমতাজের নিজে হাতে সংরক্ষণ করে রাখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই অমূল্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বাড়িটিকে স্থায়ী ভাবে সংরক্ষণের ব্যাবস্থা করা প্রয়োজন।’ এই কর্মযজ্ঞে তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতাও কামনা করেন।

আহমদ মমতাজের এই বাড়ি ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের অকথিত ইতিহাসকে অমরত্ব দিতে একটি ট্রাস্ট গঠনের আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই প্রকৃত জনযুদ্ধ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধ কত মানুষের আত্মত্যাগে চূড়ান্ত বিজয়ে পৌছেছিল তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। আহমদ মমতাজের এই বাড়িটিকে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিবাহী স্থান হিসেবে একটি সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগারে রূপ দিতে চাই আমরা। এজন্য শিগগির আমরা একটি ট্রাস্ট গঠনের দিকেও যেতে চাই। যাতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং পরবর্তীতে আহমদ মমতাজের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাগুলো হারিয়ে না যায়।’

রাইয়ান নাসরিনের আশা, বাড়িটিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা হিসবে গড়ে তোলা গেলে ইতিহাসচর্চার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে

এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালযের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনায় ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ ধরণের বাড়ি সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্মৃতি সংরক্ষণার্তে বাড়িটিকে ঘিরে একটা দারুন বসত মিউজিয়াম হতে পারে। যা ভবিষ্যত জেনারেশনকে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের সীমানায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আশ্রয়স্থলের প্রেক্ষাপটকে বুঝতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

   

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;

শিশু রায়হানের শ্রমেই মা-নানার মুখে দুমুঠো ভাত ওঠে!



শাহজাহান ইসলাম লেলিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নীলফামারী
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আমার বাবা মারা গেছেন দুই বছর আগে! আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাকে আর মাকে চাচারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমার নানা বৃদ্ধ মানুষ। নানী মারা গেছে। আমরা তার বাড়িতে থাকি।

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আর আমি স্কুল শেষে হাসপাতালে এসে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করি। আমার টাকা দিয়ে চাল কিনি। আমার মায়ের টাকা দিয়ে তরকারি কিনি, বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন কথা বলছিল পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রায়হান ইসলাম।

রায়হান ইসলাম নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের নিতাই ইউনিয়নের মৃত আবু বক্কর আলীর ছেলে ও স্থানীয় নিতাই ডাঙাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে রায়হানকে খেলনা ও বেলুন বিক্রি করতে দেখা যায়। এসময় হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনেরা তাদের সন্তানদের আবদার পূরণ করতে রায়হানের কাছ থেকে এসব খেলনা কিনছেন।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাস্তবতা যেন বুঝতে শিখেছে রায়হান। প্রচণ্ড দাবদাহে ও তাপপ্রবাহের মধ্যেও রোদে পুড়ে মায়ের আর বৃদ্ধ নানার মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে যেন রায়হানের চেষ্টার শেষ নেই।

খেলার বয়সে খেলনা আর বেলুন হাতে ছোটে বিক্রি করতে। মাঝে-মধ্যে কোনো ক্রেতা না থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলনা আর বেলুন বিক্রি করে রায়হান। খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে এই বয়সে ছুটতে হয় পথেঘাটে। দারিদ্র্য রায়হানকে ঠেলে দেয় কাঠফাঁটা রোদের জগতে।

খেলার বয়সে খেলনা বিক্রি করতে ছোটে অসুস্থ মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে, ছবি: বার্তা২৪.কম

রায়হান বলে, আমি পড়ালেখা করে বড় কিছু করে আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই! আমাদের খবর কেউ নেয় না। আমার মা অসুস্থ! মানুষের বাসায় বেশি কাজও করতে পারে না। আমি এগুলো বিক্রি করে রাতে বাজার নিয়ে যাই।

আমাদের কেউ সাহায্য করে না! আমি যে টাকা আয় করি, তা দিয়ে আমার মা আর নানার জন্য চাল, ডাল কিনি। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন জিনিসও কিনতে হয় এই টাকা দিয়ে। সব কিছু এই বিক্রির টাকা থেকেই কিনি!

এবিষয়ে নিতাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোত্তাকিমুর রহমান আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছিলাম। তবে বিষয়টা সেভাবে ভাবিনি! আগামীতে কোনো সুযোগ এলে আমি তাদের তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আশিক রেজা বলেন, খোঁজখবর নিয়ে তাকে যেভাবে সাহায্য করা যায়, আমরা সেটি করবো।

বিদায় নিয়ে আসার আগে রায়হান বলে, আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো। পরে সারাক্ষণ শুধু কানে বাজতেই থাকে- আমাদের নিজের একটা বাড়ি করবো। আমার মাকে নিয়ে সেখানে সুখে থাকবো! আমাদের নিজের…!

;

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

২৯ এপ্রিল: আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস



প্রমা কান্তা, ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’॥

কিংবা-
‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ
হে মহকাল প্রলয়–তাল ভোলো ভোলো।।
ছড়াক তব জটিল জটা
শিশু–শশীর কিরণ–ছটা
উমারে বুকে ধরিয়া সুখে দোলো দোলো’।।

রবিঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ছন্দ তোলা এ পংক্তি যেন মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য শিল্প। এ গানগুলো শুনলেই আনমনে আমরা নেচে উঠি।

নাচ বা নৃত্য আনন্দ প্রকাশের চেয়েও আরো বেশি কিছু; শুদ্ধ শিল্প চর্চার পরিশীলিত রূপ। নৃত্যের মুদ্রার শিল্পে মনের পর্দায় প্রকাশ পায় অব্যক্ত ভাব ও ভাষা। নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ এবং ভাষার বাহনও বটে। সেটির আরো শিল্পিতরূপ তুলে ধরে ক্ল্যাসিক ধারার নৃত্য। প্রণয়ীর কাছে প্রণয়িনীর কিংবা প্রণয়িনীর কাছে প্রণয়ীর আত্মনিবেদনের চিরায়ত ধারা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে নিবেদন নৃত্যের ভাষা। মনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নৃত্যের মুদ্রার ভাষায় ভেসে ওঠে।

নৃত্যের মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে উদযাপন করা হয়- আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী নিজের পছন্দের নৃত্যের মুদ্রার মাধ্যমে উদযাপনে মেতে ওঠেন বিভিন্ন দেশের নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্য বিনোদন ও আনন্দ প্রকাশের সবচেয়ে পরিশীলিত শিল্প মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে নিজের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জুয়েইরিয়াহ মৌলি (প্রোগ্রাম প্রোডাকশন- নৃত্য)।

মৌলি বলেন, নৃত্য শুধু বিনোদন বা পরিবেশনার বিষয় নয়। নৃত্যের তাত্ত্বিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্য নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। পেশাগত জায়গা থেকে নৃত্য সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হোক!

তিনি বলেন, শুদ্ধ নৃত্য চর্চার মাধ্যমে শিল্পীরা নিজের এবং সমাজের কথা তুলে ধরুক। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা!

ধ্রুপদী নৃত্য, ছবি- সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকেই তাল ও ছন্দের অস্তিত্ব রয়েছে প্রকৃতিতেও। আকাশে মেঘের আন্দোলন, বাতাসে দুলে ওঠা গাছের পাতা, দল বেঁধে পাখিদের উড়ে চলা, ফুলে মৌমাছির মধু বা প্রজাপতির গরল আহরণ, পানিতে মাছেদের ছলছল চলা, এমনকী বৃষ্টির আগমনে ময়ূরের পেখম তুলে দুলে ওঠা, সবাই যেন ছন্দে নেচে মেতে ওঠে আনন্দে।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদযাপনের বিষয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে- ফরাসি নৃত্যশিল্পী তথা আধুনিক ব্যালের রূপকার জ্যাঁ-জর্জেস নভেরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনেস্কোর 'পারফর্মিং আর্টস'-এর প্রধান সহযোগী আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নৃত্য কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল এই দিনটি উদযাপন করা হয়।

আইটিআই ও ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কমিটি ১৯৮২ সালে প্রথমবার ‘আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস’ উদযাপন শুরু করে।

;

এক ঘরেই তিন বলী



তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

দুই ছেলের সঙ্গে খাজা আহমদ বলী/ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

  • Font increase
  • Font Decrease

চুল থেকে দাড়ি-সবই সফেদ। হাঁটাচলায় মন্থর। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় প্রথম দেখাতেই। কিন্তু তার ষাটোর্ধ্ব বয়সটা যেন কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। বয়স যতই ছোবল বসানোর চেষ্টা করুক না কেন-তিনি যেন এখনো ২৫ এর টগবগে তরুণ। সেই বলেই তো ফুসফুসের রোগবালাইকে তুড়ি মেরে ঐতিহাসিক আবদুল জব্বারের বলীখেলা এলেই হাজির হয়ে যান রিংয়ে। এক দুবার নয়, এবার কিনা পূর্ণ হলো সুবর্ণজয়ন্তী!

চট্টগ্রামের অন্যতম আবেগের ঠিকানা ঐতিহাসিক এই বলীখেলার বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা এই বলীর নাম খাজা আহমদ বলী। ৫০ বছর ধরে বলীখেলায় অংশ নিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া এই বলীর এখন পড়ন্ত বয়স। ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে রোগ। কানেও শোনেন কম। খাজা আহমদ বুঝে গিয়েছেন, তার দিন ফুরাচ্ছে। কিন্তু তিনি যে বলীখেলার স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যেতে চান না। সেজন্যই উত্তরসূরী হিসেবে এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন নিজের দুই ছেলেকে। বাবার পাশাপাশি দুই ভাইও এখন বলীখেলার নিয়মিত প্রতিযোগী।

খাজা আহমেদ বলীর বাবাও বলীখেলায় অংশ নিতেন। বাবার সঙ্গে বলীখেলায় এসে ১৯৭৪ সালে শখের বসে খেলতে নামেন খাজা আহমেদও। বয়স তখন ১২ বছরের আশপাশে। সেই শুরু, আর কোনোদিন মিস করেননি বলীখেলায় অংশ নেওয়া। একবার চ্যাম্পিয়নের গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বহু বছর ধরে খাজা আহমেদ বলী ও সত্তরোর্ধ্ব মফিজুর রহমানের ‘বলীযুদ্ধ’ জব্বারের বলীখেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই দ্বৈরথ হয়তো আর দেখা যাবে না। দুই বছর আগে উৎপত্তি হওয়া ফুসফুসের রোগটা ইদানিং যে খাজা আহমদকে বেশিই ভোগাচ্ছে। সেজন্য গতবছর অবসরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার দুই ছেলেকে নিয়ে বলীখেলায় এসে আবেগ সামলাতে পারেননি খাজা আহমেদ। ছেলেদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রিংয়ে। সেজন্য আরও একবার মফিজুর রহমান-খাজা আহমেদের লড়াই দেখল হাজারো দর্শক। যদিওবা যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করে দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়েছেন রেফারি।

প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমানের সঙ্গে বলী-যুদ্ধে খাজা আহমদ

কেন অবসর ভাঙলেন এমন প্রশ্নে হাসি খেলা করে যায় খাজা আহমেদ বলীর মুখে। বলতে থাকেন, ‘বয়সের কারণে শরীর দস্ত। ফুসফুসও ঠিকঠাক কাজ করছে না। সেজন্য অবসর নিয়েছিলাম। কিন্তু বলীখেলায় আসার পর দেখলাম দর্শকেরা সবাই অনুরোধ করছেন। সেজন্য মন বলল, না খেললে দর্শকদের প্রতি অন্যায় হবে। আর আবেগ ও ভালোবাসার কাছে বয়স-রোগ পেরেছে কবে?’

তবে এখানেই সব শেষ, বলে দিয়েছেন খাজা আহমেদ বলী। বলেছেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। মনে হয় না আর খেলতে পারব। অসুখটা বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেজন্য মনে মনে মেনে নিয়েছি এটাই আমার শেষ অংশগ্রহণ। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’

তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা খাজা আহমদের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়। কৃষিকাজ করেই চলে সংসার। তবে বলীখেলা এলে সব কাজ বাধ। কয়েকদিন ধরে চলে প্রস্তুতি। নিজের স্মৃতি ধরে রাখতে এরই মধ্যে খাজা আহমেদ নিজের দুই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন বলী হিসেবে। ২০১২ সাল থেকে বলীখেলায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তার বড় ছেলে মো. সেলিম। গত বছর থেকে যোগ দিয়েছেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। এখন বলীখেলার আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে খাজা আহমদের প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমরা বলীখেলা শিখেছি। বয়সের কারণে বাবা এখন অসুস্থ। হয়তো আর খেলা হবে না। সেজন্য তার উত্তরসূরী হিসেবে আমরা বলীখেলায় অংশ নেব সামনের দিনগুলোতে। এটা শুধু পরিবারের বলীর প্রজন্ম ধরে রাখার জন্য নয়, তরুণদের মাদক-সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগও।’

বাবাকে পাশে রেখে একই কথা বললেন ছোট ছেলে মো. কাইয়ুমও। বলেন, ‘হয়তো বাবা আর খেলবেন না। তবে তিনি না খেললেও যতদিন বেঁচে থাকবেন বলীখেলা দেখতে আসবেন। রিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়ে যাবেন।’

ছেলের কথা শুনে আবেগ খেলে যায় খাজা আহমেদ বলীর মনে। কাঁধের গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘না খেললেও যতদিন বাঁচি এখানে, এই বলীর মাঠ লালদীঘি ময়দানে ছুটে আসব। এটা থেকে দূরে থাকতে পারব না।’

খাজা আহমেদ যখন কথা বলছিলেন দূরে কোথাও তখন মাইকে বাজছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অক্লান্ত গলায় গেয়ে চলেছেন, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...

;