তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর প্রচেষ্টায় বদলে গেল আতর আলীর জীবন
আতর আলী মুন্সি। তিনি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। একসময় ইমামতি করেই তার সংসার চলতো। এখন তিনি ১১০ বছরে পা দিয়েছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ায় ইমামতি পেশা থেকেও বাদ পড়েছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি মোক্তব খুলে কয়েক বছর শিশুদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। এই কাজটিও বেশিদিন টিকেনি। একপর্যায়ে তিনি ভিক্ষার পথ বেছে নেন।
গত ৩ বছর ধরে ভিক্ষা করে সংসারের ঘানি টানছেন তিনি। লক্ষ্মীপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক তরুণ সদস্যের প্রচেষ্টায় ভিক্ষাবৃত্তি থেকে আবারো শিশুদের কোরআন শিখানোর কাজে ফিরলেন আতর আলী।
সম্প্রতি নোয়াখালীর চৌমুহনীর পাবলিক হলের সামনে একটি গেঞ্জি গায়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় আতর আলীকে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রামগতি-কমলনগর অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ সুমনের সঙ্গে দেখা মিলে বৃদ্ধ আতর আলীর। এসময় জানতে চাইলে আতর আলী তার জীবনের গল্পটি মাসুদকে জানান।
ঘটনাটি জানার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মাসুদ তার ব্যক্তিগত আইডিতে আতর আলীকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস নেন। এতে আতর আলীর জীবনের গল্পের কিছু অংশ তুলে ধরে সহযোগিতা চাওয়া হয়। তার এ স্ট্যাটাসে ব্যাপক সাড়া মেলে। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে আতর আলীকে একটি টিনসেট ঘর ও ৫০ কপি কোরআন শরীফ কিনে দেওয়া হয়। ওই ঘরে তিনি এখন শিশুদেরকে কোরআন শিক্ষা দিয়ে আসছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আতর আলী মুন্সি নোয়াখালী সদর উপজেলার আন্ডার চর গ্রামের বাসিন্দা। এ গ্রামটি লক্ষ্মীপুর রামগতি উপজেলার বর্ডার এলাকার পাশে। তার ১ ছেলে ও ৫ মেয়ে। ছেলেটি ওই গ্রামে চা দোকানের ব্যবসা করছেন। তার উপার্জন দিয়ে নিজেই চলতে কষ্ট হয়। ৫ মেয়ের ৪ জনকেই বিয়ে দিয়েছেন। এরমধ্যে বড় মেয়ে বিধবা। এখন কুঁড়ে ঘরটিতে স্ত্রী, ছোট ও বিধবা মেয়েকে নিয়ে আতর আলীর দিনযাপন করছেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে আতর আলী বিভিন্ন মসজিদে ইমামতির কাজ করেছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ায় ইমামতির পেশা থেকে তাকে সরে যেতে হয়। পরে নিজের বাড়িতে একটি ঘর করে শিশু-কিশোরদের কোরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য মক্তব খোলেন তিনি। সেখানে গ্রামের ৫০-৬০ জন শিশু-কিশোর কোরআন শিখতেন। প্রতি শিক্ষার্থী থেকে মাসে ২০ টাকা করে পেতেন তিনি। এতে তার সংসার খরচ মোটামুটি চলতো।
একসময় মক্তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়। কারণটি ছিল সকল শিক্ষার্থীকে কোরআন শরীফ দেওয়া যেত না। টাকার অভাবে শিক্ষার্থীদের কোরআন শরীফ দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় আতর আলীর সেই মক্তবটি। পরবর্তীতে সংসার চালাতে গিয়ে তাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয়। নিজ ও স্ত্রী-মেয়েদের জন্য দু-মুঠো খাবার যোগাতে তাকে মানুষের ধারে ধারে গিয়ে হাত পাততে হয়েছে।
এজন্য এ বৃদ্ধ বয়সে তাকে গ্রাম থেকে মফস্বল শহরের পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে ভিক্ষা করেই তাকে সংসার চালাতে হয়েছে।
সম্প্রতি নোয়াখালীর চৌমুহনী পাবলিক হলের সামনে একটি গেঞ্জি গায়ে আতর আলী ভিক্ষা চাইতে গিয়ে লক্ষ্মীপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য মাসুদ সুমনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মাসুদ সুমন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিকেল লিমিটেডের চৌমুহনী শাখার এরিয়া ম্যানেজার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রামগতি-কমলনগর অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক। এসময় তিনি আতর আলীর জীবনের গল্প শুনেন।
একপর্যায়ে আতর আলী জানান, মক্তবটা পুনরায় চালু করতে পারলে তিনি আর ভিক্ষাবৃত্তি করবেন না। যার জন্য একটি ঘর আর কয়েকটি কোরআন শরীফের প্রয়োজন।
তাকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফেরাতে মাসুদ ফেসবুকে সহযোগিতা চেয়ে স্ট্যাটাস দেন। তার স্ট্যাটাসে সাড়া দিয়ে আতর আলীর জন্য মানুষ আর্থিক সহযোগিতা করেন। সেই অর্থ দিয়ে আতর আলীকের মক্তবের জন্য একটি টিনের ঘর করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আতর আলীর হাতে মক্তবের জন্য ৫০ কপি কোরআন শরীফ তুলে দেওয়া হয়েছে।
আতর আলী মুন্সি বলেন, মাসুদ ভাইয়ের প্রচেষ্টায় আমার মক্তবটি আবার চালু হয়েছে। ১৫০ জন শিশু কিশোর এখানে কোরআন শিখছে। এতে আমার সংসার এখন ভালোভাবেই চলছে।
জানতে চাইলে মাসুদ সুমন বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত। মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। মানুষের উপকার করতে পারলে ভালো লাগে। আতর আলীকে দেখার পর তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানি। পুনরায় আতর আলীকে কাজে ফেরানোর চেষ্টায় সফল হতে পেরে বেশ আনন্দিত।