শিশু বয়সেই থমকে যাচ্ছে বাংলাচর্চা!
শুরু হওয়ার কথা শিশুকালে, যখন শিক্ষার ভিত্তি হয় মজবুত। কিন্তু তেমনটি এখন আর হচ্ছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিশুকালেই থমকে যাচ্ছে বাংলাচর্চা।
একদা ধ্রুপদী বা ক্লাসিক বইপত্র পড়ে বাংলাদেশের শিশুরা বড় হতো। বাংলা ভাষার প্রধান লেখকদের কালজয়ী মৌলিক গ্রন্থাবলির সাহায্যে যে শিশু ভাষা শিখেছে, সে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই অনেকগুলো অসাধারণ বই পড়ে ফেলতে পেরেছে। তার ভাষার ভিত্তিটি এভাবে মজবুত হয়েছে। জ্ঞানের দিগন্তও হয়েছে প্রসারিত। সেদিন এখন আর নেই।
এখন সেই শিক্ষাধারা চরমভাবে বিনষ্ট হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রী দূরে থাকুক, অভিভাবক ও শিক্ষকরাও মৌলিক মূল বইয়ের ধারে-কাছে দিয়ে যাচ্ছেন না। বাংলাদেশের এমন স্কুল-কলেজও আছে, যেখানে বাংলা বই বিমাতামূলভ আচরণের শিকার। যেন বা বাংলা বই না পড়লেও চলে!
স্বয়ং আমাকেই একবার এক মারাত্মক কথা শুনতে হয়েছিল। ‘স্কুলে কেন বেঙ্গলিটা শেখায় না ইংলিশে?’ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম কথাটা কানে আসতেই। বাচ্চা একটি মেয়ে বলছিল কথাটি। উত্তর ঢাকার অভিজাত এলাকার এক বাসায় পারিবারিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে আলাপে আলাপে গৃহকর্তার কন্যাটির পড়াশোনার খোঁজ নিচ্ছিলাম। তখনই কথায় কথায় মেয়েটি জানায়, ‘স্কুলে কেন বেঙ্গলিটা শেখায় না ইংলিশে?’
রাইম সে ভালোই জানে। ইংরেজি অনেক ছড়া শোনালো। ইংলিশ ভোকাবলারিও বেশ। এই বয়সেই অনেক শব্দ শিখেছে। বাংলা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। স্কুলে নাকি বাংলায় কথা বলাও বারণ! বাংলা বই পড়া দূরস্ত!!
বাচ্চাটি পড়ে বেশ নামী-দামী একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ভর্তি হওয়াই যেখানে সহজ নয়। ভর্তি হলেও বেতন, ফিস ইত্যাদির বড় রকমের চাপ আছে। অভিভাবক এমন স্কুলে সন্তানদের পাঠিয়ে শুধু নিশ্চিন্তই নন, বেশ আনন্দিতও থাকেন। তার সন্তান ‘অমুক’ স্কুলে পড়ে, এটা নাকি আজকাল স্ট্যাটাস সিম্বল, আত্মতৃপ্তি ও শ্লাঘার বিষয়। সরকারি স্কুল না পড়ানোটাই এখন নাকি আভিজাত্যের দস্তুর। পড়াশোনা, নৈতিকতা, ভাষাজ্ঞান কতটুক হয়, সে খবরও উন্নাসিক অভিভাবক নেন না।
আসলেই সেসব ভারি সাইনবোর্ড ও নামডাকওয়ালা বাক্যবাগিশ স্কুলগুলোতে আদৌ পড়াশোনা বলতে কি হচ্ছে, সে খোঁজ-খবর অভিভাবকদের অনেকেই রাখেন না। অভিভাবক টাকার জোরে কয়েকজন প্রাইভেট টিউটর রেখে দেন। সন্তান যে ভালো করে বাংলা বলতে বা পড়তে পারছে না, সে ব্যাপারে তারা নির্বিকার। বরং ছেলেমেয়ে পট পট করে ইংরেজি বলতে পারছে শুনেই তারা খুশিতে আটখানা!
আসলে শিক্ষার মূল ভিত্তিটাই যে প্রাথমিক স্তরে গড়ে ওঠে, সে ধারণা অনেকেরই নেই। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা একটি সমস্যা সম্পর্কে ভালোই জানেন। তা হলো, বাংলা মাধ্যমের ছাত্ররা ইংরেজিতে ভয়ানক দুর্বল। আর ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা বাংলায় কাঁচা। বাংলাদেশের দুই ধারার স্কুলিং-এ রয়েছে বিস্তর অসম্পূর্ণতা। এই ধরনের অসম্পূর্ণ শিক্ষায় যেসব ছেলেমেয়ে বছরের পর বছর পাস করছে, দেখা যাচ্ছে তারা ভাষাগত দুর্বলতা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে শিখতে তো অন্য দিকে দুর্বল হচ্ছে।
প্রাথমিক স্তরের দুর্বলতার কারণে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পযায়ের গড় ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষাগত সমস্যা প্রকটভাবে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে। যে কারণে কোনও কোনও পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষেই ভাষার কোর্স দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের তৈরি করার জন্য। কারণ, অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ভাষা জ্ঞান ক্রুটিযুক্ত। বানান, বাক্য গঠন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়েই তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকট আকারে দেখা যায়। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে একটু যত্ন নেওয়া হলে উচ্চশিক্ষা স্তরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা করে ভাষার কোর্স পড়ানোর দরকার হতো না।
অতএব ভাষাটা বাচ্চাদের শিখাতে হবে প্রাথমিক স্তর থেকেই। অন্যান্য ভাষা বা বিষয়ের মতো বাংলাতেও যেন ছেলেমেয়েরা ভালো করে, সে দিকে নজর দিতে হবে। এই তদারকির কাজটি ইংলিশ মিডিয়ামে বেশি করে করা দরকার। সব কিছু ইংরেজিতে শেখাতে গিয়ে মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রে অবহেলা করাটা মোটেও সমীচিন নয়। বাংলা মুখের ভাষা বলে এমনি এমনি শিখে যাবে মনে করাটাও ভ্রান্ত চিন্তা। কেননা, মান সম্মত ও প্রমিত ভাষা শিক্ষা ছাড়া আপনিতেই আহরণ করা যায় না।
যেসব শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, তাদেরকে মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্তত নিজ সংস্কৃতির শিকড়টুকু চিনিয়ে দেওয়ার জন্য স্কুলে বাংলার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া খুবই দরকার। স্কুলে নানা রকমের পরিবেশ, নানা সংস্কৃতি এবং নানা অঞ্চল থেকে ছাত্র-ছাত্রী আসে। সেইসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা বা সংস্কৃতিগত প্রভাব তাদের মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক। স্কুলের কাজ হলো সর্বজনীন ও আর্দশ স্থানীয় একটি ভাষা কাঠামোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা, যাতে বাংলা বা ইংরেজি, যে ভাষাতেই হোক, সে যেন মনের ভাব বা বিষয়গত জ্ঞান প্রকাশ করতে পারে নির্দ্বিধায় ও সাবলীলভাবে। একপেশে, মানহীন বা একভাষিক শিক্ষার্থী তৈরি করা কখনও স্কুলের কাজ হতে পারে না।
অতএব, স্কুলটি বাংলা মাধ্যমের না ইংলিশ মিডিয়ামের, সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো অন্যান্য কৃতিত্বের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলটি তার শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় যথেষ্ট পারদর্শি ও পারঙ্গম করতে পারছে কিনা, সেটাই। শিশুকালেই যদি মাতৃভাষা শিক্ষার কাজটি পরিবার এবং স্কুল না করতে পারে, তাহলে সারা জীবনের জন্য শিক্ষার্থীটিকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়ার নামান্তর হবে। এ কারণে শিশুকাল থেকেই পরিবারে ও বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার চর্চা গতিশীল রাখতে হবে। শিশু বয়সেই মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে গড়ে দিতে হবে নিবিড় সম্পর্ক।