স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে পারব, প্রাণ নিতেও মায়া হবে না
“স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে পারব, প্রাণ নিতেও মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারব না”—এই উক্তিটি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মরণীয় নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের।
আমরা জাতি হিসেবে আজ স্বাধীন। কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। অনেক চড়াই-উৎড়াই পার করে আজ আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে দেশভাগের আগ অবধি দীর্ঘ ২০০ বছর আমরা ব্রিটিশদের শাসনাধীন ছিলাম। তখন ভারতবর্ষকে ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছেন অসংখ্য তরুণ-যুবক। বহু স্বাধীনতাকামী ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য নির্ভীক চিত্তে অত্যন্ত আনন্দের সাথে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
তেমনই এক স্বাধীনতাকামী অগ্নিকন্যার নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
আমাদের রাণী
আসকার খানের দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে নেমে গেছে সরু একটা গলি। সেই গলি ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলেই শহর ছাড়িয়ে গ্রামে প্রবেশ। এরই শেষ মাথায় মিউনিসিপ্যালিটির বড় নালার উত্তরে একটা মাটির দোতলা বাড়িতে মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদারের পরিবারের বসতি। বড্ড অভাবের সংসার তার।
এরই মধ্যে ১৯১১ সালের মে মাসের ৫ তারিখে জগদ্বন্ধুর স্ত্রী প্রতিভাদেবী দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেন। সেই সন্তান এমনিতেই মেয়ে, তার ওপরে আবার গায়ের রঙ কালো। সকলে যখন এই কন্যাশিশুর গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলতে লাগল, তখন শুধু মা-ই পরম আদরে কাঁথায় জড়ানো ছোট্ট মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে নেন। ভালোবেসে চুমু খান কপালে। হাসিমুখে স্বামীকে বলেন, “দেখো! আমার এই কালো মেয়ে একদিন তোমাদের সবার মুখ আলো করবে।” আদর করে মা তার কন্যার নাম রাখেন রাণী।
কিন্তু কে জানত ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের কাহিনী শুনতে শুনতে পরবর্তীতে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামের এই শিশুকন্যাই হয়ে উঠবে বাংলার রাণী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার?
প্রীতিলতার বেড়ে ওঠা
ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের এক মেয়ে। যে ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে শুরু করে বাসন মাজার কাজে মাকে সাহায্য করতেন; ঠিক আর-দশটা বাঙালি কিশোরীর মতোই। তাঁর বেড়ে ওঠার মাঝে ছিল না কোনো আতিশয্য কিংবা আড়ম্বর। এদিকে প্রখর মেধার অধিকারী হওয়ায় অভাবের সংসারে শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাবা জগদ্বন্ধু তার এই অন্তর্মুখী কন্যাকে ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফল করে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রীতিলতা সব শিক্ষকের খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন, সেই শিক্ষকদের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি যিনি পরোক্ষভাবে হলেও সর্বপ্রথম প্রীতিলতার মধ্যে বিপ্লবী চেতনার বীজ বপন করে দেন। তিনি নিয়মিত প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন এবং পরে লক্ষ্মীবাঈয়ের ওপর লেখা বই পড়তেও দিয়েছিলেন; যা প্রীতিলতার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং তখন থেকেই তিনি নিজের অজান্তেই নিজেকে লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো অকুতোভয় বিপ্লবী হিসেবে কল্পনা করা শুরু করেন।
১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যেতে থাকা ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ঘটনায় পুরো চট্টগ্রাম শহর তখন উত্তাল, পুলিশের টহল, কড়া নজরদারি। ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় এবং মনে জন্ম নেয় অজস্র প্রশ্ন।
তবে সূর্যসেনরা ডাকাতির মামলা থেকে রাতারাতি খালাস পেয়ে যায়। বাধ সাধে ১৯২৪ সালের ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামের এক জরুরি আইন। এই আইনের আওতায় বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু হয়। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনাসমূহ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। একারণে তখন বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রীতিলতার খুড়তুতো দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারও তখন সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত মোড়কে মোড়া কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রেখে যান এবং বইগুলি লুকিয়ে রাখার জন্য বলে যান। প্রীতিলতা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। দাদার আদেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা বইগুলো লুকিয়ে রাখেন ঠিকই, কিন্তু ওগুলোতে কী আছে তা জানার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। অদম্য কৌতূহলের কারণেই একদিন মোড়ক খোলেন এবং লুকিয়ে গোগ্রাসে একে একে পড়ে ফেললেন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’-এর মতো নিষিদ্ধ সব বই।
বইগুলো পড়ে ভীষণভাবে আলোড়িত হন প্রীতিলতা। মূলত এগুলোই তাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। তখন তিনি পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার ইচ্ছের কথা বলেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বিপ্লবী দলে কোনো নারী সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিল। প্রীতিলতা দাদাকে বলেন, “এতকাল আগে থেকে মেয়েরা যদি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়তে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? তোমরা সবাই তো আমাকে রাণী বলে ডাকো। নাটোর আর ঝাঁসীর রাণী যা পেরেছিল, চাটগাঁর রাণীও নিশ্চয়ই তা পারবে।”
কিন্তু পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁর ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেননি। বরং বলেছিলেন, মেয়েরা যুদ্ধ করতে পারবে না, মেয়েরা বড়জোর বইপত্র লুকিয়ে রাখার মতো কাজে আড়াল থেকে স্বাধীনতাকামীদেরকে সহযোগিতা করে যাবে। কিন্তু প্রীতিলতা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না, কেন তার দ্বারা যুদ্ধ করা সম্ভব না?
প্রীতিলতার যুদ্ধপ্রস্তুতি
১৯২৮ সালে একাধিক বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং আইএ পড়ার জন্য ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধাতালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এই ফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু ১৯৩২ সালে বেথুন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় তার এবং তার সঙ্গী বীণা দাসগুপ্ত’র পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়।
এরমধ্যে ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন প্রকাশ্যে লাঠিখেলা, কুস্তি, ডনবৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধশিক্ষা ইত্যাদির জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব গড়ে তুলেছিল। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এখান থেকে বাছাই করে ভালো ছাত্র ও তরুণদেরকে তারা গোপনে বিপ্লবী দলের সদস্য করে নিত। ঢাকায় শ্রীসংঘের ‘দীপালী সংঘ’ নামে একটি মহিলা শাখাও ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের নেতৃত্বে নারীশিক্ষা বিস্তারে উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ছিল এই সংগঠনটির প্রকাশ্য কাজ। লীলা নাগের প্রচেষ্টায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি ইংরেজি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিতও হয়েছিল। কিন্তু, এগুলো ছিল বাইরের দিক। গোপনে তারা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ করত।
একদিন এই দীপালী সংঘের সদস্য, ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমাদির চোখ পড়ে প্রীতিলতার দিকে এবং তার মাধ্যমেই লীলা নাগের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়। তারা তখন দীপালী সংঘের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন প্রীতিলতার সাথে। পরে প্রীতিলতাকে সংঘের সদস্য হবার জন্য একটি ফর্ম দেন। তাদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সংঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন, “আইএ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।”
গরমের ছুটিতে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। বাড়ি ফিরেই পূর্ণেন্দুদাকে দীপালী সংঘের ফর্ম দেখান। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রীতিলতা বলেন, “দেখেছো! এখানে লেখা আছে, প্রয়োজন হইলে দেশের মুক্তি-সংগ্রামে আমার সর্বস্ব, জীবন পর্যন্ত আমি ত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি। এটি কিন্তু আমার খুব ভালো লেগেছে। অথচ তুমি আমাকে বলেছিলে আমরা মেয়েরা নাকি ওসব পারব না। এখন কী বলো তুমি?”
পূর্ণেন্দুদা তখন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি। গভীর মনোযোগ সহকারে ফর্মটি পড়ে পকেটে পুরে ফেলেন।
প্রীতিলতা ও মাস্টারদা
পূর্ণেন্দুদা মাস্টারদাকে প্রীতিলতার কাছে নিষিদ্ধ বই রাখা প্রসঙ্গে, বিপ্লবী দলে যোগ দেবার ব্যাপারে প্রীতির আগ্রহের কথা, সেই সাথে দীপালী সংঘে তাঁর যোগ দেবার আসন্ন সম্ভাবনার কথা খোলাখুলিভাবে জানান। সুদীর্ঘ আলোচনার পরে সূর্যসেন বলেন, “মেয়েদের সম্পূর্ণ বাদ দিয়েই এদেশে বিপ্লব হবে, একথা আমরা কোনোদিন ভাবিনি। তবে দেশে মুক্তির জন্য যে কঠিন শত্রুর সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে, সেখানে আছে রক্তপাত, অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষ, আরো অনেক কঠিন কাজ। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় মেয়েরা এইসব কাজে তোমাদের মতো করে যোগ দিতে এখনই পারবে না। পরে অবশ্যই পারবে। এখন থেকে আমাদের দলের ছেলেদের আপন বোন, মা ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের আমরা দলে নেব। কিন্তু তা করতে হবে সাবধানে ও ধীরে ধীরে।”
পূর্ণেন্দুদা জানতে চান, “তাহলে প্রীতিকে কী বলব? তাকে কি সদস্য হিসাবে গ্রহণ করবেন?”
মাস্টারদা বলেন, “আমার মনে হয়, বিপ্লবের সব কাজে মেয়েদের না নিতে পারলেও, অনেক বিশ্বস্ত ও গোপনীয় কাজের সাহায্যের জন্য তাদের আমরা নিতে পারি। প্রীতির কথা তোমার কাছে শুনে আমি স্থির করেছি যে, তাকে আমরা দলে নেব। তাকে আজ থেকে দলের সদস্য করা হলো। কিন্তু এই কথা তুমি, আমি ও সে, এই তিনজনের বাইরে কেউ যেন না জানতে পারে, এই আদেশ তোমার ওপর রইল, তাকে এ কথা বলে দিও।”
প্রীতিলতার কাছে এই সুখবর পৌঁছায় পরের দিন। পূজাঘরে গিয়ে অদেখা, অচেনা মাস্টারদাকে অন্তর থেকে প্রণাম করেন প্রীতিলতা।
প্রীতিলতার যুদ্ধযাত্রা
প্রীতিলতা যখন কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ছেন, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কল্পনা দত্তসহ চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের আরো কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে গড়ে তুললেন ‘প্রমীলা চক্র’। এই ‘প্রমীলা চক্র’ নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করে বিপ্লবীদের পাঠাত। আচমকা একদিন বিপ্লবী দলের কাছ থেকে গোপন এক নির্দেশ আসে প্রমীলা চক্রের কাছে। কলকাতার গোপন কারখানায় তৈরি বোমার খোল নিয়ে আসতে হবে চট্টগ্রামে। যেমন আদেশ, তেমন কাজ। এরপর থেকে যখনই সুযোগ হতো, মেয়েরা বোমার খোল গোপনে চট্টগ্রামে নিয়ে আসত। ১৯২৯ সালের পূজার ছুটিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বোমার খোল নিয়ে এসেছিল তারা। প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রক্ষিত; প্রত্যেকে চারটি করে মোট বিশটি।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এই আক্রমণগুলোতে প্রমীলা চক্রের আনা বোমাগুলোই ব্যবহৃত হয়েছিল। ইতিহাসে এটি ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবী দলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্র সমাজকে উদ্দীপ্ত করে।
১৯৩২ সালে বিএ পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে এসে দেখেন পিতার চাকরি নেই। সংসারের হাল ধরতে নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। বর্তমানে এটি অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে তিনি হয়ে যান পুরোধা একজন বিপ্লবী। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকের কোনো একদিন নির্মল সেন প্রীতিলতাকে “পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে” জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন, “টান আছে। কিন্তু ‘duty to family-কে duty to country’র কাছে বলি দিতে পারব।”
১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড়-বৃষ্টির দিনে মাস্টারদার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে তাদের গোপন আশ্রমে নিয়ে আসেন। বাড়িতে প্রীতিলতা তার মাকে সীতাকুণ্ড যাবার কথা বলেন। মাস্টারদা এবং নির্মল সেন ছাড়া ওই বাড়িতে আরো ছিলেন ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক আসামী তরুণ বিপ্লবী অপূর্ব সেন, যাঁর ডাকনাম ছিল ভোলা। কিন্তু সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোগীদের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পেরে যায় এবং ১৩ জুন ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ওই বাড়িতে ব্রিটিশ বাহিনী হানা দেয়। কিন্তু সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের করা গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরণ করে এবং সন্মুখ-সমনে নির্মল সেনও মৃত্যুবরণ করেন। প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাস্টারদা অন্ধকারে ঘরের বাইরে আসেন, কিন্তু গুলি লেগে অপূর্ব সেনও ঘটনাস্থলে মারা যান। তখন মাস্টারদা সূর্যসেন রাতের অন্ধকারে পুকুর ডোবা পেরিয়ে প্রীতিলতাকে সঙ্গে নিয়ে আরেক গোপন আস্তানায় পালিয়ে যান। পরের দিন মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
প্রীতিলতার আত্মাহুতি
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে বিপ্লবীরা আক্রমণ করতে গিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। কারণ, সেদিন ছিল গুড ফ্রাইডে। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড়ে ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা, ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ওই ক্লাবের ধারেকাছে যেতে পারত না। সেখানে লেখা ছিল, “কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।” সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা হাল ছাড়েননি, বরং নতুনভাবে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন।
১৯৩২-এর ১০ আগস্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন আবারও ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে পুনরায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতীজ্ঞা ছিল, ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থেকেও থাকে, তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। প্রতিজ্ঞানুযায়ী তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্র সৈকতে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।
এরপর মাস্টারদা ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফের ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এই আক্রমণের দায়িত্ব এবার তিনি নারী বিপ্লবীদের দেবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ে গেলেন। এবার আক্রমণের নেতৃত্বের ভার নিতে চাইল একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা। সদস্য সংখ্যা হলো ১৫ জন। ২৩ সেপ্টেম্বরের সে আক্রমণে দিন প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধূতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেওয়ার জন্যে মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা।
বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভেতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫-এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘনঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। যেন পাহাড়তলীতে কেঁপে উঠেছিল খোদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতা গুলিব্দিধ হন। কিন্তু সহযোদ্ধাদের সাথে আক্রমণ চালিয়ে যান। এরপর প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে দলের সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। কিন্তু আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন এবং যারা আহত হয়নি সেসব বিপ্লবীদের দ্রুত স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিপ্লবীরা সবাই স্থান ত্যাগ করেন।
প্রীতিকে সায়ানাইড ক্যাপসুল দেবার জন্য সবসময়ই অনুশোচনা করেছেন সূর্যসেন। কল্পনাকে পরে তিনি বলেছিলেন, “প্রীতি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিল দেশবাসীর কাছে শুধু এটাই প্রমাণ করার জন্য যে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে এবং জীবন দিতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, বেঁচে ফিরে আসলেই বরং সে আরো বেশি কিছু করতে পারত।”
প্রীতিলতার মৃত্যুর দিনটি ছিল ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে মাত্র ২১ বছর ৪ মাস ১৯ দিন বয়সে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন তিনি। আজকের এই দিনে বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধাভরে তাকে আমরা স্মরণ করছি।