একুশে: বাংলার, বাঙালির অস্তিত্বের প্রতীক

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবিঃ বার্তা২৪.কম

ছবিঃ বার্তা২৪.কম

বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার ও বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার, বাঙালির অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বিজয়ের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে এনেছে রাজনৈতিক অধিকারের চূড়ান্ত বিজয়। ভাষা শহিদ, ভাষা সংগ্রামীদের মহত্তম ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি একুশে ফেব্রুয়ারির মহান লগ্নে সমগ্র জাতি অনুভব করে বাংলার, বাঙালির হাজার বছরের গৌরবময় অতীত ও ঐতিহ্যের স্পর্শ আর ভবিষ্যতের অযুত সম্ভাবনার আলোড়ন।

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সেই ভাষার জনতা বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ পেতে প্রণোদিত করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম হলো বাঙালির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনেতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রামী পরম্পরা।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীতে শত শত ভাষা প্রচলিত থাকলেও সকল ভাষার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। ভাষার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্তও খুবই কম। পুরো ল্যাতিন আমেরিকার (একমাত্র ব্রাজিল গর্তুগিজ উপনিবেশ থাকায় পর্তুগিজ ভাষায় চলে) দেশগুলোর ভাষা হলো স্পেনিশ। ইউরোপের একটি ছোট্ট দেশ স্পেন মহাদেশটিতে দখল করে তাদের ভাষা, ধর্ম বদলে দিয়েছে। অথচ সেই ল্যাতিন আমেরিকাতেই ছিল মায়া সভ্যতা, অ্যাজটেক সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা। ছিল পেরুর কাচুয়া ভাষা। প্রায়-সকল দেশেরই মূল বাসিন্দাদের মূল ভাষাটির অস্তিত্ব আজ বিলীন। তারা শাসিত হচ্ছেন অন্যের ভাষা রপ্ত করে।

ব্রিটেন একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। কিন্তু বিশ্বের দেশে দেশে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের ইংরেজি ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডার আদিবাসী মানুষ ও তাদের ভাষাকে জাদুঘরে পাঠিয়ে সেখানে কর্তৃত্ব করছে ইংরেজি। ইংরেজি এখন বিশ্বের প্রধান ভাষাও।

ফ্রান্স নিজের চৌহদ্দী পেরিয়ে কানাডার অর্ধেক আর আফ্রিকা মহাদেশের বৃহদাংশে ফরাসি ভাষা চাপিয়ে দিয়েছে। কিছু কিছু দেশে চলছে ইতালীয় ভাষা।

পুরো উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে বহু নৃগোষ্ঠী ও তাদের সমৃদ্ধ ভাষা, অতীত ও ঐতিহ্য থাকলেও সেগুলো বিলীন হয়ে মাত্র তিনটি ভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরবি হয়েছে সেখানকার প্রধান ভাষা। ইরানের ফারসি ভাষা দখল করেছে দ্বিতীয় স্থান, যা নিজের সীমানা ছাড়িয়ে মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান পেরিয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ার পর্যন্ত চলে এসেছে। তৃতীয় হয়েছে তুর্কিদের ভাষা, যা তুরস্ক এবং সাবেক সোভিয়েত ও বর্তমান চীনা তুর্কিস্থানে প্রচলিত এবং সমৃদ্ধ কুর্দি ভাষা ও সংস্কৃতি তুর্কি আধিপত্যে প্রচণ্ডভাবে পর্যুদস্ত।

দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল তথা ভারত উপমহাদেশেও আর্য, শক, হুন, গ্রিক, আরব, পারসিক, মুঘল, পাঠান এবং একাধিক ইউরোপীয় শক্তি এসেছে। এখানেও বিভিন্ন ভাষার বিচিত্র উপস্থিতি থাকলেও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব করেছে যথাক্রমে সংস্কৃত এবং ফারসি। ইংরেজ আসার আগে পর্যন্ত ফারসি ভাষা শিখে হিন্দু-মুসলিমকে চাকরি পেতে হতো। তারপর ইংরেজি চললেও কার্যক্ষেত্রে পুরো উপমহাদেশের ভাষার নেতৃত্বে রয়েছে হিন্দি ও উর্দু ভাষা।

এর বাইরে আরও অনেক ঐতিহ্যময়, সমৃদ্ধ ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার উপস্থিতি থাকলেও বাংলা ছাড়া আর কেউই দ্বি-ভাষিক আধিপত্য ভেঙে স্বাধীন অস্তিত্বে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক কাঠামোতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি এই উপমহাদেশে। বাংলার উপর সংস্কৃত চাপতে চেয়েছিল। বাংলা ভাষায় আরবি বা ফারসি রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের চিরায়ত বাঙালিদের শাশ্বত বাংলা ভাষা অকৃত্রিম শুদ্ধতায় জাগ্রত রয়েছে। আদি ও মধ্যযুগের কবিগণ, সাধারণ মানুষ বাংলাকে প্রাত্যহিক জীবনে ও সাহিত্যে এমন অপরূপভাবে ব্যবহার করেছেন যে, বাংলা ভাষা জীবন্ত নদীর প্রাণাবেগে বেঁচে থেকেছে। এমনকি, বহিরাগত শাসকরা পযন্ত বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বকে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইতিহাসে আমরা এমন অনেক শাসকের দেখা পাই, যারা নামের শেষে বাঙালি টাইটেল লাগিয়েছেন। বাংলার স্বাধীন মুসলিম সুলতানগণ ছিলেন বাংলা ভাষার প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক, যাদের বদান্যতায় হিন্দু ধর্মীয় আখ্যাসমূহও বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছিল।

এমনই তেজি বাংলা ভাষার অধিকারী সংগ্রামী বাঙালি জাতি সুদূর উত্তর ভারতের ভাষা উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ঐতিহাসিকভাবেই মানতে পারেনি। যেমনভাবে বাঙালিরা দিল্লির শাসনকেও বার বার অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং স্বাধীন জীবন বেছে নিয়েছে।

ফলে বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কালো রাজপথের লাল রক্তে চিহ্নিত ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রাম বিছিন্ন কোনও ঘটনামাত্র নয়, বাংলার ঐতিহাসিক স্বাধীনচেতা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মনোভাবেরই জ্বলন্ত বহিঃপ্রকাশ। একই সঙ্গে একুশের সঙ্গে মিশে আছে ভবিষ্যতের প্রত্যাশা, যে প্রত্যাশা বাঙালিকে ভাষিক স্বাধীনতার পথে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে চলার সঙ্গীত হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে।

বাংলার, বাঙালির অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে একুশে সমগ্র জাতিসত্ত্বাকে আশাবাদের মশাল জ্বেলে পথ দেখাচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে পর একুশের চেতনা সদা প্রেরণা দিচ্ছে অজ্ঞতা, অশিক্ষা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানি পেরিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলতে।

একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিধন্য মহান স্মারক বিশ্বজনীন স্বীকৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঘটনাটি রূপান্তরিত হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চে। বিশ্বব্যাপী ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের অর্নিবাণ আলোকশিখা হয়ে বিশ্বয়ানের বহুত্ববাদী সমাজে বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি বৈশ্বিক অনুপ্রেরণার উৎসস্থলে পর্যবসিত হয়েছে। এই গৌরব বাংলার, বাঙালির, বাংলাদেশের।

বাংলার, বাঙালির অস্তিত্বের প্রতীক একুশে ফেব্রুয়ারির মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলার, বাঙালির সংবাদ সারথি বার্তা২৪.কম সকল ভাষাশহিদ ও ভাষাসংগ্রামীকে জানাচ্ছে সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত বাংলাভাষী জনমণ্ডলীতে জানাচ্ছে আন্তরিক অভিনন্দন। আর বিশ্বের সকল মানুষের, প্রান্তিক ও কেন্দ্রস্থ সমাজের, যাবতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ, চর্চা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি জ্ঞাপন করছে পূর্ণ সমর্থন ও সহমর্মিতা। প্রত্যাশা করছে, অমর একুশে চিরঅম্লান হোক বাংলার, বাঙালির আত্মার অন্তঃস্থল ছুঁয়ে বিশ্বের প্রতিটি ভাষার মহান বর্ণমালার প্রতিটি স্বর আর ব্যাঞ্জন বর্ণে।