শরতের আনন্দ ভ্রমণে পদ্মার তীর

  • মো. আব্দুল হাকিম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পদ্মা চরের কাশফুলের শুভ্র সৌন্দর্যে প্রকৃতির মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছেন বিনোদনপ্রেমীরা। ছবি: মো. আব্দুল হাকিম

পদ্মা চরের কাশফুলের শুভ্র সৌন্দর্যে প্রকৃতির মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছেন বিনোদনপ্রেমীরা। ছবি: মো. আব্দুল হাকিম

নীল আকাশে ভেসে চলা সাদা মেঘের দল, মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুলের শুভ্রতা, আর সবুজে মোড়ানো পদ্মার তীর—এসব মিলিয়ে শরৎ যেন তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে পদ্মার চরে এসে মেলে এক অন্যরকম প্রশান্তি। প্রকৃতির এই মোহনীয় রূপ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে ভ্রমণপিপাসু মানুষ, যাদের হৃদয় ভরে ওঠে শরতের অপরূপ সৌন্দয্যে। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে দুলতে থাকা কাশফুলের ঢেউ যেন শরতের আগমনী বার্তা ছড়িয়ে দেয় চারদিকে, যা যেকোনো মনকে নিমিষেই আনন্দে ভরিয়ে তোলে।

শরৎ বাংলা ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু, এর মায়াবী সৌন্দর্য প্রকৃতিকে যেমন সাজিয়ে তোলে, তেমনিভাবে মানুষের হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি দিয়ে। শরতের মূল সৌন্দর্য নিহিত সাদা কাশফুল, শিউলি ফুলের সুবাস আর আকাশের নীলের সঙ্গে খেলা করা সাদা মেঘে। রাজশাহীর পদ্মার চর এই শরতের শুভ্রতা ও স্নিগ্ধতার অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠেছে। পদ্মার তীরে ফোটা কাশফুল আর নদীর বুকে ভেসে থাকা শান্ত জল শরতের প্রকৃতিকে যেন আরও উজ্জ্বল ও মোহনীয় করে তোলে। এই শরৎকালে পদ্মার জেগে ওঠা চর এখন রাজশাহীর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে, যা স্থানীয় ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য নতুন বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহীর পদ্মা নদীর পাড়ে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি ভিড় জমছে দর্শনার্থীদের। শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে, প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইলে পদ্মার চর হয়ে উঠেছে প্রথম পছন্দ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, মাঠজুড়ে কাশফুলের ঢেউ, আর নদীর পাড়ে গোধূলি বেলার সোনালি আভা, সব মিলিয়ে এই চর শরতের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। চরের মাঝে দুলতে থাকা কাশফুল আর বাতাসে ভাসমান শিউলি ফুলের ঘ্রাণে ভ্রমণপ্রেমীরা এখানে এসে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার চর যেন একটি ছোট্ট স্বর্গে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনই এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন হাজারো মানুষ। রাজশাহীর মুক্তমঞ্চ এলাকা থেকে পদ্মার বিশাল চর দেখা যায়। পুরো চরটি এখন সাদা কাশফুলে ভরে গেছে, যা দূর থেকে দেখে মনে হয় একটি শুভ্র চাদরে ঢাকা। এই চরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে ভ্রমণপিপাসু মানুষজন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় পর্যটকরা জানান, চরের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে এসে কেউই বিমোহিত না হয়ে পারেন না। এর মধ্যে যেমন স্থানীয় মানুষদের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, তেমনই ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে দিন দিন।

রাজশাহী শহরের বাসিন্দা মাহমুদ হাসান বলেন, শরতের এই সময়টা আসলেই মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে পদ্মার চরে কাশফুলের এই সৌন্দর্য সত্যিই অতুলনীয়। ব্যস্ত নগরজীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য দূরে এসে এমন প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করা সত্যিই অন্যরকম।

আবু তালেব নামে একজন স্থানীয় গরুর রাখাল জানান, প্রতিদিন ভোরে মাঠে গরু নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের কাশফুলের অপরূপ দৃশ্য দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। শরতের এই স্নিগ্ধতা অন্য কোনো ঋতুতে পাওয়া যায় না। তার মতে, শরতের সময়টাতে পদ্মার তীরে ভ্রমণ করা মানেই প্রকৃতির এক মহোৎসবের অংশ হয়ে যাওয়া।

শরতের ভ্রমণের বিশেষ আকর্ষণ কাশফুল হলেও, তার সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে নদীভ্রমণ। পদ্মার পাড় ধরে নৌকায় ভ্রমণ করে, আশেপাশের পরিবেশ উপভোগ করার এক ভিন্নরকম আনন্দ আছে। রাজশাহীর পদ্মা গার্ডেন, টি-বাঁধ, আই বাঁধ, আর মুক্তমঞ্চের কাছে নৌকা নিয়ে এসে অনেকে শরতের এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। এসব স্থানে নৌকা সারি সারি দাঁড় করানো রয়েছে, মাঝিরা যাত্রীদের নিয়ে নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এবং যাত্রীরা কাশবনের সৌন্দর্য নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ছবি তুলছেন।

রাজশাহীর পদ্মার চর এখন একপ্রকার মিনি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। পদ্মার চরজুড়ে কাশফুলের সমারোহ, আর নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষজন, সবকিছুই এখন এক মিলনমেলা তৈরি করেছে। বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই এখানে এসে শরতের এই সুন্দর সময়টিকে উপভোগ করছেন।

রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী রাফিয়া সুলতানা বলেন, প্রতিদিন বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে এখানে আসি। পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে কাশফুলের স্নিগ্ধতা আর বাতাসের দোলায় মনে অন্যরকম প্রশান্তি আসে। আমরা প্রায়ই ছবি তুলি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করি, যা আমাদের শরতের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্যও এটি বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। রুবিনা খাতুন নামে একজন গৃহিণী জানান, পরিবার নিয়ে একসঙ্গে সময় কাটাতে এমন সুন্দর জায়গা আর হয় না। পদ্মার চর, কাশফুলের ঢেউ আর গোধূলি বেলা—সব মিলিয়ে আমাদের ঘুরতে আসার অভিজ্ঞতাটা অসাধারণ। শরৎ মানেই কেবল কাশফুল নয়, এই সময় প্রকৃতিতে আরও অনেক রঙের খেলা হয়। শিউলি ফুল, শাপলা, শালুক, আর বিলে ভেসে থাকা লাল শাপলা ফুল এই ঋতুর সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তোলে।

তিনি জানান, শরতের স্নিগ্ধতা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি মানুষের মনের মধ্যেও নতুন আনন্দের সৃষ্টি করে। পদ্মার চর এই শরতে সেই আনন্দের উৎস হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ প্রকৃতির এই অনন্য রূপ উপভোগ করতে আসছেন।

শরতের এই ভ্রমণ মৌসুমে পদ্মার চর পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকছে প্রতিদিন। আর সেই সঙ্গে ব্যবসার প্রসারও হয়েছে ব্যাপক। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, শরতের সময় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি হওয়ায় তাদের ব্যবসাও ভালো চলছে।

রাজশাহীর মুক্তমঞ্চ এলাকার ঝালমুড়ি বিক্রেতা হাসান আলী বলেন, শরতের শুরু থেকেই পদ্মার চরে প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসছেন। আমরা যারা এখানে ব্যবসা করি, তাদের জন্য এটা দারুণ সময়। লোকজন বেড়াতে এসে নানা ধরনের খাবার কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, আর আমাদের ব্যবসাও এতে ভালো হচ্ছে।

শরতের কাশফুল দেখতে শুধু রাজশাহী শহর থেকেই নয়, পাশের জেলা থেকেও অনেক মানুষ ছুটে আসছেন। অনেকেই এখানে এসে বনভোজনের আয়োজন করছেন। বিশেষ করে ছুটির দিনে পদ্মার চরে মানুষের ভিড় আরও বেশি দেখা যায়।

শরতের এই সময়টি প্রকৃতির এক অপূর্ব আবহ তৈরি করে। বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুলের নরম স্নিগ্ধতা, শিউলি ফুলের মৃদু সুবাস, আর নীল আকাশে ভাসমান মেঘের সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন আরও জাঁকিয়ে ওঠে। এমন স্নিগ্ধ পরিবেশে এসে ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা নতুন করে জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ পান। রাজশাহীর পদ্মার চর এখন সেই জায়গা হয়ে উঠেছে, যেখানে শরতের সৌন্দর্য আর শান্তির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারে যে কেউ।

শরৎকাল তার অনন্য বৈশিষ্ট্যে রাজশাহীর পদ্মার চরকে সৌন্দর্যের এক অসাধারণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে। কাশফুলের শুভ্রতা, শিউলি ফুলের মৃদু সুবাস, আর পদ্মা নদীর শান্ত স্রোত মিলিয়ে এই চর এখন প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রিয় গন্তব্যে রূপ নিয়েছে। প্রাকৃতিক এই অপরূপ দৃশ্যের মাঝে ভ্রমণকারীরা হারিয়ে যান, যেখানে শরতের রোদ, মেঘ, কাশফুল আর নদীর শান্ত জলের মধ্যে মেলে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

পদ্মার চরের এই সৌন্দর্য শুধুমাত্র পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে নয়, বরং মানুষের হৃদয়ে নতুন আশার সঞ্চার করে, ব্যস্ত জীবনের মাঝেও একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দেয়।