'বধূ গো এই মধু মাস বুঝিবা বিফল হল'

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক্স: বার্তা২৪.কম

জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রস্নাত ভোর এলো লকডাউনের বারান্দায়। ঘরবন্দী পরিস্থিতিতে মধু মাস শুরু হলো তাজা ফলের গন্ধে। আক্ষরিক অর্থেই কথাটি সত্য। দিব্যি দেখা যাচ্ছে, আশেপাশের অনেকগুলো গাছে ঝুলছে কাঁচা-পাকা আম। ছোট-বড় কাঁঠালগুলো পুরো গাছের শরীর জড়িয়ে থরে থরে সেজে রয়েছে। নগরের দূষণ ও কেমিক্যালহীন বিশুদ্ধ  বাতাসে ভাসছে রস টসটসে ফলের আদি ও অকৃত্রিম গন্ধ।

অকল্পনীয় বিষয়ই বটে। রূপকথায় যেমন হয়, গাছে গাছে হীরা, চুনি, পান্না ঝুলছে, কেউ ধরছে না। ঠিক তেমনি ব্যাপার চারিদিকে। গাছে ফল নিরাপদে ঝুলছে। জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যপটে এমন ছবি অভাবনীয়, অভূতপূর্ব এবং আশ্চর্যজনক। এমন চিত্র রূপকথাতে সম্ভব হলেও জনবহুল বাংলাদেশে একেবারেই অসম্ভব ও অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু করোনার কারণে এমনটিই সম্ভব হয়েছে। 

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম শহরের উত্তর প্রান্তের ঈষৎ উচ্চভূমির টিলাময় যে এলাকা থেকে মধু মাস শুরুর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হচ্ছে, তা বনানীময় এবং ফলদায়ক বৃক্ষের জন্য প্রসিদ্ধ। করোনার কারণে সঙ্গরোধ ও সামাজিক দূরত্ব বিধানের ফলে পুরো এলাকার গাছপালাগুলো নির্বিঘ্নে ফলবতী হয়েছে। কেউ ছুঁয়েও দেখছেনা। বাচ্চা ছেলেমেয়ে বা চোরের উৎপাতেও নষ্ট হয়নি। সব ফল পরিপুষ্ট ও পরিপূর্ণ অবয়বে দুলছে।

শহরের দক্ষিণ প্রান্তের সমুদ্র উপকূলের সুদীর্ঘ সৈকত ও বেলাভূমি তরমুজ, বাঙ্গির জন্য বিখ্যাত। ভ্যানে করে ভাসমান দোকানিরা তা হেঁকে হেঁকে বিক্রি করছে বাসার নিচে। নানা জাতের আম ফেরি হচ্ছে। লিচু বলেও ডাকাডাকি করছে ফেরিওয়ালা। করোনার মধ্যেও রাজশাহী, দিনাজপুর, রাঙামাটি নানা জায়গা থেকে ফলের চালান আসতে শুরু করেছে। ফলের বাহার ও সমাবেশ দেখে মধু মাসের আগমন টের পাওয়া যায় এই ঘোরতর করোনাকালেও।

করোনার জন্য দেশের প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার এমন এক বিরাট পরিবর্তন হয়েছে যে, বাজারে না গিয়েও বাজারের হালচাল ঘরে বসেও টের পাওয়া যায়। লোকজন সঙ্গরোধের কারণে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া হাট-বাজারে যাচ্ছেনা। ফলে বাজারই উঠে এসেছে পাড়া, মহল্লা, বাসার সামনে। হেন জিনিস নেই, যা ফেরি করা হচ্ছে না। ভ্যানে খাঁচা বোঝাই মুরগি, গামলা ভর্তি জ্যান্ত মাছ, শাকসবজি, ফলমূল সবই পাওয়া যাচ্ছে হাতের নাগালে। বারান্দা থেকে লম্বা দড়িতে বাঁধা ছোট ছোট বোল বা বালতিতে করে নাগরিকগণ কেনাকাটা করছেন। দামাদামি থেকে শুরু করে ঠিক জিনিসটা কেনার ব্যাপারে গৃহিণীরা পালন করছেন অগ্রণী ভূমিকা।

আচার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকমের আম কেনার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। আর করোনার বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আগ্রহ দেখাচ্ছে পুষ্টিগুণে ভরপুর বিভিন্ন ফলের প্রতিও। জ্যৈষ্ঠ হল মধুমাস, মানুষও তাই ফলের প্রতি মনোযোগী। কারণ এ মাসে বাজার সয়লাব হয় আম, কাঁঠাল, লিচু, জামসহ নানা ফলে। আরো থাকে আনারস, তরমুজ, ডেউয়া, লটকন, গোলাপ জাম, বেতফল, গাব, জামরুল, আতাফল, শরীফা প্রভৃতি ফল।

এসব ফল খোলা বাজারে আসতে শুরু করেছে ক'দিন আগে থেকেই । বিশেষ করে, আম পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। মধুমাসের প্রধান ফল আম নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘বন্ধু, আজো মনে পড়ে আম কুড়ানোর খেলা/ আম কুড়াইতে যাইতাম দু’জন নিশি ভোরের বেলা।’ এই গানে কণ্ঠ দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন আব্বাস উদ্দিন আহমেদ।বাংলাদেশে আমের প্রধান এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে জ্যৈষ্ঠে চলে বহুবিচিত্র আমের ছড়াছড়ি। ৫৮ জাতের আম ফলে সেখানে। ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, আম্রপালি, গোগলা গুটি, মোহনভোগ, বালুসার ইত্যাদি হলো আমের উল্লেখযোগ্য জাত।

মূলত মহানন্দা নদীর ওপারে শিবগঞ্জ, কানসাট, সোনা মসজিদ এলাকাতেই বেশি আম হয়। লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর ও রাজশাহী এলাকা। লিচুর উল্লেখযোগ্য জাত হল চায়না, বোম্বে, বারি। সবই বাজারে আসে মধু মাসে, সঙ্গে আনে জাম, জামরুল, কাঁঠাল এবং আরো বহু জাতের ফল।

তবে, পরিবেশ দূষণ ও বাণিজ্যিক অসততা-অসাধুতার কারণে চিরায়ত বাঙালি জীবনে ঐতিহ্যময় মধুমাস ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়ছে। নানা রকমের রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় ফলের গুণ ও মানের হানির পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে স্বাস্থ্যগত বিপদ। ফরমালিন/কার্বাইড দেয়া ফল খেয়ে ক্যান্সার, কিডনি নষ্ট হওয়ার মতো ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের লোভ ও লোলুপতা কম থাকায় ফলে রাসায়নিক প্রয়োগ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু সত্য হয়, কে জানে!

আরেকটি সত্য, যা মধু মাসের সঙ্গে জড়িত, তা হলো, জৈষ্ঠ্যমাস নয়, মধু মাস হলো চৈত্র, তথা বসন্তকাল। মধুমাস শব্দের অর্থ চৈত্র মাস। মধ্যযুগের দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেছেন, ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ এখানে তিনি চৈত্র মাসের কথাই বলেছেন। কারণ জ্যৈষ্ঠ মাসে কোকিল ডাকে না। প্রাচীন কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীও চৈত্র মাস অর্থেই মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন এইভাবে, ‘মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ। মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।’ স্বয়ং চণ্ডীদাসও চৈত্র মাস বা বসন্তকাল অর্থে মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘মধুমাস আপায় মাধব পরশে।’ এছাড়া খনার বচনেও মধুমাস বলতে চৈত্র মাসকেই বোঝানো হয়েছে।

কবিতার পঙক্তি ছাড়াও অভিধান মতে, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্তকাল। আবার মধু বলতেও এই বসন্তকালকেই বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে বসন্তের সখা কোকিলের আরেক নাম হচ্ছে ‘মধুসখা’। এছাড়া হিন্দিতে ‘বাহারী’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অন্যদিকে ফারসিতে ‘বাহার’ মানে বসন্তকাল, ‘বাহারী’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়।

অর্থ, তাৎপর্য ও তত্ত্বগত দিক থেকে কোনো শব্দের মূল-প্রকৃতি যা-ই হোকনা কেন, পরিস্থিতি ও সময়ের ব্যবধানে তা বদলে যেতে পারে। এমন অনেক শব্দ আছে, যা আদিতে যে অর্থে ছিল, বর্তমানে সে অর্থ বহন করেনা। বরং ভাবার্থে অনেক বদলে গেছে অর্থ। বাংলার ভাষায় ‘মধুমাস’ তারই প্রমাণবহ। ফলে এখন মধুমাসের আভিধানিক অর্থ মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। ব্যবহারিক অর্থে ফলের প্রাচুর্যের সঙ্গে জ্যৈষ্ঠমাসকে সম্পর্কিত করে যে মধুমাস প্রয়োগ ও গৃহীত হয়েছে, তা-ই সবার চেনা ও পছন্দের। একাধিক মিষ্টি ফল পাকে বলেই মধু মাস হিসেবে জ্যৈষ্ঠ মাসকে গণ্য করেছে সাধারণ মানুষ আর এটাই জ্যৈষ্ঠমাসকে মধু মাস রূপে বৈধতা ও স্বীকৃতি দেয়।

তবে, এটা সত্য যে, প্রেম-প্রণয়ের সঙ্গে মিশে বসন্তকলের চৈত্র মাস কিংবা রসালো ফলের সঙ্গে মাখামাখি করে জ্যৈষ্ঠমাস মধু মাসের আবহ তৈরি করে। বসন্তের মধুময়তা উদ্ভাসিত হয় চেতনায় আর জ্যৈষ্ঠের মধুময়তা রসনায়। কিন্তু ভয়াবহ করোনার পরিস্থিতিতে লকডাউনের সঙ্কুল সময়ে খোলা ও উদার প্রকৃতিতে প্রেয়সীর সঙ্গে মধুযামিনী যেমন অসম্ভব, তেমনি করোনায় যোগাযোগ বিচ্ছিনতা ও বিরূপতার কারণে বহুবিচিত্র সুমিষ্ট-রসালো  ফলের আস্বাদনও অসম্ভব, কষ্টকর। 

তাপিত ও পীড়িত পৃথিবীতে তখন মনে হয়, 'বধূ গো এই মধু মাস বুঝিবা বিফল হল/ ভুলে গেছ তুমি সেই মধু নামে ডাকা/ মিলন ছায়া মধু মাস আজিকে ঢাকা’। বহুবর্ষ আগে যে গানটি কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী  শচীনদেব বর্মন গেয়েছিলেন, করোনা-আক্রান্ত এই মধু মাসে সেই গানই মর্মের গহীন-গভীরে গুঞ্জরিত হচ্ছে।