অনলাইন শিক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে

  • তন্বী আক্তার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বর্তমান করোনাকালীন বাস্তবতায় শিক্ষা জগতের একটি আলোচিত বিষয় অনলাইন ক্লাস। মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে—সেশন জট নিরসন। অনেক শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা একটি দীর্ঘমেয়াদী সেশনজটে পড়বে যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অনলাইন ক্লাসের স্বপক্ষে কিছু বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে। যথা, শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছে তাতে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এগিয়ে আসা উচিত। এছাড়াও বিশ্বের ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। উদাহরণগুলোকে সামনে রেখে অনেকেই অনলাইন ক্লাস চালিয়ে নিচ্ছে। আরো কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ক্লাস নিতে আগ্রহ পোষণ করছে।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, ২৪ ঘণ্টায় কতজন মারা যাচ্ছে—এসব দেখে যখন চক্ষু ছানাবড়া তখন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাবছে অনলাইন ক্লাসের কথা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ হতে পারে করোনার রূপ। এই ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা কোনোটাই সুষ্ঠুভাবে সুশিক্ষা গ্রহণের জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। যেখানে বেঁচে থাকার লড়াই সর্বত্র, সেখানে অনলাইন ক্লাস কতটুকু যুক্তিসম্মত?

বিজ্ঞাপন

সর্বপ্রথম ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বল্পকালীন ছুটি দেখে অনেকেই শিক্ষাসামগ্রী না নিয়ে বাড়িতে চলে যান। এমতাবস্থায়, শিক্ষাসামগ্রী ছাড়া অনলাইন ক্লাসে যোগদান করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ গ্রামে অবস্থান করছেন। এখনো বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই ঠিকমতো ‘টুজি’ কাজ করে না, সেখানে অনলাইন ক্লাস করা সত্যিই বড্ড কষ্টের এবং কল্পনাতীত ব্যাপার। ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা উচ্চমূল্যের কারণে ক্লাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না অনেক শিক্ষার্থী। অনলাইন প্রতিদিন আড়াই থেকে তিনঘণ্টার ক্লাসের জন্য ৩০০ এমবি থেকে কখনো কখনো ৬০০/৭০০ এমবি পর্যন্ত লাগে (বিভিন্ন ডিভাইস ভেদে কম বা বেশি মেগাবাইট লাগতে পারে)। আর এই লকডাউনের সময়ে, করোনা যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে তখন বাইরে গিয়ে মোবাইল রিচার্জ করাটা স্বাস্থ্যগতভাবে কতটা নিরাপদ?

অন্যদিকে লকডাউনে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারে উপার্জন ব্যবস্থা অনেকের বন্ধ। কিভাবে সংসার চালাবে তা নিয়ে প্রায় প্রতিটি পরিবারের মাথাব্যথার শেষ নেই। এছাড়া রোজার মাসে খরচ বেশি। বলতে গেলে, আমাদের দেশে করোনার চেয়ে সংসার চালানো নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। ক্ষুধার কাতরতা যেখানে মানুষকে কাঁদাতে বাধ্য করছে, সেখানে মেগাবাইট কিনে ক্লাস করা কি আদৌ সম্ভব বা ক্লাস নিলেও মানবিকতার দিক থেকে কতটুকু সমীচীন?

মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে আজ কোন চাহিদাগুলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা সবার আগে ভাবাটা বাঞ্ছনীয়।

ইন্টারনেটের ধীরগতি কিংবা ডিজিটাল প্রযুক্তির সফলতা সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য না হওয়ায় অনলাইন ক্লাসের উপস্থিতির হারও তেমন সন্তোষজনক নয়। যেহেতু অনেকেই অনলাইনের ধীরগতির জন্য ক্লাস ভালোভাবে করতে পারছে না, মিস করছে—ফলশ্রুতিতে সেসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নতুন করে মানসিক চাপ। অনলাইন ক্লাস যাদের জন্য, তারাই যখন অংশগ্রহণে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে তখন কী দরকার এই আয়োজনের ?

এ তো কেবল অনলাইন ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কিছু সমস্যার চিত্র। পাশাপাশি একটি প্রশ্ন সকল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে—“অনলাইন ক্লাস এই সময়ে কতটুকু কার্যকরী হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ ফলের (Learning outcome) ওপর কতখানি ভূমিকা রাখছে?”

ক্লাসে সরাসরি শিক্ষক, শিক্ষণ উপকরণ পেয়ে ক্লাস করার পরেও অনেক বিষয়ে আমাদের ধারণা বোধগম্য হয় না। সেই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা এই বিষয় নিয়ে গ্রুপ স্টাডি, সেল্ফ স্টাডি করে পরবর্তী ক্লাসে আবারো শিক্ষককে প্রশ্ন করে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে শুধুমাত্র স্লাইড দেখিয়ে, ক্লাস রেকর্ড আপলোড করে কিংবা এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ক্লাস সম্পন্ন করছেন। এই ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কতটুকু বুঝতে সক্ষম হচ্ছে? এক সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করলে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে মতামত আদান-প্রদান অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বলা হচ্ছে যেসব শিক্ষার্থীরা মেধাবী, ইচ্ছা শক্তি রয়েছে তারা নিশ্চয়ই বুঝতে সক্ষম হবে। কিন্তু একই ক্লাসে নানা ধরনের শিক্ষার্থী থাকে। শুধুমাত্র একশ্রেণীর শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করলেই তো আর হবে না। যে কোনো বিষয় গভীরভাবে না পড়িয়ে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ ফল মূল্যায়ন না করে সেমিস্টার দ্রুত শেষ করার জন্য যদি পড়ানো হয় তাহলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাথে এক ধরনের প্রতারণা করা হবে। অন্যদিকে, চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যা ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হলে বিভিন্ন উপকরণের প্রয়োজন, যা অনলাইন ক্লাসে পাওয়া সম্ভব না। চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নানা বিষয়ের জন্য ল্যাবরেটরির প্রয়োজন। যদিও বলা হচ্ছে—এখন তাত্ত্বিক শিক্ষা দেওয়া হবে এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়, যে বিষয়ে ব্যবহারিক ক্লাস ছাড়া পাঠদান সম্পন্ন করা এবং শিক্ষার্থীদের বোঝার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করে তাহলে সেই শিক্ষা এই ক্রান্তিলগ্নে দেওয়ার প্রয়োজন কতটুকু?

বিশ্বের ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদাহরণকে টেনে এনে অনলাইন ক্লাসের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপট আর আমাদের প্রেক্ষাপটের মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নত বিশ্বে অবস্থিত। তাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট আমাদের দেশের চেয়ে অনেক উন্নত এবং প্রযুক্তি অনেক উচ্চমানের। তাছাড়া বিশ্বের ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা তাদের শিক্ষাদানের গুণগত মান নিশ্চিত করে আসছে। সচরাচর আমরা সেই বিষয়ে নজর তেমন না দিলেও এই ক্রান্তিলগ্নে তাদের সাথে তুলনা করে অনলাইন ক্লাস নেওয়া কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ?

সেশনজট আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় এক পরিচিত নাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়ের সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। তবে বর্তমান সময়ে যে ধরনের সেশনজটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা এর নিরসনে চাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। নিয়মিত ক্লাস, অতিরিক্ত ক্লাস, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য রেজাল্ট দেওয়া, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের লাল ফিতার দৌরাত্ম যথাসম্ভব হ্রাস করা (সম্ভব হলে অনলাইন ভিত্তিক করা)। সিলেবাস কমানো কারণ অনেক সময় মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের থিওরি অনার্স, মাস্টার্সে পড়ানো হয়। বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করে সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

সেশনজট নিরসনের জন্য অনলাইন ক্লাসে যদি শর্টকার্ট পদ্ধতিতে কোর্স সম্পন্ন করে, ভালো নম্বর দিয়ে দ্রুত সেমিস্টার সম্পন্ন করে তাহলে এর ফলাফল মোটেও ফলপ্রসূ হবে না বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাব দেখা দেবে। অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা কতখানি বা কী প্রভাব ফেলতে পারে এরূপ গবেষণার প্রমাণ বা ফলাফল ছাড়া বড় মাপের অনলাইন নির্ভর শিক্ষা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।


তন্বী আক্তার
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।