বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প ও 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র ৭০ বছর
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প, পাঠাগার আন্দোলন নিয়ে গবেষণার সুবাদে বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর ঐতিহাসিক তথ্য চোখে পড়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সেলের অর্থায়নে পরিচালিত কাজটিতে বাংলাবাজার, চৌমুহনী, কোম্পানিগঞ্জের নোটবই বা অর্থ পুস্তকের গণ্ডি থেকে সৃজনশীল প্রকাশনার বিকাশের কিছু ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।
দেশভাগ-পরবর্তীকালে ঢাকায় মননশীল ও সৃজনশীল লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন অগ্রণী প্রকাশক। যাদের মধ্যে 'আহমাদ পাবলিশিং হাউজ'র মহিউদ্দিন আহমাদ ও 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র আলহাজ্ব মোঃ হাবিবুল্লাহ অগ্রগণ্য। পরে যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন 'মুক্তধারা'র চিত্তরঞ্জন সাহা ও 'ইউপিএল'র মহিউদ্দিন আহমদ এবং অবসর, প্রতীক, মাওলা ব্রাদার্স।
আরো পরে আরো অনেকেই প্রকাশনা শিল্পে এলেও বাংলাদেশের প্রকাশনার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বদের কৃতিত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে দেশভাগের ক্ষত নিয়ে একটি দেশের নতুন ও ছোট্ট প্রাদেশিক রাজধানীতে লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পাঠক সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পের আধুনিক গোড়াপত্তনের কঠিন কাজটি তাদেরকেই করতে হয়েছিল। কিন্তু সেসব আখ্যান মোটেও লিপিবদ্ধ হয়নি।
কলকাতায় যেমন প্রকাশনার স্মৃতিচারণমূলক ইতিহাস রচিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু (পিয়ন থেকে প্রকাশক), মিত্র ও ঘোষের ভানু বাবু তথা সবিতেন্দ্রনাথ রায় (কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর) প্রমুখের দ্বারা, ঢাকার ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। ফলে এখানকার প্রকাশনা শিল্পের উত্থান ও বিকাশের নেপথ্য কাহিনী বলতে গেলে চাপা পড়ে আছে। প্রকাশকরা বহু লেখকের বই বের করলেও সেসবের পেছনের কথা ও প্রকাশনার ইতিবৃত্ত সংরক্ষণ করেননি, যা ভবিষ্যতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে শূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র ৭০ বছর অতিক্রমের ঘটনা। একটানা প্রকাশনায় এতো দীর্ঘ সময় সুনামের সঙ্গে টিকে থাকাও একটি অনন্য রেকর্ড।
১৯৫০ সালে 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' প্রতিষ্ঠা করেন আলহাজ্ব মোঃ হাবিবুল্লাহ। তখন প্রেস ও পাবলিশিং-এর দিক থেকে ছিল বিরূপ পরিস্থিতি । অনেক প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ী কলকাতায় পাড়ি দিয়েছেন। বই আনতে হতো সীমান্তের ওপার থেকে। আলহাজ্ব মোঃ হাবিবুল্লাহ সাহেব সেই সময় এদেশের প্রতিভাবান ভালো লেখকদের লেখা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুসাহিত্যসহ নানা বিষয়ের বইপত্র এদেশে প্রকাশ করার চিন্তাভাবনা নিয়ে এই প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন।
নিজেদের প্রকাশিত বই ছাড়াও সারা বাংলাদেশের নবীন- প্রবীণ লেখকদের সব ভালো বইগুলো একই ছাদের নিচে বিক্রির ব্যবস্থা করেন তিনি। আমাদের অনেকেরই শৈশব ও কৈশোরের সঙ্গেও 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র নাম মিশে আছে। দূরের বাংলাবাজারে আধুনিক ঢাকা থেকে সব সময় যাওয়ার সুযোগ ছিলনা, যতটুকু কাছের ছিল স্টেডিয়াম ও নিউমার্কেটের বইপাড়া। সেখানে জ্বলজ্বল করতো 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র বইগুলো।
বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই বের করেছে 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'। নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদেরও তুলে ধরেছে এই বনেদি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সৃজনশীল, মননশীল, বিশ্বসাহিত্য, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুধু অগ্রগামীর ভূমিকাই পালন করেনি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকাও পালন করেছে।
বিপুল পাঠক গোষ্ঠীর পাশাপাশি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা তাঁদের স্মৃতিকথায় লিখেন 'স্টুডেন্ট ওয়েজ ' তাঁদের ' প্রিয় প্রকাশক'।
'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র সাত দশক পূর্তির ঘটনা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উত্তরণের পথে অনন্য মাইলফলক।