পৌরাণিক মহামারি, নেপথ্যে এক হত্যাকারী!
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসঘটনাটি পুরাকালের। মহামারি আক্রান্ত একটি শহরের বাসিন্দারা পরিত্রাণের আশায় উদ্বিগ্ন। ঊর্ধ্বশ্বাসে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করছে বিপন্ন মানুষজন। শেষ পর্যন্ত সকলে হাজির হলেন অ্যাপোলোর মন্দিরে। প্রকৃত কারণ জেনে মহামারির কবল থেকে বাঁচতে চায় জনতা।
এক সময় দৈববাণী হলো। জানা গেলো, এই মহামারির পেছনে আছে রাজ্যের এক চূড়ান্ত অপবিত্র ও অন্যায়কারী মানুষের ভূমিকা। সে একজন হত্যাকারী। তাকে নির্বাসন বা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করা হলেই কেবল থামবে মহামারি আর রক্ষা পাবে মানুষজন।
কিন্তু হত্যাকারী কে? কোথায় রয়েছে অপরাধের চিহ্ন ও আলামত। শাস্তি দিতে হলেও তো সাক্ষী, সাবুদ, প্রমাণ লাগবে। প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রে প্রচলিত আদি গণতন্ত্রের বিধানের কারণে কিছু নিয়ম-কানুন মেনেই যা করার, তা করতে হবে।
একদিকে মহামারির তাণ্ডব আর অন্য দিকে অপরাধীকে খুঁজে বের করার তীব্র তাড়নায় নাটকীয়তা যখন চরম তুঙ্গে, তখন অকস্মাৎ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা তায়রেসিয়াস জানালেন ভয়ানক এক তথ্য। বললেন, ‘হত্যাকারীর অনুসন্ধানকারীই স্বয়ং হত্যাকারী’!
স্বাভাবিকভাবে এ তথ্য অস্বীকার করেন নিজের অপরাধ আত্মগোপনকারী-হত্যাকারী। রেগে গিয়ে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেন হন্তারক। কিছুতেই স্বীকার করেন না নিজের অপরাধ। কিন্তু ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস, সংশয়ের দমবন্ধ প্রহর শেষে ক্রমশ উন্মোচিত হয় প্রামাণ্য সূত্র। জানা যায়, লুকিয়ে থাকা হত্যাকারীর স্বরূপ, যিনি চরমতম অপরাধের কারণে ঐশ্বরিক কোপে সমগ্র জনপদকে মহামারির প্রকোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।
কেমন ছিল তার অপরাধ? তিনি নিজের মাতাকে বিবাহের অপরাধে কলঙ্কিত এবং যেজন্য স্বজনদের হত্যা করেন তিনি। তারপর? তারপর পরিসমাপ্তিতে নিজেকে অন্ধ করে তার স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ। রাজসিংহাসন আর প্রভুত্ব থেকে নির্মম নীরন্ধ্র পতন। এভাবে অলৌকিকতা আর রহস্যের ঘনায়মান পরিসরে ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছিল সত্যের মুখ। দূর হয়েছিল মহামারি।
রাজা ইডিপাসের বহুপঠিত, বিখ্যাত ট্র্যাজেডির কথা প্রায়-সবার জানা। যেখানে সত্যানুসন্ধানী এবং অপরাধী অভিন্ন মানুষ। অবশেষে তিনি বিচারক হয়ে নিজের শাস্তি বিধান করেন। মহামারির কবল থেকে জনপদ ও দেশবাসীকে রক্ষা করেন নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার মাধ্যমে।
সোফোক্লেসের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘রাজা ইডিপাস’ (আনুমানিক ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মূলত করুণ ও বেদনা রসে সিঞ্জিত হলেও অপরাধ ও শাস্তির চিরায়ত একটি ধারণাকে তুলে ধরে। তা হলো, অপরাধের কারণে শাস্তি ব্যক্তি মানুষের বদলে পুরো জনপদ ও জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করতে পারে। পৌরাণিক ঘটনাটির মতো সেমেটিক ধর্মগ্রন্থসমূহে, যথা তাওরাত, বাইবেল, কোরআনে হাবিল-কাবিলের মধ্যকার হত্যাযজ্ঞ উল্লেখিত হয়েছে। অপরাধের শাস্তির বহু দৃষ্টান্তের কথা বলতে গিয়ে মহামারি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে।
ধর্ম ও পুরাতত্ত্বের বাইরে আধুনিক জগৎ ও জীবনে অনুসন্ধান করা হলে এমন বহু অপরাধের বিবরণ পাওয়া সম্ভব। যাতে শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক বা ঐশ্ববিকভাবে অপরাধীর শাস্তি হয়েছে কিংবা অপরাধের কারণে বিরাট বিনাশ ও প্রলয় নেমে এসেছে।
পৌরাণিক মহামারির নেপথ্যে ছিলেন এক হত্যাকারী, যিনি শেষ পর্যন্ত ধৃত হয়ে শাস্তির আওতায় এসেছিলেন। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারি আকারে প্রলয়ঙ্করীভাবে চলমান করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যে কে? তাকে কি কখনো চেনা যাবে? জানা যাবে তার জঘন্যতম অপরাধের বিষয়ে, যে অপরাধের কারণে পুরো বিশ্বকে আক্রান্ত হতে হয়েছে প্রাণঘাতী মহামারিতে? চরম মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী সেই অচেনা অপরাধী কখনো আসবে শাস্তির আওতায়?
নাকি আমরাই, যারা অপরাধীর অনুসন্ধানকারী, পৌরাণিক ঘটনার মতো তারাই আসলে অপরাধী? প্রকৃতি, পরিবেশ ও পৃথিবীর প্রতি আমরা প্রতিনিয়ত যে অপরাধ করছি, তারই মূল্য শোধ করছি মহামারি কবলিত হয়ে?