৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহকে নেতৃত্ব দেওয়া কে এই হাসান নাসরুল্লাহ

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হাসান নাসরুল্লাহ

হাসান নাসরুল্লাহ

লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল জানায়, শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন। তবে হিজবুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি, কোনো বিবৃতিও দেয়নি।

১৯৮২ সালে তিনি হিজবুল্লাহতে যোগদান করেন। পরে তিনি গোষ্ঠীটির তৃতীয় মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধসহ তিনি প্রতিবেশী সিরিয়ার সংঘাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বেশ কয়েকবছর ধরে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় ছিলেন না তেমন কোন আলোচনায়। আড়ালে থেকেই দিয়েছেন এসব নেতৃত্ব।

বিজ্ঞাপন

কে এই হাসান নাসরুল্লাহ? তার উত্থানই বা কিভাবে? এসব বিষয়ই এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বার্তা২৪.কমের পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হয়েছে।  

কে এই হাসান নাসরুল্লাহ? 

হাসান নাসরুল্লাহকে অনেকে লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করেন। তার হাতে রয়েছে ১ লক্ষ যোদ্ধার ভাণ্ডার এবং লেবাননের সরকারে রয়েছে তার দলের সদস্যেরা।

হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ সালের ৩১ আগস্ট মাটন জেলার (বৈরুতের একটি পূর্ব শহরতলী) বোরজ হামমুদে একটি শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দশ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন নবম। তার বাবা আবদুল করিম ছিলেন একজন ফল ও সবজি বিক্রেতা। তার পরিবার বিশেষভাবে ধার্মিক না হলেও তিনি ধর্মতাত্ত্বিক গবেষণায় আগ্রহী ছিলেন। প্রাথমিক জীবনে আল-নাজাহ স্কুলে এবং পরে বৈরুতের খ্রিস্টান অধ্যুষিত সিন এল ফিল এলাকার একটি পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেন।

১৯৭৫ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় তার পরিবারকে বাধ্য হয়ে বাজোরি শহরে চলে যেতে হয়। সেখানে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই তিনি লেবাননের শিয়া সম্পর্কিত রাজনৈতিক দল আমাল মুভমেন্টে যোগ দেন।

নাসরুল্লাহ বালবেক শহরের বেকা উপত্যকার শিয়া সেমিনারিতে পড়াশোনা করেছেন। ওই স্কুলটি ছিল ইরাকি বংশোদ্ভূত আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ বাকির আল-সদরের। তিনি ইরাকের নাজাফে দাওয়া আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার শিক্ষা অনুসরণ করেন।

লেবাননে ফিরে, নাসরুল্লাহ আমালের নেতা আব্বাস আল-মুসাভির স্কুলে অধ্যয়ন ও শিক্ষাদান পেশায় যোগদান করেন। পরে বেকায় আমালের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তাকে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কার্যালয়ের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।

১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহতে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরুল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হন তাঁর পূর্বসূরি আব্বাস আল–মুসাবি।

এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত থাকলেও ওই বছরই হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালায়। এতে আট সেনা নিহত ও দুজন অপহৃত হন। পরে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে যুদ্ধবিমান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রায় চার হাজার রকেট ছুড়ে জবাব দেয়। 

৩৪ দিন ধরে চলা ওই লড়াইয়ে অন্তত ১ হাজার ১২৫ লেবাননি নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন বেসামরিক লোক। নিহত হন ১১৯ ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের ৪৫ বেসামরিক নাগরিকও। লড়াই চলাকালে ইসরায়েল নাসরুল্লাহর বাড়ি ও অফিসে যুদ্ধবিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে। তবে তিনি অক্ষত থাকেন।

হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব

নাসরুল্লাহর নেতৃত্বের সময় হিজবুল্লাহ দীর্ঘ পাল্লার রকেটের ক্ষমতার অধিকারী হয়। যা দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থাকা সত্ত্বেও উত্তর ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পরই প্রথম কাজ ছিল তার পূর্বসূরি আব্বাস আল–মুসাবির হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। সে লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে হিজবুল্লাহ। সে অনুযায়ী ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দেন তিনি। হামলায় একজন নিহত হন। পাশাপাশি তুরস্কে ইসরায়েলের দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় এক ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৯ জন নিহত হন।

শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, দক্ষিণাঞ্চলেও তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। একপর্যায়ে ২০০০ সালে সেখান থেকে পিছু হটে দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা। তবে নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হয় তাঁর বড় ছেলে হাদিকে।

তবে আরব বিশ্বে তার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে ২০১১ সালের দিকে। যখন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীর পাশে দাঁড়ায়। 

নাসরুল্লাহ ইসরায়েলকে হিজবুল্লাহর চিরশত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের শিয়া ধর্মীয় নেতাদের এবং হামাসের মতো ইসরায়েল বিরোধী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তিনি গভীর জোট তৈরি করেছেন।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ভূমিকা

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে হামাসের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে হিজবুল্লাহ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ৮ অক্টোবর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি সীমান্তের সামরিক পোস্টগুলিতে আক্রমণ শুরু করে এবং একে গাজার জন্য "ব্যাকআপ ফ্রন্ট" বলে অভিহিত করে।

এসব হামলায় হিজবুল্লাহ আট হাজারের বেশি রকেট ব্যবহার করেছে। ছুড়েছে ইসরায়েলি সমরযান লক্ষ্য করে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন দিয়েও আক্রমণ চালিয়েছে বিভিন্ন ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনায়। বিপরীতে লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানোর পাশাপাশি ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপ ও গোলন্দাজ ইউনিট ব্যবহার করছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।

এর প্রেক্ষিতেই ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে লেবাননে হামলা চালায়। গত সপ্তাহে এর উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। বারবার হামলা করা হয় হিজবুল্লাহর ওপর। 

এরই মধ্যে গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) থেকে গোটা লেবাননজুড়ে নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সবচেয়ে বেশি হামলা হয় হিজবুল্লাহ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলে। এতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হামলায় নিহতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে ইতোমধ্যে। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। 

এছাড়াও লেবাননজুড়ে ইসরায়েলের ব্যাপক বোমা হামলার কারণে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছেন লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে, ইসরাইলি ভূখণ্ডে পালটা হামলা অব্যাহত রেখেছে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা। বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ইসরাইলের কিরায়াত আতা ও সাফেদ এলাকা লক্ষ্য করে ১৩০টি রকেট ছুঁড়ে হিজবুল্লাহ।

গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গত এক বছর ধরে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত লড়াই চলছে। এতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের অধিকাংশই হিজবুল্লাহ যোদ্ধা। এ ছাড়া লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

হিজবুল্লাহ বলেছে, তারা হামাসের সমর্থনে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা তা থামাবে না। দুটি সংগঠনই ইরান সমর্থিত। ইসরায়েল, যুক্তরাজ্যসহ আরও অনেক দেশ তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

এর আগে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) লেবাননে পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হলেও তারা হামলার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। এতে প্রায় অর্ধশত লেবানিজ নিহত হয় এবং আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ।

বর্তমান সময়ে হাসান নাসারুল্লাহর প্রাসঙ্গিকতা শুধু লেবাননের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ইরানের মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত তিনি। তার মৃত্যুর খবর যদি নিশ্চিত হয় তাহলে নি:সন্দেহে বলা যায় এর সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীর জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা হবে। এতে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ঘণ্টাও বেজে যাতে পারে।