ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়ার পুরস্কার
ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টার জন্য এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির মতে, যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার রোধ করতে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করার জন্য ডব্লিউএফপিকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হলো।
শুক্রবার (৯ অক্টোবর) নরওয়ের স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় রাজধানী অসলো থেকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি এবারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে।
এ সময় নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ডব্লিউএফপি খাদ্য সুরক্ষাকে শান্তির উপকরণ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় মূল ভূমিকা পালন করেছে এবং যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধার ব্যবহারকে মোকাবিলায় জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে একত্রিত করার জন্য জোরালো অবদান রেখেছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা সংক্রান্ত সংস্থা। এটি ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত বিশ্বের বৃহত্তম সংস্থা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নিজস্ব তথ্যমতে সংস্থাটি প্রতি বছর ৮৮টি দেশে ৯৭ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেয়। সারা বিশ্বে এর ৮০টিরও বেশি শাখা আছে।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার সময়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে নোবেল দিয়ে সম্মানিত করা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর দ্বারা সংস্থাটি কাজের প্রতি আরও উৎসাহী হবে বলে আমরা মনে করি।
ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া সওয়াবের কাজ। এটা মানবিকতার পরিচয়ও বটে। এটি এমন সওয়াবের কাজ, যার মাধ্যমে আল্লাহর দয়া ও করুণা অর্জিত হয়। আল্লাহ বান্দার জন্য রিজিকের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, মানুষের কল্যাণসংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা। - সহিহ বোখারি: ১২
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি। অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে এতিম আত্মীয় অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকিনকে অন্নদান।’ -সূরা আল বালাদ: ১০-১৬
তাই ক্ষুধার্ত দরিদ্র ব্যক্তিকে খাবার দানের মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী বান্দা হিসেবে গণ্য হতে পারি।
ইবাদত দুই ভাগে বিভক্ত। এক. মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত ইবাদত। যেমন- নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ ইত্যাদি। দুই. বান্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত ইবাদত। যেমন- মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, বিপদে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়া। ক্ষুধার্তকে আহার করিয়ে পরিতৃপ্ত করা মহান আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় আমল।
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, ইসলামে কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ? নবী করিম (সা.) বলেন, ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে- ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো।’ –সহিহ বোখারি: ১২
ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাবার দানকারী ব্যক্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য হবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে আমরা তোমাদের খাবার দান করি, তোমাদের নিকট এর কোনো প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না।’ -সূরা দাহর: ৯
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দয়াশীলদের ওপর দয়াময় আল্লাহ দয়া করে থাকেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ –সুনানে তিরমিজি: ১৯২৪
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অনুগ্রহ করে না, তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হয় না।’ –সহিহ বোখারি: ৭৩৭৬
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিনে একটি বড় বিপদ দূর করে দেবেন।’ –সহিহ বোখারি: ২৪৪২
ক্ষুধার্তকে খাবার দান করার মাধ্যমে মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়। এতে আমরা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে পারি। আবার তাদের কষ্ট লাঘবের কারণে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন বিভিন্ন কষ্ট লাঘব করে দেবেন।
ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমরা কি দিইনি তাকে দু’টি চোখ? এবং জিহ্বা ও দু’টি ঠোঁট? আর আমরা তাকে দেখিয়েছি দু’টি পথ। কিন্তু সে তো ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। তুমি কি জানো ঘাঁটি কী? তা হলো দাসমুক্তি। অথবা ক্ষুধার দিনে এতিম নিকটাত্মীয়কে অথবা ভূলুণ্ঠিত অভাবগ্রস্তকে খাবার দেওয়া।’ -সূরা বালাদ: ৮-১৬
শোকরিয়া আদায় করলে সম্মান-মর্যাদা ও সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের বেশি বেশি করে দেব।’ -সূরা ইবরাহিম: ৭
গরিব, অসহায় ও ক্ষুধার্তকে খাবারদানকারী হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুগত্যকারী বলে গণ্য হবেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্ষুধার্তকে খাবার দান করতে কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা ভিক্ষুককে (ক্ষুধার্তকে) কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হলেও।’ –সুনানে নাসাঈ: ২৫৬৫
তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়, যে নিজে পেট পুরে আহার করে। কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ –বায়হাকি: ৩৩৮৯
তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষুধার্তকে খাবার দান করো। তাহলে শান্তির সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ –সুনানে তিরমিজি: ১৯৮৪
ক্ষুধার্তকে খাবার দান করে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করা যায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো গরিবের চলার পথ সহজ করে দেয়, দুনিয়া-আখেরাতে মহান আল্লাহ তার চলার পথ সহজ করে দেবেন।’ –সুনানে আবু দাউদ: ২৫৯৪
সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মিসকিনদের জন্য চেষ্টা-সাধনাকারীদের সম্বন্ধে এ কথাও বলেছেন যে, ওই ব্যক্তি একাধারে নামাজ ও রোজা পালনকারীর মতো।’ –সহিহ বোখারি: ৬০০৭
মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসার খাতিরে ক্ষুধার্ত এতিম, মিসকিন ও কয়েদিদের খাবার দান করে। যার কারণে মহান আল্লাহ তাদের কিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনের অনিষ্ঠ থেকে রক্ষা করবেন। শুধু তাই নয়, বরং তাদের দান করবেন আনন্দ ও সজীবতা। তাদের ধৈর্যশীলতার জন্য দেবেন জান্নাতের রেশমি পোশাক। জান্নাতে তারা উচ্চ আসনে হেলান দিয়ে বসবে।’ -সূরা দাহার: ৮-২২