অশ্লীলতা ও অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে এখনই উদ্যোগ নিন
‘বেশ কিছুদিন ধরে ফেসবুকের নিউজফিড রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত স্পা ও বডি ম্যাসাজ সেন্টারের বিজ্ঞাপনে সয়লাব। বুস্ট করা এসব বিজ্ঞাপনে বডি ম্যাসাজের আপত্তিকর বিভিন্ন ছবি প্রচার করা হচ্ছে। ক্যাপশনে লেখা, ‘এখানে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করে নিরাপদ ও নিরিবিলি পরিবেশে শুধুমাত্র মেয়েদের দ্বারা পুরুষদের ফুল বডি ম্যাসাজ করা হয়। কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে বিদেশি মেয়েদের টোপও দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে বুকিংয়ের জন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে ঘণ্টা প্রতি ম্যাসেজের রেটও উল্লেখ করা হচ্ছে।’
সম্প্রতি জনপ্রিয় ইসলামি চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় আলোচক, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ ফেসবুকে ‘রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত স্পা ও বডি ম্যাসাজ সেন্টার’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘এ ধরণের তথাকথিত স্পা ও ম্যাসাজ সেন্টারের উদ্দেশ্য যে পতিতাবৃত্তিকে শিল্পের রূপ দেওয়া, সেটা বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে বহু নিরীহ মেয়েকে নানা প্রলোভন ও ফাঁদে ফেলে ব্যবহার করা হয়।’
নানা অপকর্মের সূতিকাগার হিসেবে আখ্যায়িত করে এগুলো বন্ধের দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা সময়মতো কথা বলি না। সর্বনাশ হয়ে গেলে সবাই গেল গেল রব তুলি। আসুন, সবাই যায যার জায়গা থেকে নষ্টামীর এই নতুন আখড়াগুলোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। নতুবা আমাদেরই পরিবার-পরিজনের কেউ এগুলোর শিকারে পরিণত হতে পারে। আর মন্দ কর্মে বাধা না দিলে আল্লাহর গণগজব থেকে কেউই রক্ষা পাবো না।’
খবরে প্রকাশ ২০ সেপ্টেম্বর রাতে গুলশানের ‘আপেল থাই স্পা ও ছোঁয়া বিউটি পার্লারে’ অভিযান চালিয়ে ১২ জন পুরুষ ও ১৬ নারীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
এর ঠিক চারদিন পর (২৪ সেপ্টেম্বর) গুলশানের নাভানা টাওয়ারে অবস্থিত ‘হিজামা থেরাপি সেন্টার এন্ড বডি মাসাজ’ নামের একটি স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে নারীসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এসব ঘটনার প্রায় এক বছর আগে একই কাজে একই এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আরও ৩৪ জনকে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এই স্পা সেন্টারে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন বয়সী নারীদের একত্রিত করে দেহব্যবসা পরিচালনা, যৌন শোষণ ও নিপীড়নমূলক কাজ চলে আসছিল। আমরা অনেক দিন ধরে লক্ষ্য করছিলাম। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তারা পতিতাবৃত্তির কাজের সঙ্গে জড়িত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তা কথা স্বীকার করেছেন।’
স্পা ও ম্যাসাজ পার্লারের বিজ্ঞাপন আর পুলিশি অভিযানে এটা স্পষ্ট যে, এসব স্থানে নানা ধরনের অপরাধ ও অসামাজিক কাজ হয়ে থাকে। পুলিশি অভিযান হলে কিছুদিন বন্ধ থাকে, পরে আবার যেই সেই। অশ্লীলতার ইঙ্গিত দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রচার করে নানাবয়সী পুরুষদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অশ্লীল কাজের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে।
সমাজে অশ্লীলতার প্রসার, গর্হিত অপরাধ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ইনসাফ, ইহসান ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমা লঙ্ঘন করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ -সূরা নাহল: ৯০
বর্ণিত আয়াতে ইনসাফ, ইহসান ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি অনুগ্রহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমা লঙ্ঘন করতে নিষেধ করা হয়েছে।
সাধারণভাবে বলা যায়, লজ্জাহীনতা, রুচিহীনতা, অসুন্দর, অশোভন কাজের সামষ্টিক রূপ হলো- অশ্লীলতা। যাকে জঘন্য, অশালীন, কুরুচিপূর্ণ ও কদর্যরুচির কাজ বলে অভিহিত করা যায়। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেছেন, অশ্লীলতার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো- ব্যভিচার। কাজেই ব্যভিচার ও ব্যভিচারের প্রলুব্ধকারী সব ধরনের ইঙ্গিত, কথা, কাজ, চিত্র ও ভঙ্গিমা অশ্লীলতার অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামে সব ধরনের অশ্লীলতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, আমার পালনকর্তা হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, আর পাপ ও অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরিক করা- যার কোনো সনদ তিনি পাঠাননি ও আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা তোমরা জানো না।’ -সূরা আরাফ: ৩৩
অশ্লীল কাজ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া অপরাধ। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার পছন্দ করে, তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ -সূরা নূর: ১৯
ইসলামে কখনোই অশ্লীলতা, পৈশাচিকতা ও আদিম পশুত্বকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অশ্লীলতা নির্মূলে ইসলাম সর্বাধিক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অশ্লীল পোশাক, অশ্লীল নৃত্য, জিনা-ব্যভিচার ও বল্গাহীন জীবনযাপনকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। কেননা এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ -সূরা বনি ইসরাইল: ৩২০
ইসলাম অশ্লীল কাজ হিসেবে ব্যভিচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন, ‘ব্যভিচারী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ- তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো।’ -সূরা নূর: ২
আল্লাহতায়ালা লজ্জাস্থান হেফাজতকারীকে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘...যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী; আল্লাহর অধিক জিকিরকারী পুরুষ ও জিকিরকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ -সূরা আহজাব: ৩৫
যাবতীয় অশ্লীলতা কবিরা গোনাহ। যা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অশ্লীল কাজের সঙ্গে যুক্ত কেউ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা যাবতীয় অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন।
সুতরাং যে সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপন করতে চায় তার প্রথম কর্তব্য, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল অশ্লীল কথা ও কর্ম থেকে বেঁচে থাকা এবং সকল কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। কখনও কোনো গোনাহ হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ খাঁটি মনে তওবা করে আল্লাহতায়ালার দরবারে ফিরে আসা এবং তওবা রক্ষার পূর্ণ চেষ্টা করতে থাকা।
ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, অশ্লীলতার জঘন্য ব্যাধি ঠেকানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে- দ্বীনি চেতনা সৃষ্টি, ঈমানকে দৃঢ়করণ, পারিবারিক শিক্ষা জোরদার ও নজরদারি, কোরআনের দিক-নির্দেশনা অনুসরণ, সর্বোপরি কথা ও কর্মে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা। দৃষ্টিকে অবনত করে চলা, শালীন পোশাক পরিধান, আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন এবং মনের মধ্যে আল্লাহর ভয় পোষণ করা।
তবে অনেক সময় এসব পথ ও পন্থা অনুসরণে অশ্লীলতা বন্ধ নাও হতে পারে। কিংবা কারও কারও কাছে কোরআন ও ঈমানের আহ্বান অপছন্দ হতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের দমন করতে হবে শাসনের মাধ্যমে। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ কখনও কখনও কোরআন দিয়ে যা দমন করা যায় না, তা শাসনের মাধ্যমে দমন করেন।’
সুতরাং আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বিষয়টি আমলে নিয়ে সমাজকে নিরাপদ ও কলংকমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন। কোনো ভবনের মালিক, এমন জঘন্য কাজের জন্য ভবন ভাড়া দেবেন না। যার যার অবস্থান থেকে একযোগে এমন অশ্লীল ও অসামাজিক কাজ প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন। অশ্লীলতার যাবতীয় উপায়-উপকারণ বন্ধে উদ্যোগী হবে। এটা করতে হবে, আল্লাহর গজব থেকে বাঁচার জন্য, আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য ও মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্য।