সুকুক ইস্যু: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী ঘটনা

  • মো. মাঈন উদ্দীন, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সুকুক ইসলামি শরিয়াভিত্তিক একটি প্রডাক্ট, ছবি: সংগৃহীত

সুকুক ইসলামি শরিয়াভিত্তিক একটি প্রডাক্ট, ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ সরকার প্রথম বারের মতো দেশে শরিয়াভিত্তিক ইসলামি বন্ড সুকুক চালু করেছে। সুকুক আরবি শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেওয়ার আইনি দলিল। চলতি বন্ড ও সুকুক বন্ডের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সুকুকে ইসলামি রীতি অনুসরণ করা হয়। এখানে সুদের ব্যবস্থা নেই, আছে মুনাফা; যা আগে থেকে নির্ধারণের উপায় নেই। যেটি বাৎসরিক কর্মকাণ্ডের আয়-ব্যায়ের ওপর নির্ধারিত হয়।

বিশ্বের অনেক দেশে এই বন্ড চালু আছে। সুকুক ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রথম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এবং ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) সুকুক ছেড়েছে। এছাড়া বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সুকুক প্রচলিত রয়েছে। মুসলিম দেশের পাশাপাশি অনেক অমুসলিম দেশে সুকুক চালু আছে।

বিজ্ঞাপন

সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর শরিয়াভিত্তিক বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় সরকার কর্তৃক সুকুক ইস্যু ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত গাইড লাইন জারি করেছে প্রজ্ঞাপন আকারে। এতে করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ইসলামি ব্যাংক ও ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্র ও পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।

অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বেশি, যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজে ঘাটতি অর্থায়নে সরকার এখন পর্যন্ত প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তা গ্রহণ করে আসছে। অথচ, দেশে বিদ্যমান ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শরিয়াভিত্তিক হওয়ার কারণে প্রকল্প উন্নয়ন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সুকুক চালুর মাধ্যমে এসব ইসলামি প্রতিষ্ঠান এখন থেকে সরকারের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে বন্ড দুই ধরনের। একটি ট্রেজারি বিল এবং অন্যটি ট্রেজারি বন্ড। ট্রেজারি বিল স্বল্প মেয়াদী আর ট্রেজারি বন্ড দীর্ঘমেয়াদী অর্থাৎ ২ থেকে ১০ বছর। বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন সরকারি বন্ড সঞ্চয়পত্র এবং প্রাইজ বন্ড প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এখন সাধারণভাবে বলা যায়, ইসলামি বন্ড সুকুকও এক ধরনের সরকারি বন্ড।

সুকুক ইসলামি শরিয়াভিত্তিক একটি প্রডাক্ট। এখানে প্রচলিত বন্ডের মতো সুদের ব্যবহার থাকে না। বন্ডের সুদের হার আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। সুকুকে মুনাফা নির্ধারিত হয় বাৎসরিক আয়-ব্যায়ের ওপর। প্রচলিত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা যে অর্থ বিনিয়োগ করে তার ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে অর্থ লাভ করে। কিন্তু সুকুকের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা পূর্ব থেকে নির্ধারিত হারে কোনো অর্থ পায় না। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে ওই প্রতিষ্ঠানের আয় ও মুনাফা যখন যেমন হয় তার অংশীদারিত্ব লাভ করে।

ইসলামি বন্ড হয় ইজারাভিত্তিক মানে নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক। কিন্তু সাধারণ বন্ডের ক্ষেত্রে তা হয় না। ঋণগ্রহিতা ও ঋণদাতার মধ্যে যে চুক্তি হয়ে থাকে তাহল প্রচলিত বন্ড। এতে ঋণের পরিমাণ, ঋণ পরিশোধের সময় ও সুদের হার নির্ধারিত থাকে। এ প্রচলিত বন্ডে সুদ, ফটকা ইত্যাদি থাকায় তা শরিয়াসম্মত নয়। সুকুক হচ্ছে এমন একটি বিনিয়োগ সনদ, যেখানে সম্পদের ওপর মালিকানা দেওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। সাধারণ সুকুককারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করে এবং শরিয়াসম্মতভাবে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মুনাফা লাভ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে দেশে মোট সঞ্চয় ও বিনিয়োগকারীদের ২৮ শতাংশ ইসলামি ধারায় বিনিয়োগে আগ্রহী। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থায় সুদ গ্রহণ ও প্রদানে তারা আগ্রহী নয়। তাছাড়া দেশে ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত, বিনিয়োগ রেমিট্যান্স ও আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এসব ইসলামি প্রতিষ্ঠান দারুণ অবদান রাখছে।

তাছাড়া সরকারের অর্থ মন্ত্রনালয়ের বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারিত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ। ইসলামি ব্যাংক ও শরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও ঝোঁক দিনদিন আরও বাড়ছে। এছাড়া আর্ন্তজাতিক গবেষণা সংস্থা থমসনের ২০১৬-১৭ সময়ে প্রকাশ করা বৈশ্বিক ইসলামি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ইসলামি অর্থায়নে সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ মার্কিন ডলার। বলা হয়, ইসলামি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এতই ইতিবাচক যে চলতি ২০২১ সালেই তা সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াভিত্তিক কোনো উপকরণ নেই। সুকুক চালু হলে ইসলামি ব্যাংকসমূহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাবে এবং সরকারও ঘাটতি অর্থায়নে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। সরকারের সুদের ব্যয়ও কমবে।

বাংলাদেশের নাগরিক যেকোন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন রাষ্ট্রায়াত্ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ইসলামি ব্যাংকসমূহ সুকুক কিনতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক একজন বিনিয়োগকারী সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ নেই। সুকুক ৫ বছর মেয়াদী এবং বিনিয়োগকারীরা ৬ মাস পরপর মুনাফা পাবেন।

দেশে প্রচলিত ইসলামি ব্যাংকগুলোর স্কিম যেমন- ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, যার মুনাফার হার ৩.৬৯ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে সুকুকের প্রাক্কলিত মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.৬৯ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, সুকুকে প্রাইমারী ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রসপেকটাস অনুযায়ী (স্পেশাল পারপাস ভেহিকল) এসপিভি প্রাইভেট প্লেসমেন্ট অথবা অকসানের মাধ্যমে অভিহিত মূল্যে সুকুক ইস্যু করা যাবে। ইনভেস্টমেন্ট ডিলারসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সুকুক অকসানে নিজেদের জন্য বিড দাখিল করতে পারবে। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ক্রয়কৃত সুকুক সেকেন্ডারি মার্কেটেও ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। নিবাসী অথবা অনিবাসী বিনিয়োগকারী উভয়ই সেকেন্ডারি মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তারল্য ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সুকুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এ ছাড়া সমাজের বৈষম্য নিরসনে সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ও মালিকানার জন্য সুকুক একটি উত্তম ও শরিয়াসম্মত প্রডাক্ট। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুকুক ইস্যু একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সরকার অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইসলামি শরিয়াভিত্তিক বিনিয়োগ প্রডাক্ট সুকুক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ইসলামি বিধি-বিধান কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের বিধানসমূহ শরিয়া এডভাইজারী কমিটির মাধ্যমে কতটুকু প্রতিফলন ঘটবে সেটা দেখার বিষয় রয়েছে। সুকুক প্রডাক্ট সফল বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ব্যবস্থাপকদের ও বিনিয়োগকারীদের শরিয়া নীতিমালা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন অতীব জরুরি। এখানে কোনো ধরনের হেরফের কিংবা অমনোযোগিতা কাম্য নয়।