ব্যক্তি প্রশংসা ও তোষামোদ প্রসঙ্গে ইসলাম
মুসলিম সমাজে মানুষের চরিত্র হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। তাদের কথা ও কাজের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য থাকবে না। তারা একে অন্যের তোষামোদি করবে না, স্বার্থ হাসিলের জন্য সব ধরনের তেলবাজি থেকে দূরে থাকবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সমাজে এর চিত্র একেবারেই ভিন্ন, ধীরে ধীরে সমাজ তোষামোদের সমাজে পরিণত হয়েছে। কেউ সুবিধা আদায়ের জন্য, কেউ পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিংবা অসুবিধায় পড়ে একে অন্যের অযাচিত প্রশংসায় লিপ্ত হয়। একদিকে চলে পেছনে পেছনে চরম পরচর্চা অন্যদিকে চলে মুখোমুখি অতি প্রশংসা। পরচর্চার পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যক্তি প্রশংসা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, অধিকার এবং মানুষের ব্যক্তিত্বকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে। ইসলাম এমন বাড়াবাড়িমূলক কাজকে অতি নিন্দনীয় ও হারাম ঘোষণা করেছে।
প্রশংসার বিষয়ে ইসলামের মূলনীতি হলো, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। আর ব্যক্তি চরিত্রের প্রশংসা করা হবে নবী-রাসূলদের। তাই ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসাও করতে হয় বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে। যেমন নামাজে ও নামাজের বাইরে তার প্রতি দোয়া-দরুদ পাঠ করার বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে। আর এই নিয়ম স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজের ব্যাপারেও সাহাবিদের অতিরিক্ত প্রশংসায় প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে আমার সাহাবিরা, তোমরা তোমাদের নবীর ব্যাপারে এমন কোনো প্রশংসায় প্রবৃত্ত হবে না, যেমন করেছিল তোমাদের পূর্ববর্তীরা। তারা (খ্রিস্টানরা) তাদের নবীর প্রশংসা করতে করতে তাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। অথচ তিনি (ঈসা আ.) ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ একজন নবীর প্রতি এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে যে, উম্মতরা তাকে প্রভু বানিয়ে ফেলে! অতএব নবী-রাসূলগণের প্রশংসার ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হয়, যাতে কোনো প্রকার অতিশয়োক্তি করা না হয়।
দ্বিতীয় মূলনীতি হলো, মুসলিম মাত্রই অন্যের প্রশংসার বিষয়ে সাবধান থাকবে। ইসলামে আত্মপ্রশংসা হারাম। যে ব্যক্তি নিজে নিজের গুণগান করে বেড়ায়, ইসলামের দৃষ্টিতে সে ঠুনকো ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে নেতৃত্বের উপযুক্ত নয়। হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান, যে নিজের সমালোচনা করে।’ -সুনানে আবু দাউদ
ইসলামে সাধারণত উদ্দেশ্য হাসিলকে সামনে রেখে কোনো ব্যক্তির প্রশংসা জায়েজ নয়। ইসলাম এ কাজকে অতি গর্হিত ও নীতিবিবর্জিত স্বভাব হিসেবে দেখে। এ ছাড়া বিষয়টি সার্বিক দিক বিবেচনায় শিষ্টাচারবিরোধী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের আওতাভুক্ত। এ জন্য হাদিসে দেখা যায়, যখনই কেউ সামনে উপস্থিত ব্যক্তির প্রশংসা করত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং তাতে বাধা দিতেন এবং তার বিরোধিতা করে বক্তব্য পেশ করতেন। অনুরূপভাবে সাহাবিদের সামনেও কেউ প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করলে তারা তা ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন এবং সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করতেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এবং কী কারণে ব্যক্তি প্রশংসাকে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন। যদিও এতে মানুষের জন্য উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনার কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। আরও মনে করা হয়, প্রশংসার দ্বারা মানুষের কর্মক্ষমতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ে। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এতে সামান্য উপকারিতা পরিলক্ষিত হলেও বাস্তবে এর নেতিবাচক এমন সব অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে যা ঈমান, আমল ও বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেমন, কারো মুখোমুখি প্রশংসা করা হলে-
আল্লাহর সঙ্গে শিরক হতে পারে। মনের মাঝে অহঙ্কার সৃষ্টি হতে পারে। কোনো কাজের নিয়ত ও একনিষ্ঠতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। লোক দেখানো আমলের প্রবণতা বাড়তে পারে। অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হতে পারে। অসত্য বলতে হতে পারে। অবৈধ সুবিধা আদায়ের কারণ হতে পারে। প্রশংসার ছলে তিরস্কার করাও উদ্দেশ্য হতে পারে। ইত্যাদি। এসব কারণে হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে ব্যক্তি প্রশংসা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে অসংখ্য বর্ণনা ও ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মজলিসে এক ব্যক্তির প্রশংসা করা হলো। তিনি তা শুনতে পেয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ! তুমি তো তোমার ভাইয়ের গলা কেটে দিলে!’ এ কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘তোমাদের কারও যদি একান্তই প্রশংসা করতে হয়, তাহলে এরূপ বলবে, আমার ধারণামতে তিনি এরূপ। অবশ্য যদি সে সত্য সত্য সে রূপ হয়ে থাকে। অথচ তার প্রকৃত অবস্থা তো আল্লাহই ভালো জানেন। আর আল্লাহর সম্মুখে কেউ নির্দোষ নয়।’ -সহিহ বোখারি
এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত উমর (রা.) এক প্রশংসাকারীর মুখে বালু ছুড়ে মেরেছেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, তৎকালীন আরবে কোনো কথা অপন্দনীয় হলে, তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করার পরিবর্তে মুখে বালু নিক্ষেপ করা হতো। এতে চরম বিরক্তি ও বিরাগ প্রকাশ পেত।
এভাবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিদের কাছ থেকে ব্যক্তি প্রশংসা সম্পর্কিত যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, তাতে একজন ব্যক্তিত্ববান মুসলিমের পক্ষে এমন হীন কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। এতে অপরের পাশাপাশি নিজের ব্যাপারেও ভুল বিশ্বাস তৈরি হয় এবং নিজের অজান্তে আত্মোপলব্ধির অনুভূতি হ্রাস পায়। অন্যদিকে অতিশয় প্রশংসিত ব্যক্তি যদি সমাজের ক্ষমতাশালী কেউ হয়, তা হলে সে আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। কাজেই সর্বাবস্থায় ব্যক্তি প্রশংসা থেকে বিরত থাকা উত্তম।
ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তির যদি প্রশংসা করতে হয়, তা হলে এতটুকু বলা যায় যে, তিনি একজন ভালো লোক। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার অনেক সাহাবির ব্যাপারে অনুরূপ বলেছেন। যেমন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে ভালো লোক আবু বকর, ভালো লোক উমর, ভালো লোক আবু উবাইদা, ভালো লোক উসআদ ইবনে উযাইর, ভালো লোক সাবিত ইবনু কায়স, ভালো লোক আমর ইবনুল জামুহ ও ভালো লোক মুআজ ইবনু জাবাল!’ -আদাবুল মুফরাদ
এই হচ্ছে ব্যক্তি প্রশংসার একমাত্র সঠিক রীতি, যা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রকাশ পেয়েছে। এমনিভাবে মানুষকে সত্যিকারভাবে অণুপ্রাণিত করা হয় এবং মূল্যায়ন করা হয়। অথচ এতে ব্যক্তির কোনো ক্ষতি করা হয় না।