মুসলমানের ছয়টি বিশেষ গুণ
ইসলাম হলো- একটি পরিপূর্ণ জীবন দর্শন, যা শুধুমাত্র কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং মানব জীবনের সুন্দর ও পরিশীলিত সমগ্র কর্মকাণ্ডের বিকশিত রূপ। মুসলমান তার কাজকর্মের মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে। একজন মুসলমান যখন নিজেদের বিশ্বাস ও আচরণের মাধ্যমে পরিশুদ্ধতা অর্জন করবে, তখন সমাজ তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। মুসলমানের আলাদা বিছু বৈশিষ্ট্য থাকবে। এসব হলো-
ঈমানদার মাত্রই শ্রেষ্ঠ মানুষ
একজন মুসলমান ঈমান আনার পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হওয়ার কথা। ঈমান আনার পর তার ভেতরে অনেকগুলো গুণ বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়, যা অন্যকোনো ধর্মাবলম্বীর মাঝে দেখা যায় না। যেমন- একজন মুসলমান প্রথমেই ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তা ও কর্মকে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের আলোকে ঢেলে সাজায়। সমাজে তার যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি খুঁজে বেড়ায়। যার কারণে দুনিয়ার স্বার্থ মুক্ত থাকে তার যাবতীয় চিন্তা ও কর্ম এবং তিনি হয়ে ওঠেন নিঃস্বার্থপরায়ণ ব্যক্তি। আল্লাহর প্রতি জবাবদিহির অনুভূতি তার যাবতীয় কাজকে করে সুন্দর ও পরিশীলিত। যার কারণে সূক্ষ্ম বিষয়গুলো তার নজর এড়ায় না। পরার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার মাঝে সে জীবনের সফলতা খুঁজে পায় এবং সমাজে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় তিনি হয়ে ওঠেন আত্মোৎসর্গী। ভোগবাদী মানসিকতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত। উপার্জনের হালাল-হারাম মেনে চলার কারণে একজন মুসলিম অন্যায় ও অবৈধ কাজের ধারে কাছে যান না। তার পক্ষে দুর্নীতিপরায়ণ হওয়া একেবারে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। একজন মুসলমান দুনিয়ায় তার প্রকৃত কর্তব্য সম্পর্কে জানার কারণে তিনি পৃথিবী গড়া বা সমাজ গড়ার কাজটা আপন মনে সম্পন্ন করেন। এ ব্যাপারে তাকে কেউ তাগাদা দিতে হয় না। কারণ এ দায়িত্বের অবহেলার পরিণতি তার জানা আছে।
দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে ও মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়
ইসলাম মানুষকে শেখায় পৃথিবীর সব সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। একজন ভালো মুসলমান জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেয় এবং সৃষ্টির সবার প্রতি তার দায়িত্ব অনুভব করে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই অনুভূতি নিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) পথে পথে ঘুরতেন, আর কাঁদতেন, এই বলে যে- ফোরাতের তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মরে, তাহলে কাল কেয়ামতের ময়দানে আমাকে আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে। জবাবদিহির এ অনন্য অনুভূতি তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত করেছিল। ইসলামি অনুশাসন পালনকারী একজন মুসলমান শুধু মানুষ বা প্রাণীই নয় একটি উদ্ভিদকেও সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে থাকে। সে হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ পরিবেশবান্ধব ব্যক্তি। কেননা নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ -আবু দাউদ : ৫২৪১
ইসলাম মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করে
আল্লাহতে বিশ্বাসী একজন মুসলিম বিশ্বাস করে আল্লাহর সৃষ্টির কারও ক্ষতি করা যাবে না। এই বোধের লালন ও অনুশীলন তাকে সমাজের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী হিসেবে পরিণত করে। সে মুসলমান হয়ে ওঠে সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ আমানতদার ও ওয়াদা রক্ষাকারী। কারণ হাদিসে আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, চারটি গুণ এতই মূল্যবান যে, তা যদি তোমার মধ্যে থাকে, তাহলে দুনিয়ার আর কী তোমার নেই সে চিন্তারই দরকার নেই। এই চার গুণ কী? এই চার গুণ হচ্ছে- আমানত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা, উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া ও রিজিক হালাল হওয়া। -মুসনাদে আহমদ : ৬৩৬৫
মুসলমান হবেন ধৈর্যশীল ও বিনয়ী
প্রকৃত মুসলমান হবেন ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীলতার গুণে গুণান্বিত। সবক্ষেত্রে হবেন নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী। একজন মুসলিমের জন্য তা অপরিহার্য গুণাবলি হিসেবে বিবেচিত হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব মনীষী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী পর্যন্ত অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। সাহাবি, তাবেঈ ও সালফে সালেহিনরা সবাই বিনয়ের চর্চা করতেন। কেননা হাদিসে বলা হয়েছে, ‘বিনয় মানব জীবনের একটি অত্যন্ত মহৎ গুণ এবং আকর্ষণীয় চারিত্রিক ভূষণ। বিনয়ী ব্যক্তি যেমন আল্লাহর নিকট ভালোবাসার পাত্র, তেমনি মানুষের কাছেও প্রিয়ভাজন। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়।’ –তিরমিজি : ১৯৬৪
নিঃস্বার্থপরায়ণ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য
একজন মুসলমান বিবেকবান মানুষ হিসেবে সবার প্রতি ইনসাফ করবেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সর্বদা ন্যায় ও ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাক।’ -সুরা আন নিসা : ১৩৫
জ্ঞান সাধনা ও আমলের সমন্বয়কারী হবেন তিনি। কেননা কোরআনে কারিমের সুরা সফের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অসন্তোষজনক কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো না, যা করো না।’ তিনি নৈতিকতার দিক থেকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সমাজে সকলের কাছে ভালো মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবেন। হাদিসে এসেছে, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম। -সহিহ বোখারি : ৩৫৫৯
একজন সত্যিকার মুসলিম সকল ধরনের স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন।
লোভ ও অহংকারমুক্ত হবেন
প্রকৃত মুসলিম যাবতীয় লোভ-লালসা, হিংসা এবং অহংকার থেকে মুক্ত হবেন। হিংসা-বিদ্বেষ একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। মানুষের চরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ মারাত্মক ক্ষতিকারক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাজকে অত্যন্ত বিষাক্ত করে তোলে। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা সতর্ক করে বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সেজন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ -সুরা আন নিসা : ৫৪
হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা এরূপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান করবে না, কারও গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করবে না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, পরস্পর হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে না, পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করবে না, বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
আর অহংকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না।’ -সুরা নাহল : ২৩
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ –সহিহ মুসলিম