রহমতের নবী

  • মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রিয়াজুল জান্নাত, মসজিদে নববী

রিয়াজুল জান্নাত, মসজিদে নববী

এ বিশাল পৃথিবীটা যখন অশান্তির চরম দুঃসময় অতিক্রম করছিল, পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করছিল এমন একজন মুক্তিকামী মহামানবের জন্য, যিনি পৃথিবীর অবিন্যস্ত অবয়ব পাল্টে নতুন করে ঢেলে সাজাবেন পৃথিবীকে। ঠিক সেই মুহূর্তে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে আগমন করলেন সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য অপার রহমত হিসেবে। পবিত্র কোরআনে কারিমে নবী করিম (সা.) কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি (আল্লাহ) আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ -সুরা আল আম্বিয়া : ১০৭

নবী মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য শ্রেষ্ঠতম আদর্শের নিদর্শন। গোটা মানবজাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক সম্মানিত এবং সব নবী-রাসুলের নেতা হিসেবে পরিশেষে আগমন করেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) কোনো একটি বিশেষ দল কিংবা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য নবী। কারণ তার পর দুনিয়ায় আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না। এই মর্মে রাসুলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অন্য নবীরা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সব মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

নবী মুহাম্মদ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না।’ নবী করিম (সা.) মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্যপ্রচারে নিবিষ্ট হন এবং সত্যভ্রষ্ট, পাপাসক্ত মানব সমাজকে তিনি দেখিয়েছিলেন পরম কল্যাণ ও কামিয়াবির পথ। যাতে তারা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। আর অনাগতকাল ধরে তার সে আদর্শের ছায়াতলে পরম শান্তি ও নিরাপদ আশ্রয় পেতে পারে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।

নবী করিম (সা.)-এর রওজা

নবী করিম (সা.) পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এমন এক কঠিন সময়ে যখন সমগ্র পৃথিবী আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও শান্তি ছিল না, স্বস্তি ছিল না, ধর্মের নামে অধর্ম বিরাজ করছিল সর্বত্র। শিরক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সবাই। নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছিল অবলীলায়, কন্যাসন্তানকে দেওয়া হচ্ছিল জীবন্ত কবর। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল, পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে প্রেরণ করলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তারই দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং প্রদীপ্ত চেরাগরূপে।’ -সুরা আহজাব : ৪৫-৪৬

বিজ্ঞাপন

নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ব মানবতার জন্য সত্যিকার শান্তির পথ, আল্লাহর মনোনীত বান্দা হওয়ার সত্যিকার পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি মানুষে মানুষে হানাহানি দূর করে বিশ্বজনীন মানব সমাজ গড়ার পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের অথবা কোনো আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোনো কালোর ওপর কোনো সাদার অথবা কোনো সাদার ওপর কোনো কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো আল্লাহভীতি।’

হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন, মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সম্প্রীতি ও সমবেদনার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘সুন্দর আখলাকের পরিপূর্ণরূপ দিতে আমি প্রেরিত হয়েছি।’

পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে তিনি ছিলেন সুন্দরতম ও সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি কখনই এমনটি দেখিনি যে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশে কোনো অন্যায়কারীকে শাস্তি প্রদান করেছেন।’

নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালিবের পুত্র হজরত আলী (রা.) শৈশবকাল থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রতিপালিত হয়েছেন। কিশোরদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। তিনি নবী করিম (সা.) সম্পর্কে তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন অতিশয় উদার, মহানুভব ও দয়ার্দ্রচিত্ত। সর্বাবস্থায় তার হৃদয়ের কোমলতা ও দয়ালু স্বভাবই প্রতিভাত হতো, কঠোরতা তিনি পরিহার করে চলতেন। তার মুখ দিয়ে কখনও খারাপ ও অশ্রাব্য বাক্য নির্গত হতো না। তিনি কখনও অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ করতেন না। যদি এমন কোনও অনুরোধ তার কাছে পেশ করা হতো, যা গ্রহণযোগ্য নয়, তা হলে তিনি যেমন তা অনুমোদন করতেন না, আবার সরাসরি তা নাকচও করে দিতেন না। যারা তাকে জানতেন, তারা সহজেই এর অর্থ অনুধাবন করতে পারতেন। তিনি এটা এ জন্য করতেন যেন অন্যের অনুভূতিতে এতটুকু আঘাত না লাগে অথচ অনুমোদনযোগ্য নয় এমন কাজ থেকেও সে নিবৃত্ত হয়।’

হজরত আলী (রা.) আরও বলেন, ‘তিনি ছিলেন অতিশয় পরোপকারী মহানুভব ব্যক্তি, কঠোরভাবে সত্যবাদী ও দয়ার্দ্রচিত্ত। তার সাহচর্যে আসার সৌভাগ্য যারা অর্জন করেছেন তারাই হয়েছেন মুগ্ধ ও আনন্দিত। যে কেউ তাকে দেখেছে, প্রথম দর্শনেই তার সৌম্যকান্তি তাকে আকর্ষণ করেছে এবং পরিচয় ঘনিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাকে মহব্বত করতে শুরু করেছেন।’

তিনি ছিলেন সবার আদর্শ, তার ধৈর্য, আত্মত্যাগ, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, বিনয় ও নম্রতা, দানশীলতা, আন্তরিকতা ও উদারতা বিশ্বের সব মানুষকে দান করেছে অতুলনীয় আদর্শ। তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব কাজ নিজ হাতে করতেন, নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, বকরির দুধ দোহন করতেন, নিজের কাজকর্ম নিজেই সম্পন্ন করতেন।’

হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে বিশাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এর অনুসরণ করবে তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং তার প্রেরিত রাসুলের সুন্নাহ।’ -মিশকাত শরিফ

বস্তুত বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য নষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং আচার-আচরণের ভিন্নতা সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম আদর্শ ও সর্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই সমগ্র পৃথিবীতে এবং বিভিন্ন সমাজে বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।