ধর্ম ও সম্প্রীতি
সারা বিশ্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও হত্যা চালানো সংখ্যাগরিষ্ঠদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র যেন দুর্বলের ওপর হামলা করা সবলদের রুটিনওয়ার্ক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক লীলাভূমি হিসেবে খ্যাত। যুগ যুগ ধরে এ দেশের ইতিহাসে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা লেখা আছে।
ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্নতা থাকলেও বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক কোনো যুগেই এই সহ-অবস্থানের বন্ধন ছিঁড়ে যায়নি। বাংলার ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা এবং পরাধীনতার শৃংখলমুক্ত হওয়ার জন্য বিদেশি ও জালেম শাসকবিরোধী আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বাংলার মানুষ বরাবর একাত্ম হয়েছে। সেসব সংগ্রামে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী কোনো আলাদা পরিচয়ই তাদের ছিল না।
কিন্তু ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর করা হয় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। নজিরবিহীন এই তাণ্ডবে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধের মূর্তিসহ বহু মূল্যবান সম্পদ ছাই হয়ে যায়। রামুর তাণ্ডব পটিয়া ও উখিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে।
কোনো ধর্মই অন্যায়কে সমর্থন করে না। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের মূল মন্ত্র হচ্ছে শান্তি। সব ধর্ম অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আদর্শকে অনুকরণীয় বলে ভাবে। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক বলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতার আদর্শ এ দেশে মূর্তমান। আমরা সবাই জানি, ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনোরূপ সহিংসতা, বিবাদের স্থান ইসলামে নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘ফেতনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ –সুরা আল বাকারা : ১৯১
অমুসলিমদের প্রতিও কোনো অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলাম মানবজাতির পারিবারিক-সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সামাজিক জীব হিসেবে মানবসমাজে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রাম-মহল্লার লোকজনের সঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে বসবাস করেন। তাই সমাজজীবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে সমাজের সব সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। দৈনন্দিন জীবনে আয়-উপার্জন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর কাফন-দাফন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।
সব ধর্মীয় বিধিবিধান ও আচার-অনুষ্ঠান মানবকল্যাণে এবং মানুষকে সত্য-সুন্দর ও সুখশান্তির দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। তাই বিশ্বব্যাপী আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একান্ত প্রয়োজন।
ধর্মের নামে হত্যা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস কোনোক্রমেই ধর্মের কাজ হতে পারে না। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে কোনো মানুষ যদি পেট পুরে খায়, সে ইমানদার হতে পারে না।’ সেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোনো মানুষ বিনা কারণে কাউকে হত্যা করতে পারে না। নিরীহ মানুষ হত্যা, গুম, শিশু হত্যা করতে পারে না। জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে সবাইকে যার যার ধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে ভূলুণ্ঠিত মানবতা পুনরুদ্ধার করা আজ সময়ের দাবি।