নবীপ্রেমের স্বরূপ
সাহাবাদের নবীপ্রেম ছিল দৃষ্টান্তহীন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লামকে সাহাবারা যেভাবে ভালোবাসতেন তার কোনো নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর পাওয়া যাবে না। আমরা এখানে পাঠকদের সামনে সাহাবাদের নবীপ্রেমের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
এক. আসেম ইবন ওমর বলেন, একবার হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সাহাবিদের এক দলকে এক কাজে পাঠালেন, তাদের মধ্যে জায়েদ ইবনে দাসানাও ছিলেন। জায়েদ ইবনে দাসানা এ সময় কাফেরদের হাতে বন্দী হলেন। অতঃপর তাকে মক্কায় নিয়ে যাওয়া হলো। তখন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া তাকে তার নিস্তাস নামীয় এক গোলামকে দিয়ে মক্কার হেরেমের বাইরে তানিম নামক স্থানে হত্যার জন্য নিয়ে গেল। এমতাবস্থায় তাকে হত্যার জন্য মক্কাবাসীর অনেকেই জমায়েত হলো। তাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবন হারবও ছিল। যখন তাকে হত্যার জন্য নিয়ে গেল, তখন আবু সুফিয়ান বলল, ‘জায়েদ তোমাকে আমি আল্লাহর নামে বলছি, তুমি কি ভালোবাসবে যে, এ মুহূর্তে মুহাম্মদ আমাদের কাছে তোমার অবস্থায় থাকুক এবং মুহাম্মদের মাথাটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। আর তুমি তোমার পরিবারের কাছে থাকবে? তখন জায়েদ জবাব দিলো, আল্লাহর কসম আমি চাইব না যে, আমি বর্তমানে যেখানে আছি সেখানে মুহাম্মদ (সা.) থাকুক, আর তার গায়ে একটি কাঁটাও বিদ্ধ হোক, আর আমি আমার পরিবারের মধ্যে থাকি। তখন আবু সুফিয়ান বলল, আমি আমার জীবনে মুহাম্মদকে তার সাথীরা যেরূপ ভালোবাসে সেরূপ কোনো মানুষ অপর কোনো মানুষকে ভালোবাসে তা আর দেখিনি। এ কথার পর নিস্তাস তাকে হত্যা করল। -মারিফাতুস সাহাবা : ৮/২৭৮
দেখুন, একজন সাহাবির রাসুলকে ভালোবাসার নজির। তিনি মনে মনে কল্পনাও করতে পারতেন না যে, রাসূল সা:-কে কোনো রকমের কষ্ট দেয়া হচ্ছে।
দুই. মুহাম্মদ ইবন সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনসারি বনি জুবিয়ান গোত্রের এক মহিলা উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলমানদের পরাজয়ের কথা শুনে উহুদের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে তাকে জানানো হলো যে, তার স্বামী ও ভাই যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেছেন। এ সংবাদ শুনে মহিলা কোনো ভ্রক্ষেপ করলেন না। তিনি চলতে থাকলেন সামনে উহুদের দিকে। আর লোকদের জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, রাসুল (সা.)-এর কী অবস্থা? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কী হয়েছে? লোকেরা জবাব দিলো, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ভালো আছেন। অবশেষে মহিলা উহুদের ময়দানে পৌঁছে লোকদের উদ্দেশে বললেন, আমাকে মহানবীকে দেখতে দিন। তখন লোকেরা মহানবীর দিকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দিলেন। যখন মহিলা মহানবী (সা.)-কে দেখলেন তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি জীবিত থাকলে সব বিপদই সহজ হয়ে যায়। -বায়হাকি, দালায়েলুন নাবুওয়্যা : ৩/৩০২
তিন. সাদ ইবন রাবির মা উম্মে সাদ বলেন, আমি উম্মে আমারার কাছে একদিন গেলাম। তাকে গিয়ে বললাম, খালা আমাকে আপনার যুদ্ধের বর্ণনা দিন। তখন তিনি বললেন, আমি দিনের প্রথম দিকে বাড়ি থেকে বের হলাম। দেখতে থাকলাম মানুষজন কী করছে। তখন আমার সঙ্গে একটি পাত্র ছিল যাতে কিছু পানি ছিল। অবশেষে আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছলাম। তখন তিনি তার সাহাবাদের সঙ্গে ছিলেন। তখন যুদ্ধের বিজয় বাতাস মুসলমানদের দিকে। অতঃপর মুসলমানরা যখন পরাজিত হলো; তখন আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন আমি নিজেই যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম, মহানবীর ওপর আসা আঘাত তরবারি দ্বারা প্রতিহত করছিলাম। তীর নিক্ষেপ করছিলাম। অবশেষে আমি নিজেই আহত হলাম। রাবি বলেন, তখন আমি তার পিঠে একটি গভীর ক্ষত দেখতে পেলাম। তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে এ আঘাত কে করে ছিল? তিনি জবাব দিলেন ইবন কায়েমা, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুন। যখন লোকেরা রাসুল (সা.)-কে ছেড়ে পালাচ্ছিল, তখন সে এগিয়ে এসে বলতে থাকল, আমাকে মুহাম্মদকে দেখিয়ে দিন। সে বাঁচলে আমি বাঁচব না। তখন আমি মুসআব ইবন ওমাইর এবং রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে থাকা কিছু সাহাবি এগিয়ে গেলাম তাকে বাধা দিতে। তখন সে আমাকে এ আঘাতটি করেছিল। আমিও তাকে এ অবস্থায় কয়েকটি আঘাত করেছিলাম। তবে তার গায়ে তখন দু’টি লৌহ বর্ম থাকায় তাকে হত্যা করা গেল না।
চার. ইবনে ইসহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, উহুদ যুদ্ধের দিন একপর্যায়ে রাসুল (সা.) কাফেরদের খনন করা এক গর্তে পড়ে গেলেন। তখন দু’জন সাহাবি তাকে টেনে তুললেন। তারপর একটি টিলার ওপর তাকে নিয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় তিন দিক থেকে কাফেরদের তীরবৃষ্টি আসতে থাকল। তখন সাহাবি আবু দাজানা মহানবীকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যাতে তার শরীরে একটিও তীর বিদ্ধ হতে না পারে। আর কাফেরদের তীরবৃষ্টি আবু দাজানার পিঠে বিদ্ধ হচ্ছিল। তার পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে গেল। অবশেষে তিনি শাহাদৎ বরণ করলেন। আর মুসলমানরা প্রায় পরাজিত হলো। -তাহজিবু সিরাতে ইবনে হিশাম : ২৫০
পাঁচ. হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) একবার কিছু আনসারি ও মুহাজিরদের সঙ্গে ছিলেন। তখন একটি উট এসে মহানবী (সা.)-কে সিজদা করল। তখন রাসুলের সাহাবারা বললেন, গাছ-গাছালি ও উট আপনাকে সিজদা করে। অথচ আমরাই আপনাকে সিজদা করার বেশি হকদার। (কারণ আমাদেরকে আপনার আনুগত্য করার আদেশ দেওয়া হয়েছে) তখন মহানবী (সা.) বললেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করো; আর তোমাদের ভাইকে সম্মান করো। আমি কাউকে অপর কাউকে সিজদা করার আদেশ করলে নারীদেরকে তাদের স্বামীদের সিজদা করতে আদেশ করতাম।’ -আহমদ : ২৩৩২১
এ হাদিসের ‘তোমাদের ভাইকে সম্মান করো’ বাক্য থেকে বোঝা যায় যে, হজরত রাসুল (সা.)-কে তাজিম ও সম্মান করা মুমিনদের কর্তব্য। তবে সে সম্মান ও তাজিম কখনও সিজদার মাধ্যমে হতে পারে না। কারণ সিজদা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে করা যায়। তাছাড়া রাসুল (সা.) নিজে তাকে সম্মান করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি হজরত ওমর (রা.)-কে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন আমি নবী করিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা আমার এমন প্রশংসা করো না যেরূপ খ্রিস্টানরা ঈসা ইবনে মরিয়মের করেছে। নিশ্চয় আমি হলাম আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তার রাসুল বলে অভিহিত করো।’
এ হাদিসে লক্ষণীয় বিষয় হলো, খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রশংসা করতে গিয়ে তাকে যেমন খোদার পুত্র খোদা বানিয়েছে মুসলমানরা যেন মহানবীর প্রশংসা করতে গিয়ে সেরূপ কর্মকাণ্ড না করে। তাকে যেন খোদা না বানিয়ে আল্লাহর বান্দা ও রাসুল বলেই অভিহিত করেন।
হজরত আলী ইবনে হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাদের ইসলামের ভালোবাসার রীতিতে ভালোবাসো। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আমাকে আমার প্রাপ্য হকের ওপরে উত্থিত করো না। কারণ আল্লাহতায়ালা আমাকে রাসুল বানানোর আগে তার বান্দা বানিয়েছেন।’
এসব ঘটনা নবী প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর পরও অতি দুঃখের বিষয় হলো, হাল সময়ে নবীকে যেভাবে শ্রদ্ধা করার কথা সেভাবে শ্রদ্ধা করেনি সবাই। বিষেশত বর্তমান সময়ে অনেকে নবীকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে। মহানবীর শানে এমন সব কথা বলছে যা গালাগালের পর্যায়ে পড়ে। এর পরেও তারা নিজেদের মুসলমান বলেই মনে করছে। অথচ রাসুলকে গালাগাল করা ও তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অপরাধ। এ অপরাধের জন্য পরকালে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামি হতে হয়।
কারণ, ইসলামের শুরুতে মুনাফিকরা রাসুলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। তাদের এ ঠাট্টা-বিদ্রুপের জন্য তাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামি হতে হবে বলে আল্লাহ কোরআনে কারিমে জানিয়েছেন।