তুর্কি নারীরা কেন কোরআনের হাফেজ হতে বেশি আগ্রহী
পবিত্র কোরআনের হিফজ তথা মুখস্থ করা ইসলাম ধর্মে মর্যাদাপূর্ণ ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এতে সাধারণত তিন বা চার বছর সময় লাগে। অবশ্য অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়েরা আরও কম সময়ে হেফজ সম্পন্ন করে। সাধারণত ৭-১৩ বছর বয়সের মধ্যে ছেলে-মেয়েরা পবিত্র কোরআন হেফজ সম্পন্ন করে। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদেরকে পড়াশোনা করতে হয়।
আল জাজিরা নেটের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০২ সালে তুরস্কে ১৬৭৭টি কোরআন হেফজের মাদরাসা ছিল। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ হাজার ৬৭৫-এ দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের ধর্ম বিভাগের তথ্য মতে, প্রতিবছর এসব মাদরাসায় ১৫ হাজারের বেশি হাফেজ কোরআন মুখস্থ সম্পন্ন করে।
তুরস্কে গত দুই দশকে মেয়েদের কোরআন শেখানোর উদ্দেশ্যে অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের হাফেজ হওয়ার বাসনায় মেয়েরা তাতে আবাসিক থাকেন। নিজের ঘর-বাড়ি ও আত্মীয়দের ছেড়ে মাদরাসায় আবাসিক থাকা কষ্টকর হলেও তা জীবনের বড় লক্ষ্য পূরণে সহায়ক।
তুরস্কে মেয়েদের কোরআন হেফজ নিয়ে ফরাসি দৈনিক লে মন্ডে পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে শিক্ষার্থীদের কোরআন মুখস্থের পাশাপাশি অবসরে আনন্দ-বিনোদনের কথা তুলে ধরা হয়। কারণ মুখস্থের মতো কঠিন কাজ সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য মনের উৎফুল্লতাও অনেক প্রয়োজন।
কোরআন শেখা তুর্কি মেয়েদের জীবনযাত্রা নিয়ে ‘হাফিজ: দ্য গার্ডিয়ান অব কোরআন’ শিরোনামে তুরস্কের ফটো সাংবাদিক সাবিহা সাইমন একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। তা ২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার লাভ করে। মূলত তার অধিকাংশ ফটোগ্রাফি মেয়েদের কোরআন হেফজের আবাসিক মাদরাসা নিয়ে হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদরাসার মেয়ে হেফজ শিক্ষার্থীদের অবসর সময়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস উপভোগের চিত্র দিয়ে সাবিহা তাদের জীবনাচার বর্ণনা করেন। মূলত এসব হেফজ মাদরাসায় প্রবেশে নানা রকম বিধি-নিষেধ আছে। কিন্তু ৩৫ বছর বয়সী ফটো সাংবাদিক সাবিহা সাইমন আনাতোলিয়ার পাঁচটি শহর ঘুরে বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটান এবং তাদের বর্ণিল জীবনচিত্র তুলে ধরেন।
ইস্তাম্বুলের অধিবাসী সাবিহা সাইমন বর্ণনা করেন, ‘১২ বছর বয়সে আমার যমজ বোনের সঙ্গে একটি হেফজ মাদরাসায় পড়ি। তখন মাদরাসাটি ছিল খুবই ছোট। পরবর্তী সময়ে আমার বোন পবিত্র কোরআনে হাফেজ হন।’
কোরআন মুখস্থ করা নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে জীবনাচার তুলে ধরে সাবিহা ইসলামি সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিক তুলে ধরার প্রয়াস চালান, যা পশ্চিমা মিডিয়ায় অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। মূলত তাদের জীবনাচারে তিনি নিজের শৈশবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। তাই নিজের জীবনের পুরোনো চিত্রগুলোই যেন তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন।
সাবিহা জানান, ‘মূলত সবকিছুই পুনরাবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। তাই যেকোনো বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথমে শব্দ মুখস্থ করতে হয়। এরপর তার অর্থ বুঝতে অনেক বছর পড়াশোনা করতে হয়। তাই মানবজীবনে পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করতে প্রথমে তা মুখস্থ করা হয়। এরপর দীর্ঘকাল পড়াশোনা করে তারা এর মর্ম উপলব্ধি করেন। পবিত্র কোরআন মুখস্থের অনুশীলনের জন্য শৃঙ্খলা, আত্মোৎসর্গ ও গভীর মনোযোগ প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।’
সাবিহা সাইমন ১৯৮৬ সালে ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে হেফজ মাদরাসায় পড়েন। এরপর জর্দানে আরবি ভাষা শিখতে যান। নিজের মতো করে ফটোগ্রাফি করেন। নারী, ইসলামি সংস্কৃতি ও স্থিরচিত্র নিয়ে কাজ করেন তিনি। ইস্তাম্বুল বিলগি ইউনিভার্সিটি থেকে বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক করেন। এরপর কালচারাল স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন।
তুরস্কে গত ২০ বছর যাবৎ প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের পৃষ্ঠপোষকতায় নারীদের হেফজ মাদরাসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জানা যায়, মূলত ‘আদর্শ ও নিষ্ঠাবান প্রজন্ম’ তৈরির বাসনা থেকে এরদোয়ান এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরদোগান নিজেও ইমাম হাপি স্কুলে পড়াশোনা করেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল তিনি একজন হাফেজ হবেন। তিনি কোরআনের হাফেজ হয়েছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি কোরআন তেলাওয়াত করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। কিছুদিন তার নাতিকে কোরআন শেখানোর একটি ভিডিও ভাইরালও হয়।
দীর্ঘকাল যাবৎ এরদোয়ান মুসলিম সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে কাজ করছেন। ইসলাম শিক্ষার প্রসার করে আদর্শ নাগরিক গড়ে তুলতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। যার সুফল বর্তমানে দৃশ্যমান।