ভুল সংশোধনে রাসুলুল্লাহ সা.-এর পদ্ধতি

  • আবদুর রশীদ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

আল্লাহতায়ালা মানবজাতির সৃষ্টির সূচনা করেন হজরত আদম আলাইহিস সালামের মাধ্যমে। পরে হজরত আদম (আ.)-এর জীবন সঙ্গিনী হজরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীব হলেন- মানবজাতি। মানবজাতির প্রথম ব্যক্তি হজরত আদম (আ.)-কে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণের ভুলের দরুণ দুনিয়ায় পাঠানো হয়। শুরু হয় দুনিয়ায় মানবজাতির জীবন পরিচালনা।

দুনিয়ায় হজরত আদম (আ.)-এর ছেলে কাবিল তার নিজ ভাই হাবিলকে হত্যার মাধ্যমে একটি জঘন্য অপরাধ ও ভুল করেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকাণ্ড।

বিজ্ঞাপন

মানবসৃষ্টির শুরু থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ নিত্য-নতুন ভুল করেছে, এখনও ভুল করে চলেছে। মানুষের এসব ভুলের কোনোটা সামান্য, কোনোটা ছোট, আবার কোনো বড় এবং জঘন্য৷

ইসলামের দৃষ্টিতে ভুল একটি স্বাভাবিক বিষয়। সেটা যেকোনো বিষয়ের ভুল হতে পারে। এ কারণে ইসলাম মতে, ভুল যেমন রয়েছে, তেমনি সংশোধনের পথ-পদ্ধতি ও উপায় রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ইসলাম প্রতিটি ভুলের সংশোধন দিয়েছেন নিপূণভাবে৷ প্রতিদিন মানুষ কোনো না কোনো ভুল করেন। কিন্তু কেউ কোনো ভুল করে সমাজের মানুষ তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে ভুল সংশোধনের সুযোগ দেয় না। উল্টো ওই ভুলের জন্য অপমান করা, লজ্জা দেওয়া, ট্রল, হুমকি-ধমকি দেওয়া থেকে শুরু করে তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এমন পরিস্থিতি আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বিষয়।

আগেই বলা হয়েছে, ভুল ভুলই। এটা যে কেউ করতে পারেন। যেকোনো বিষয়ে হতে পারে। তিনি যদি কাজটি ইচ্ছাকৃত না করেন এটা প্রমাণ হয়, তাহলে সেটা ভুল। তবে, ইচ্ছা করে কোনো কাজ করে, সেটা থেকে দায় এড়ানোর জন্য ভুল বলে চালিয়ে দেওয়া অপরাধ।

ভুল সংশোধনে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতি ও আচরণ ছিল আন্তরিক। একবার হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আনাস (রা.)-কে বললেন, ‘আনাস, তুমি কি এ কাজটা করতে পারবে? হজরত আনাস (রা.) বললেন, না, আমি পারবো না (হজরত আনাস রা. তখন ছিলেন ছোট)। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুচকি হাসলেন এবং সেখান থেকে চলে গেলেন৷ হজরত আনাস (রা.) দীর্ঘ দশ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন৷ পরবর্তীতে হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘ওই দিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুচকি হাসিই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি৷ আমার জীবনে আর কোনো এমন ভুল দ্বিতীয়বার হয়নি। এ ছাড়া যেকোনো ভুল হলে, তুমি এটা কেন করলে? এমনটিও তিনি বলতেন না। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে কাটানো দীর্ঘ দশ বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার প্রতি একটি কটূ বাক্য ব্যবহার করেননি৷

এক কোরাইশ সাহাবি (রা.) এসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.! আপনি আমাকে জিনা করার অনুমতি দিন। তখন মজলিসে থাকা অন্য সাহাবিরা রেগে উঠলেন৷ কিন্তু হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত আন্তরিকপূর্ণ হিকমার সঙ্গে যুবককে কাছে এনে বললেন, হে আমার সাহাবি শুনো, এমনটি তোমার মায়ের সঙ্গে হোক তা কি চাও? সে জবাবে বললেন, না৷ অতঃপর, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার কন্যা বা বোনের সঙ্গে হোক এমনটি চাও? সে পুনরায় জবাবে বললেন, না এবং অন্যরাও তা চাইবে না৷ অবশেষে যুবক সাহাবি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন৷ অতঃপর, রাসুলুল্লাহ (সা.) যুবক সাহাবির হাত ধরে দোয়া করে বললেন, আল্লাহ! যুবকের পাপকে ক্ষমা করে দিন, তার অন্তরকে পবিত্র করুন এবং তাকে সহিষ্ণু করুন (তার এমন কামনার বিরুদ্ধে)।

বর্ণিত ঘটনায় লক্ষণীয় বিষয় হলো, যুবকটি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট জঘন্য একটি পাপ কাজের (জিনা) অনুমতি চাওয়ার পরও হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রেগে যাননি এবং ধমক দেননি; বরং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাছে টেনে হিকমার সঙ্গে বুঝিয়েছেন এবং তার ভুলকে সংশোধন করেছেন৷

বিভিন্ন হাদিসের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ভিন্ন ভিন্ন হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন উত্তম কাজের কথার উল্লেখ রয়েছে, যা সাধারণত হাদিসের মাঝে বৈপরীত্য আছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো বৈপরীত্য নেই। এর কারণ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের চরিত্র-অভ্যাস, সময় ও কালের ওপর ভিত্তি করে হিকমার সঙ্গে শিক্ষা দিতেন৷ অর্থাৎ কোনো সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে যদি জিজ্ঞেস করতেন, ‘কোন কাজটি সর্বোত্তম? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবির চরিত্রে কোন বৈশিষ্ট্যের অভাব তার প্রতি লক্ষ্য করে বলতেন, অমুক কাজটি উত্তম৷ ফলে ওই সাহাবি নিজের জীবনে ঘাটতি থাকা আমলকে পূরণ করার প্রচেষ্টা শুরু করে দিতেন৷

এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেকের ভুল সংশোধন করতেন অত্যন্ত হিকমার সঙ্গে৷ তিনি এভাবে বলতেন না, তোমার এই সমস্যা, ওই সমস্যা কিংবা তুমি এই ভুলটি করেছো কিংবা ওই ভুলটি করেছো। বরং হিকমার সঙ্গে বলতেন এই কাজটি করা সবচেয়ে উত্তম এবং ওই কাজটি সবচেয়ে ঘৃণ্য৷ ফলে সাহাবিরা ভুল থেকে অতি সহজে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পেতেন।

বর্তমান সময়ে দেখা যায়, পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন অফিস-আদালত ও দোকানের কর্মচারীর ভুলের দরুণ মালিক অত্যন্ত কটূ বাক্য ব্যবহার করে থাকেন, ধমক দেন, মারপিট করেন ক্ষেত্রবিশেষ সামান্য ভুলের কারণে অনেককে মারতে মারতে মেরে ফেলেন। যা কোনোভাবেই সমীচীন নয়৷

মনে রাখবেন, কাউকে সরাসরি আঘাত দিয়ে কথা বললে কিংবা ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে বললেও মাঝে-মধ্যে তা হিতে বিপরীত ঘটে। তাই হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ভুল সংশোধনের চেষ্টায় রয়েছে সাফল্য ও কল্যাণ।

সুতরাং কারও দ্বারা কোনো ভুল সংঘটিত হলে আমরা যেন তাকে অত্যন্ত অন্তরিকপূর্ণ হিকমার সঙ্গে বুঝিয়ে বলি। তার পাশে দাঁড়াই, প্রয়োজনে তাকে এভাবে বলি, আপনি এমনটি করলে আরও ভালো হতো অথবা আপনি চাইলে এই পথ অবলম্বন করতে পারতেন কিংবা আপনার কাজে আরও সেন্সিটিভ হওয়া বাঞ্চনীয়।

এক কথায় বিভিন্নভাবে, বিভিন্নপন্থায় ভুল সংশোধনে হিকমা অবলম্বন করা উচিত৷ এরূপ যদি আমরা প্রতিটি ভুলের সংশোধনে হিকমাহ অবলম্বন করতে পারি, তাহলে মানুষ খুব সহজে নিজের ভুল সম্পর্কে জেনে-বুঝে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পাবে। কমে আসবে ভুলের মাত্রা।