মানুষের অঙ্গ যেদিন কথা বলবে
মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যাপারে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তর- এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ৩৬
তাফসিরকারকরা বর্ণিত আয়াতের দুইটি অর্থ করেছেন এমন- এক. কেয়ামতের দিন কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ সম্পর্কে তার মালিককে প্রশ্ন করা হবে। প্রশ্ন করা হবে, তুমি সারা জীবন কি কি শুনেছ? প্রশ্ন করা হবে, তুমি সারা জীবন কি কি দেখেছ? প্রশ্ন করা হবে, সারা জীবনে মনে কি কি কল্পনা করেছ এবং কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ? যদি শরিয়তবিরোধী কাজ-কর্ম করে থাকে, তবে এর জন্য সে ব্যক্তিকে আজাব ভোগ করতে হবে।
দুই. কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এ ব্যাপারে স্বয়ং সাক্ষ্য দেবে। কারণ আল্লাহ সেগুলোকে প্রশ্ন করবেন। এটা হাশরের ময়দানে গোনাহগারদের জন্য অত্যন্ত লাঞ্ছনার কারণ হবে। সুরা ইয়াসিনে বলা হয়েছে, ‘আজ (কেয়ামতের দিন) আমি এদের (অপরাধীদের) মুখ মোহর করে দেব। ফলে, তাদের হাত আমার (আল্লাহর) সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের চরণসমূহ সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের।’ -সুরা ইয়াসিন : ৬৫
অনুরূপভাবে সুরা আন নুরে এসেছে, ‘যেদিন (কেয়ামতের দিন) তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে।’ –সুরা আন নুর : ২৪
ইসলামি স্কলারদের অভিমত, মানবদেহ বিভিন্ন অঙ্গের সমষ্টিতে গঠিত। যেমন- হাত, পা, চোখ, কান, নাক, কলব, জিহ্বা ইত্যাদি। এসব অঙ্গকে যেমন রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা আবশ্যক, তেমনি সব ধরনের অপকর্ম ও পাপাচার থেকেও মুক্ত রাখা অপরিহার্য। কারণ রোগব্যাধির কারণে যেমন অঙ্গসমূহ পার্থিব জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গোটা দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি পরকালে অঙ্গসমূহ দেহের সব অপকর্মের কথা প্রকাশ করে দেহকে জাহান্নামের উপযোগী করবে।
নবী করিম (সা.) প্রকৃত ও খাঁটি মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, প্রকৃত মুসলমান ওই ব্যক্তি, যার জবান ও হাত থেকে অপরাপর মুসলমান নিরাপদে থাকে, অর্থাৎ যে জবান দ্বারা কাউকে কটু কথা বলে না এবং হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট দেয় না সে-ই প্রকৃত মুমিন। -সহিহ বোখারি : ১০
জবানের অপব্যবহার থেকে সাবধান
জবান হলো- মনের ভাব প্রকাশের কেন্দ্রবিন্দু। জবান ভালো থাকলে গোটা দেহ ভালো থাকে আর জবান ক্ষতিগ্রস্ত হলে গোটা দেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, প্রত্যহ সকালে অঙ্গসমূহ জবানকে বলে, হে জবান! তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা তুমি সোজা (ভালো) হয়ে গেলে আমরাও সোজা (ভালো) হয়ে যাব, আর তুমি বাঁকা (মন্দ) হয়ে গেলে আমরাও বাঁকা (মন্দ) হয়ে যাব। -সুনানে তিরমিজি : ২৪০৭
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা পরিত্যাগ করবে আর মিথ্যা প্রকৃতপক্ষেই বাতিল ও গর্হিত কাজ- তার জন্য বেহেশতের এক প্রান্তে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি ন্যায়সংগত ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করবে তার জন্য বেহেশতের মাঝখানে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের চরিত্র সুন্দর করবে, তার জন্য বেহেশতের উঁচু স্থানে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। -সুনানে তিরমিজি : ৪৮৩১
বিভিন্ন অঙ্গের পাপ
নবী করিম (সা.) অন্যত্র বলেছেন, আদম সন্তানের ভাগ্যে ব্যভিচারের ব্যাপারে লিখিত বিষয় অবশ্যই তারা প্রাপ্ত হবে। তার চোখের জিনা হলো (বেগানা নারীর প্রতি) দৃষ্টিপাত করা, কানের জিনা হলো (শরিয়তবিরোধী) কিছু শোনা, জবানের জিনা হলো (শরিয়তবিরোধী) কথাবার্তা বলা, হাতের জিনা হলো (অন্যায়-অবৈধ কিছু) স্পর্শ করা, পায়ের জিনা হলো অন্যায় (শরিয়তবিরোধী) পথে চলা, কলব অপকর্মের আকাঙ্ক্ষা করে এবং যৌনাঙ্গ তা বাস্তবায়ন করে বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। -রিয়াদুস সালেহিন : ১৬২২
অঙ্গ দ্বারা হক-বাতিল চেনা কর্তব্য
মানুষের উচিত বিবেক-বুদ্ধি, চেতনা ও উপলব্ধি দ্বারা তাদের মালিককে চেনা এবং ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, হক-বাতিল ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য করা। যারা এ কাজ করতে অক্ষম, মহান আল্লাহ তাদের পশুর চেয়েও অধম বলেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা (হক-বাতিল) বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তা দ্বারা (সত্যকে) দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা (ভালো কথা) শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।’ –সুরা আল আরাফ : ১৭৯
ত্বক ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে
ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু অঙ্গই সাক্ষ্য দেবে না; বরং ত্বকও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে; অথচ মানুষ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ গাফেল। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে কেন সাক্ষ্য দিলে? ত্বক বলবে, যে আল্লাহ সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ -সুরা হামিম আস সাজদা : ২১
অন্তর মানবদেহের প্রধান অঙ্গ
মানবদেহের জন্য কলব বা অন্তর গাড়ির ইঞ্জিনতুল্য। গাড়িকে যেমন ইঞ্জিন পরিচালনা করে; অনুরূপ মানবদেহকেও কলব পরিচালিত করে। ইঞ্জিন নষ্ট হলে যেমন গাড়ি অচল হয়ে পড়ে, তদ্রুপ কলব নষ্ট হলে গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, মানবদেহে গোশতের এমন একটি টুকরা রয়েছে, যা সতেজ থাকলে গোটা দেহ সুস্থ থাকে, আর তা নষ্ট হলে গোটা দেহ অকেজো হয়ে পড়ে। সাবধান! তা হলো কলব। -সহিহ বোখারি
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ব্যক্তি সত্য কথা বললে কলবে একটি উজ্জ্বল দাগ পড়ে যায়। আর মিথ্যা কথা বললে অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়।’ –কুরতবি : ১/১৬১
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ব্যক্তি পাপের কাজ করলে তার কলব কালো হয়ে যায়, অতঃপর তওবা করলে পরিষ্কার হয়ে যায়। -সুনানে তিরমিজি : ৩৩৩৪
মরিচা যেমন লোহাকে খেয়ে মাটিতে পরিণত করে, তেমনি ব্যক্তির পাপের মরিচা তার অন্তরের যোগ্যতা নষ্ট করে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘কখনও নয়, বরং তারা যা করে তা-ই তাদের হৃদয়কে মরিচা ধরে দিয়েছে।’ -সুরা আত তাতফিফ : ১৪