লোক দেখানো ইবাদত নয়

  • সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য ইবাদত-বন্দেগি নয়

মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য ইবাদত-বন্দেগি নয়

ইবাদত-বন্দেগি মানব জীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিমাপক। কিন্তু মূল্যবান এই ইবাদত অনেক সময় অর্থহীন হয়ে যায়, বান্দার সামান্য ভুলের জন্য। পরকালের নেক আমলের যথাযথ প্রতিদান লাভের প্রধান শর্ত হলো- যাবতীয় ইবাদত আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া। তাতে জাগতিক কোনো উদ্দেশ্য ও স্বার্থ জড়িয়ে না ফেলা, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ত্রুটিমুক্ত হওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কেবল একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ -সুরা বাইয়্যিনাহ : ৫

ইবাদত-বন্দেগি প্রকাশ্যে পালনের পাশাপাশি গোপনে পালনের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে প্রধানতম বিষয় হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে ইবাদত করা। দ্বিতীয় বিষয় হলো, ইবাদতটি সুন্নত অনুযায়ী করা। তৃতীয়, ইবাদতটি মানুষকে দেখানোর মানসিকতায় না করা। সব ধরনের ইবাদতের ক্ষেত্রে এগুলো প্রযোজ্য। ইবাদত প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য- এটা মূখ্য নয়।

বিজ্ঞাপন

কিছু ইবাদত রয়েছে যেগুলো প্রকাশ্যে করতে হয়। যেমন- নামাজ। নামাজ মসজিদে এসে জামাতের সঙ্গে প্রকাশ্যে আদায় করতে হয়। হজ বায়তুল্লায় যেয়ে প্রকাশ্যে পালন করতে হয়। আর কিছু ইবাদত গোপনে পালন করা যায়। যেমন- জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ ও দান-সদকা ইত্যাদি।

ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, যে ইবাদত অপ্রকাশ্যে করা যায়, তা অপ্রকাশ্যে করাই উত্তম। আর যা লুকিয়ে করা যায় না, তা প্রকাশ্যেই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।’ -সুরা হুজুরাত : ২১

বিজ্ঞাপন

আল্লাহতায়ালার নিকট আমল কবুল হওয়ার জন্য লৌকিকতামুক্ত এবং কোরআন-সু্ন্নাহ নির্দেশিত নিয়মে হওয়া অপরিহার্য। যে লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, সে ছোট শিরক করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে।

নিজের আমলের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক এবং লোকেরা শুনে বাহবা দিক এ নিয়তে যে ইবাদত-বন্দেগি করবে সে শিরকে নিপতিত হবে। এমন লোকদের সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শোনানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কেয়ামতের দিন) শুনিয়ে দেবেন। আর যে লোক দেখানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কেয়ামতের দিন) দেখিয়ে দেবেন।’ -সহিহ বোখারি : ৬৪৯৯

লোক দেখানো কোনো কাজ আল্লাহ কবুল করেন না

বর্ণিত হাদিসের অর্থ হলো, তিনি এ জাতীয় লোককে কেয়ামতের দিন মানুষের সামনে অপমানিত করবেন এবং কঠোর শাস্তি দেবেন। আরও বলা হয়েছে, যে আল্লাহ ও মানুষ উভয়ের সন্তুষ্টিকল্পে ইবাদত করবে, তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি অংশীবাদিতা (শিরক) থেকে সকল অংশীদারের তুলনায় বেশি মুখাপেক্ষিহীন। যে কেউ কোনো আমল করে এবং তাতে অন্যকে আমার সঙ্গে শরিক করে, আমি তাকে ও তার আমল উভয়কেই বর্জন করি।’ -সহিহ মুসলিম : ২৯৮৫

তবে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে কোনো আমল শুরুর পর যদি তার মধ্যে লোক দেখানো ভাব জাগ্রত হয় এবং সে তা ঘৃণা করে ও তা থেকে সরে আসতে চেষ্টা করে, তাহলে তার ওই আমল শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি সে তা না করে; বরং লোক দেখানো ভাব মনে উদয় হওয়ার জন্য প্রশান্তি ও আনন্দ অনুভব করে, তাহলে অধিকাংশ আলেমের মতে তার ওই আমল বাতিল হয়ে যাবে।

ইবাদতের বাহ্যিক ত্রুটি হলো, তা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী না হওয়া, ইবাদতের পূর্বশর্ত পূরণ না করা। আর ইবাদতের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি হলো- নিয়তের অসততা। তা হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্যকোনো উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। যেমন- মানুষের প্রশংসা, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি, কারও দৃষ্টি আকর্ষণ ইত্যাদির মোহে ইবাদত করা।

ইসলামি পরিভাষায় একে রিয়া এবং বাংলা ভাষায় ‘লোক-দেখানো’ বা ‘প্রদর্শনপ্রিয়তা’ বলা হয়। প্রদর্শনপ্রিয়তা নিয়তের অসততা, যা ইবাদতকে মূল্যহীন করে দেয়। নিয়ত ঠিক না হলে আল্লাহর কাছে বান্দার কোনো কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়ত শুদ্ধ হলে আল্লাহ জাগতিক কাজকে ইবাদতের মর্যাদা দেন। আবার নিয়ত শুদ্ধ না হলেও ইবাদতসমূহ প্রত্যাখ্যান করেন। হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ -সহিহ বোখারি : ১

মানুষের ভেতর প্রদর্শনপ্রিয়তা বিচিত্র রূপে প্রকাশ পায়। কেউ ইবাদতের সময় প্রত্যাশা করে মানুষ তার ইবাদত দেখে প্রশংসা করুক। কেউ আশা করে, মানুষ বিস্মিত হোক। কারও ইচ্ছা থাকে মানুষ তার ইবাদত দেখে তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করুক। কারও উদ্দেশ্য থাকে ইবাদতের কারণে মানুষের ভেতর তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ুক।

প্রদর্শনের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, তার পরিণতি ভয়াবহ। এমন ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পরকালে এসব ইবাদত ব্যক্তির জন্য বোঝা ও আক্ষেপের কারণ হবে। মুসলিম শরিফে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কেয়ামতের দিন লোক-দেখানো আমলকারীদের বিচারের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন, যাতে একজন শহীদ (আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী), একজন কোরআনের শিক্ষক ও একজন দানবীরের আলোচনা এসেছে। যারা খ্যাতি ও সুনামের মোহে জেহাদ, কোরআন শিক্ষা ও দান করত। তারা তাদের আমলের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তাদের বলেন, ‘তোমরা যা চেয়েছ, পৃথিবীতে তা পেয়েছ। সুতরাং আজ আমার কাছে তোমাদের কোনো প্রাপ্য নেই।’ -সহিহ মুসলিম : ৩৫২৭

অন্য আয়াতে যারা লোক-দেখানো ইবাদত করে তাদের নিন্দা করে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, যারা প্রদর্শন, নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া থেকে বিরত থাকে।’ -সুরা মাউন : ৪-৭